|
|
|
|
দলের দুই নেতার সঙ্গে ধৃত মুম্বইয়ে |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
নন্দীগ্রামে চার দিন আগের ‘শহিদ-স্মরণ’ অনুষ্ঠানেও তাঁর গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি উঠেছিল। হলদিয়ার একদা ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ সেই সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ শনিবার মুম্বইয়ে পুলিশের জালে ধরা পড়লেন। ২০০৭-এর নভেম্বরে নন্দীগ্রাম ‘পুনর্দখল’-পর্বে খুন, অপহরণ, তথ্যপ্রমাণ লোপাট ইত্যাদির মামলায় অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত লক্ষ্মণবাবুকে ‘ফেরার’ দেখিয়েই চার্জশিট পেশ করে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ। নন্দীগ্রামের ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির ন’জন সমর্থক তখন থেকেই নিখোঁজ বলে দাবি পুলিশের।
গত ৩০ জানুয়ারি হলদিয়া আদালতে চার্জশিট পেশ করে সিআইডি। তার কয়েক মাস আগেই আত্মগোপন
|
অমিয় সাউ |
|
অশোক গুড়িয়া |
করেছিলেন প্রাক্তন সাংসদ। পুলিশ জানায়, লক্ষ্মণবাবুর সঙ্গেই এ দিন আরও দুই ‘ফেরার’ ধরা পড়েছেন। তাঁরা হলেন পূর্ব পাঁশকুড়ার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক অমিয় সাউ এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কৃষকসভার সম্পাদক অশোক গুড়িয়া। ধৃতদের এ দিনই মুম্বইয়ের কুরলা আদালতে অতিরিক্ত মুখ্য মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে হাজির করানো হয়েছে। আগামী ২২ মার্চের মধ্যে তাঁদের হলদিয়ায় আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। ডিআইজি, সিআইডি কারিয়াপ্পা জয়রামন বলেন, “মুম্বই পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করে সতর্কতার সঙ্গে ধৃতদের কলকাতায় নিয়ে আসা হবে। স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিচ্ছি। যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের কলকাতায় নিয়ে আসা হবে।” সিআইডি সূত্রের খবর, আজ, রবিবার ধৃতদের বিমানে করে কলকাতায় নিয়ে আসা হতে পারে।
মাত্র মাসখানেক আগে সুপ্রিম কোর্টে শর্তাধীনে জামিন পেয়েছেন কেশপুরের ‘কঙ্কাল-কাণ্ডে’ অভিযুক্ত দাপুটে সিপিএম নেতা তথা গড়বেতার বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ। বাঁকুড়ার তালড্যাংরার বিধায়ক মনোরঞ্জন পাত্রও তৃণমূল কর্মী খুনের একটি পুরনো মামলায় সম্প্রতি ‘আত্মসমর্পণ’ করেছেন। এর মধ্যে লক্ষ্মণবাবুদের গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটল। প্রাক্তন সাংসদকে রাজ্য কমিটি থেকে ছেঁটে ফেললেও সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য আইনি লড়াইয়ে সর্বতোভাবে লক্ষ্মণবাবু ও অন্য অভিযুক্তদের পাশে থাকার ‘অঙ্গীকার’ করেছেন। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সিপিএম সম্পাদক কানু সাউয়ের বক্তব্য, “টিভি দেখে গ্রেফতারের খবর পেয়েছি। তবে বিস্তারিত কিছু জানি না। দল সব রকম ভাবে ওঁদের পাশে থাকবে।”
তমলুকের তৃণমূল সাংসদ তথা দলের রাজ্য যুব সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী প্রত্যাশিত ভাবেই লক্ষ্মণবাবুদের গ্রেফতারের ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। নন্দীগ্রামের ‘নিখোঁজ’দের মধ্যে ভগীরথ মাইতির স্ত্রী সুষমা এবং সত্যেন গোলের স্ত্রী দুর্গারানির প্রতিক্রিয়া, “অপরাধীরা গ্রেফতার হয়েছে শুনে ভাল লাগছে। কিন্তু শুধু ধরা পড়লেই হবে না। ওদের কঠোর শাস্তি চাই।”
কী ভাবে ধরা পড়লেন লক্ষ্মণবাবুরা?
সিআইডি সূত্রের খবর, গত ১৩ মার্চ তমলুকে প্রাক্তন সাংসদের এক পরিচিতের মোবাইলে আসা ফোনের সূত্র ধরেই নড়েচড়ে বসেন গোয়েন্দারা। ফোনটা এসেছিল হায়দরাবাদ থেকে। কিন্তু পুলিশ তড়িঘড়ি সেখানে পৌঁছে খোঁজখবর শুরু করতেই মালুম হয়, ওই ফোনের ‘টাওয়ার লোকেশন’ সরে গিয়েছে মুম্বইয়ের চেম্বুর এলাকায়। এর পরেই আটঘাট বেঁধে দু’দিন আগে মুম্বইয়ে গিয়ে পৌঁছয় তদন্তকারী দল।
সিআইডি জানিয়েছে, মুম্বইয়ের চেম্বুরে ছোটেরাম গিধওয়ানি রোডে একটি বাণিজ্যিক সংস্থার গেস্ট-হাউসে ছিলেন লক্ষ্মণবাবুরা। সেখানে ওই সংস্থার একটি শাখা অফিস আছে। কলকাতার দরগা রোডেও আছে ওই সংস্থার অফিস। সদর দফতর হায়দরাবাদে। হলদিয়ায় একাধিক কাজের সূত্রে ওই সংস্থার সঙ্গে সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল বলে সিআইডি-র দাবি। তদন্তকারী অফিসারদের অনুমান, হায়দরাবাদেও ওই সংস্থারই গেস্ট হাউসে ছিলেন লক্ষ্মণবাবুরা। সেখান থেকে দিন তিনেক আগে তাঁরা মুম্বইয়ের চেম্বুরে চলে যান। শুক্রবার পৌঁছয় সিআইডি-র তদন্তকারী দল।
সিআইডি-র পেশ করা চার্জশিটে ইতিমধ্যে খুন, প্রমাণ লোপ, ষড়যন্ত্র, হাঙ্গামা, অস্ত্র আইন-সহ বিভিন্ন অভিযোগে একগুচ্ছ ধারায় মোট ৮৮ জন সিপিএম নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করেছে সিআইডি।
সেই ৮৮ জনের মধ্যে ন’জন আপাতত জেলবন্দি, ছ’জন জামিনে মুক্ত। ৭৩ জন ‘ফেরার’-এর মধ্যে এ দিন গ্রেফতার হলেন লক্ষ্মণ শেঠ, অমিয় সাউ ও অশোক গুড়িয়া। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে হলদিয়া আদালত। এখনও যাঁরা পুলিশের নাগালের বাইরে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য খেজুরির সিপিএম নেতা হিমাংশু দাস, বিজন রায়, প্রজাপতি দাস, রবিউল হোসেন এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার দুই নেতা তপন ঘোষ ও সুকুর আলি।
চার্জশিটে সিআইডি জানিয়েছে, সিপিএমের ‘পুনর্দখল’-পর্বে নন্দীগ্রাম থেকে যাঁরা ‘নিখোঁজ’ হয়েছিলেন, খুন করে তাঁদের দেহ লোপাট করাই হয়েছে। নিহতদের দেহ প্রথমে খেজুরিতে নিয়ে যাওয়া হয়। শের খাঁ চকের জননী ইটভাটা এবং স্থানীয় একটি প্রাথমিক স্কুলে রাখা হয়। খেজুরি থেকে ধৃত সিপিএমের প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য অজিত বরের নৌকায় দেহগুলি তুলে রসুলপুর ঘাট থেকে বঙ্গোপসাগরে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয় বলে দাবি সিআইডি-র। খুনে ব্যবহৃত দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং দেহ পাচারে ব্যবহৃত একটি অ্যাম্বুল্যান্সও বাজেয়াপ্ত করেছে সিআইডি।
লক্ষ্মণবাবুদের সঙ্গে নন্দীগ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের বিরোধের সূত্রপাত অবশ্য ২০০৬-এর শেষ থেকে। নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাবের জন্য হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান লক্ষ্মণবাবু যখন রাজ্য সরকারের পক্ষে জমি অধিগ্রহণের নোটিস জারি করেছিলেন।
ওই নোটিস বাতিলের দাবিতেই শুরু হয়েছিল নন্দীগ্রামে জমি-রক্ষায় ভূমি-উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির আন্দোলন। পরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিবৃতি দিয়ে পিছু হটার কথা বললেও পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ২০০৭-এর ১৪ মার্চ জমি-রক্ষা আন্দোলনকারীদের অবরোধ হটাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ১৪ জন নিহত হন। তখন পুলিশের সঙ্গেই খাকি উর্দিতে সিপিএম ক্যাডাররাও ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার পরেই নন্দীগ্রাম তথা পূর্ব মেদিনীপুর তো বটেই, রাজ্য-রাজনীতিতেও পায়ের তলার জমি আলগা হতে শুরু করে সিপিএমের।
নন্দীগ্রামে হারানো রাজনৈতিক জমি ‘পুনর্দখলে’ই ওই বছর অক্টোবরের শেষাশেষি লক্ষ্মণবাবুর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল সিপিএমের ‘অপরাশেন সূর্যোদয়’। গুলি চলেছিল ভূমি কমিটির মিছিলে। তাদের কিছু সমর্থকের দেহও উদ্ধার হয়। প্রাক্তন সেনাকর্মী গোকুলনগরের আদিত্য বেরা ও অর্ধেন্দু দাস অধিকারী, সাউদখালির ভগীরথ মাইতি, বলরাম সিংহ ও সত্যেন গোল, সোনাচূড়ার নারায়ণ দাস, সুবল মাজি ও কাজল মণ্ডল, গাঙড়ার বাবু দাস তখন থেকেই নিখোঁজ।
রাজ্যে পালাবদলের পরে গত অক্টোবরে নিখোঁজদের কয়েক জনের পরিজন হাইকোর্টে ‘হেবিয়স কর্পাস’ করেন। তার ভিত্তিতেই সিআইডি-তদন্তের নির্দেশ হয়। গত ৮ নভেম্বর তমলুকে, জেলা বামফ্রন্টের একটি কর্মসূচিতে লক্ষ্মণবাবুকে প্রকাশ্যে শেষ বার দেখা গিয়েছিল। গত বছর পুজোর পরে-পরে সেই তদন্ত শুরুর সময় থেকেই নিখোঁজ ছিলেন লক্ষ্মণবাবু। এ বছরের গোড়ায় সিপিএমের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্মেলনেও তাঁকে আর দেখা যায়নি। |
যে সব ধারায় চার্জশিট |
বেআইনি জমায়েত (ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৭ ধারা), অবৈধ আটক (৩৪২), রাহাজানি (৩৯১),
মারধর (৩২৩), অপহরণ (৩৬৪), খুনের ষড়যন্ত্র (১২০বি), খুনের চেষ্টা (৩০৭), খুন (৩০২),
তথ্যপ্রমাণ লোপ (২০১), সম্মিলিত অভিপ্রায় (৩৪) এবং আগ্নেয়াস্ত্র বহন (২৫ ও ২৭ অস্ত্র আইন) |
|
|
|
|
|
|