লক্ষ্মণের গ্রেফতারে ‘জয়ী’ হলেন বুদ্ধদেবই
কাকতালীয়। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বক্তব্য ‘বৈধতা’ পেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে।
তমলুকের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, যে লক্ষ্মণ শেঠকে টানা ধাওয়া করে মুম্বইয়ের চেম্বুর থেকে শনিবার গ্রেফতার করল মুখ্যমন্ত্রী মমতার অধীনস্থ পুলিশবাহিনী, তাঁর সঙ্গে দলের ‘দূরত্ব’ তৈরির বিষয়ে দলের অন্দরে বরাবর সরব থেকেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বিশেষত তাঁর হস্তক্ষেপেই সম্প্রতি সিপিএমের রাজ্য কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ লক্ষ্মণবাবুকে। তখনও অবশ্য হলদিয়ার একদা একচ্ছত্র অধিপতি লক্ষ্মণবাবু ‘পলাতক’ ছিলেন।
প্রথমে গড়বেতার কঙ্কাল-কাণ্ডে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, বর্তমান বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ এবং তার পর লক্ষ্মণবাবু বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর সিপিএম যখন ‘ঘর গোছানো’র চেষ্টা করছে, তখন পরপর এই দুই ডাকাবুকো নেতার গ্রেফতারের ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রধান বিরোধী দলকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলল। বিশেষত, দ্বিতীয় জনের সঙ্গে যখন নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের সরাসরি যোগ রয়েছে। দলের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, “লক্ষ্মণ’দার গ্রেফতারে নন্দীগ্রামের ঘটনা আবার মানুষের স্মৃতিতে ফিরে আসবে। সেটা তো বিড়ম্বনার কারণ বটেই। বিশেষত, পঞ্চায়েত ভোটের আগে।”
বস্তুত লক্ষ্মণবাবুকে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল ২০০৭ সালের নভেম্বরে নন্দীগ্রামে ‘অপারেশন সূর্যোদয়ে’র ঘটনায় (যাকে সাধারণ ভাবে সিপিএমের নন্দীগ্রাম ‘পুনর্দখল’ বলেই বর্ণনা করা হয়)। অভিযোগ, যে ঘটনায় অন্তত সাত জন নিখোঁজ। স্বভাবতই সেই ঘটনা আবার সর্বসমক্ষে চলে আসায় বিড়ম্বনায় পড়বে বিরোধী দল।
নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পর দলের অন্দরে লক্ষ্মণবাবুকে ছেঁটে ফেলার ব্যাপারে ক্রমাগতই ‘সরব’ হচ্ছিলেন বুদ্ধবাবু, সূর্যকান্ত মিশ্রের মতো নেতারা। যদিও ঘটনাচক্রে, যে ঘটনায় লক্ষ্মণবাবুকে গ্রেফতার হতে হল, সেই ঘটনার পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, ‘‘দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন!’’ অর্থাৎ তৃণমূলকে ঢিলের বদলে পাটকেল ফিরিয়ে দেওয়া গিয়েছে! নন্দীগ্রামে দলের ‘ঘরছাড়া’দের ফেরাতে সে সময় লক্ষ্মণবাবুর ভূমিকা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না বুদ্ধবাবুর।
হলদিয়ার পার্টি অফিসের এই অংশেই থাকতেন সপরিবার
লক্ষ্মণ শেঠ। শনিবার তা তালাবন্ধ। ছবি: আরিফ ইকবাল খান
দলের চাপে তাঁকে ওই মন্তব্য করতে হয়েছিল বলেই আলিমুদ্দিনের নেতাদের একাংশ এখনও মনে করেন। কিন্তু দলকে ব্যবহার করে হলদিয়া-সহ পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় লক্ষ্মণবাবু যে ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে তুলেছিলেন, তা চিরকালই অপছন্দ করেছেন বুদ্ধবাবু।
নন্দীগ্রামের ঘটনার পর ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়ে তমলুকে তৃণমূলের শুভেন্দু অধিকারীর কাছে হেরে যান লক্ষ্মণবাবু (মূলত নন্দীগ্রাম-আন্দোলনে ভর করে শুভেন্দু-সহ তৃণমূলের মোট ১৯ জন সাংসদ হন। শুভেন্দু এ দিন বলেওছেন, “লক্ষ্মণ শেঠদের রাজনৈতিক বিচার হয়ে গিয়েছে। মানুষ ওদের প্রত্যাখ্যান করেছেন”)। তার পর থেকেই দলের অন্দরে তাঁকে ছেঁটে ফেলার কাজ শুরু হয় বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে। এমনকী, লোকসভায় হেরে প্রাক্তন সাংসদ যখন ২০১১-র বিধানসভা ভোটে হলদিয়ার সুতাহাটা কেন্দ্র থেকে ভোটে লড়তে চান, তখনও বেঁকে বসেন বুদ্ধবাবুই। লক্ষ্মণবাবুর পাশাপাশিই দলের অন্যান্য তথাকথিত স্ট্রং-ম্যান, যেমন উত্তর হাওড়ার লগনদেও সিংহ বা হাড়োয়ায় মজিদ মাস্টারকেও বিধানসভায় টিকিট দেওয়ার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি তুলেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত কেউই টিকিট পাননি।
বুদ্ধবাবুর সঙ্গেই লক্ষ্মণবাবুর ব্যাপারে সহমত পোষণ করতেন অধুনা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও। তাঁরা দল থেকে লক্ষ্মণবাবুকে পুরোপুরি ছেঁটে ফেলারই পক্ষপাতী ছিলেন। তখন রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু তাঁদের সুরে সরাসরি সুর না-মেলালেও বাধাও দেননি। এ দিনও দিল্লিতে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের ফাঁকে বিমানবাবু বলেছেন, “আইন আইনের পথে চলবে। অনেক সাজানো মামলা হয়েছে। এটা কী, সেটা আদালতে আইনি বিচারে নির্দিষ্ট হবে।” পাশাপাশিই বিমানবাবু জানিয়েছেন, লক্ষ্মণবাবুকে দলের তরফে ‘আইনি সহায়তা’ও দেওয়া হবে।
কিন্তু দলের একাংশের মতে, এ ছাড়া বিমানবাবুর পক্ষে অন্য কিছু বলা সম্ভবও ছিল না। কারণ, এখনও পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা কমিটির অধিকাংশ সদস্য ‘লক্ষ্মণ-পন্থী’। তা ছাড়া পঞ্চায়েত ভোটের আগে লক্ষ্মণবাবুর পাশ থেকে একেবারে সরে গেলে কলকাতা থেকে পূর্ব মেদিনীপুরে কাউকে গিয়ে নতুন করে সংগঠন গড়তে হবে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে স্বল্প সময়ে তা খুব বাস্তবোচিত পদক্ষেপ হবে না। ফলে লক্ষ্মণবাবুকে নিয়ে সিপিএম এখন যথেষ্ট ‘দোটানায়’। সেই জন্যই লক্ষ্মণবাবুকে ‘আইনি সহায়তা’ দেওয়ার পাশাপাশিই বলতে হয়েছে ‘আইন আইনের পথে চলবে’। এক বার ‘সাজানো মামলা’ বলা ছাড়া (তা-ও এটা জানিয়ে দেওয়া, যে সেটা আদালতে আইনি বিচারে বোঝা যাবে) সরাসরি কোনও ষড়যন্ত্র বা ওই ধরনের অভিযোগ বিমানবাবু আনেননি। বরং বলেছেন, “এর বেশি আর একটি কথাও আমি বলব না।”
নজরে নন্দীগ্রাম
২০০৭ ২০১১-২০১২
নভেম্বর ৬-১০ নভেম্বর
• নন্দীগ্রাম
‘পুনর্দখলে’ সিপিএমের
‘সূর্যোদয় অভিযান’।
• নন্দীগ্রাম জুড়ে
সিপিএমের
হামলার অভিযোগ।
২০১১ সেপ্টেম্বর
• নিখোঁজদের আত্মীয়দের
‘হেবিয়াস কর্পাস’। সিআইডি
তদন্তের নির্দেশ হাইকোর্টের।
১০ নভেম্বর
• ভূমি-উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মিছিল আক্রান্ত।
• রেজাউল ইসলাম, শ্যামলী মান্না, হরেন প্রামাণিকের দেহ উদ্ধার।
• ভূমি কমিটির ৩ আহতকে তুলে নিয়ে
যাওয়ার পথে ধৃত তপন-সুকুর।
• অভিযোগ নিখোঁজ বহু। চার বছরেও খোঁজ নেই।
২০১২র ৩০ জানুয়ারি
• লক্ষ্মণ শেঠ-সহ ৮৮ সিপিএম নেতা-কর্মীর নামে চার্জশিট।
• চার্জশিটে দাবি, নিখোঁজরা খুন। দেহ লোপাট।
• অভিযুক্তদের মধ্যে বন্দি ৯, জামিনে মুক্ত ৬, ফেরার ৭৩।
২০১২র ২৭ ফেব্রুয়ারি
• ফেরারদের নামে হলদিয়া আদালতের ‘ওয়ারেন্ট’।
১৭ মার্চ, ’১২ মুম্বইয়ে গ্রেফতার লক্ষ্মণ শেঠ ১৭ মার্চ, লক্ষ্মণের সঙ্গে ধৃত অমিয় সাউ, অশোক গুড়িয়াও
উল্লেখযোগ্য ফেরার: খেজুরির সিপিএম নেতা হিমাংশু দাস, বিজন রায়, প্রজাপতি দাস,
রবিউল হোসেন এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার দুই নেতা তপন ঘোষ ও সুকুর আলি।

১০ নভেম্বর, ’০৭ পড়ে আছে হরেন প্রামাণিকের দেহ
প্রসঙ্গত কঙ্কাল-কাণ্ডে ধৃত সুশান্তবাবুকেও দল ‘আইনি সহায়তা’ দিয়েছিল। তিনি জামিন পাওয়ার সময় দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেই জেল-গেটে হাজির ছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু। কিন্তু দলের নেতাদের একাংশের ব্যাখ্যায়, লক্ষ্মণবাবুর সঙ্গে সুশান্তবাবুর একটা ‘মৌলিক ফারাক’ রয়েছে। জঙ্গলমহলে সুশান্তবাবুর মাওবাদীদের ‘গণ-প্রতিরোধে’র তত্ত্বে দলের সিলমোহর ছিল। তা ছাড়া, লক্ষ্মণবাবুর মতো সুশান্তবাবু দলকে ‘ব্যবহার’ করে ‘নিজস্ব সাম্রাজ্য’ গড়ে তোলেননি। ‘ডাকাবুকো সংগঠক’ ছাড়া সুশান্তবাবুর সামগ্রিক জীবনযাপন নিয়েও তেমন কোনও বড় অভিযোগ ছিল না। দলের রাজ্য কমিটির এক তরুণ সদস্যের কথায়, “লক্ষ্মণ’দার জীবনযাত্রায় আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন ব্যয়ের বিষয়টা ক্রমশই লোকসমক্ষে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিল। ফলে সেদিক দিয়ে সাংগঠনিক ক্ষমতা সত্ত্বেও তিনি দলের কাছে ক্রমশই বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন।”
সে দিকে লক্ষ রেখেই লোকসভা ভোটের পর দলের অভ্যন্তরে লক্ষ্মণবাবুর ‘ডানা ছাঁটা’র প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু দলের শ্রমিক সংগঠন সিটুর নেতাদের একাংশ তাতে ক্রমাগত বাধা দিয়েছেন। আলিমুদ্দিনের নেতাদের একাংশও দ্রুত লক্ষ্মণবাবুকে ছেঁটে ফেলার ব্যাপারে অনুমোদন দেননি। বস্তুত দলের সাম্প্রতিক রাজ্য সম্মেলনে রাজ্য কমিটি থেকেও ‘পলাতক’ লক্ষ্মণবাবুকে বাদ না-দেওয়ার ব্যাপারে দলের একটা অংশ সরব ছিলেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বুদ্ধবাবু-সূর্যবাবুর মতামতই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। তা সত্ত্বেও দলের একাংশের কাছে লক্ষ্মণবাবু ‘হিরো’ ছিলেন বলেই সিপিএম সূত্রের বক্তব্য। পুলিশের হাতে তিনি ধরা পড়ায় ভাবমূর্তি বেশ খানিকটা ‘মলিন’ হবে বলেই দলীয় সূত্রের ব্যাখ্যা। যার ফলে দলে আরও জোরালো ভাবে ‘প্রতিষ্ঠিত’ হবে বুদ্ধবাবুর মতামত। প্রকাশ্যে ‘পাশে’ থাকলেও দলের অভ্যন্তরে দ্রততর হবে তাঁকে ‘গুরুত্বহীন’ করার প্রক্রিয়া।
আশ্চর্য নয় যে, সিপিএমের এক নেতা এদিন বলেছেন, “মমতার কাছে তো বুদ্ধ’দার প্রকারান্তরে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত!”
(সহ প্রতিবেদন- প্রেমাংশু চৌধুরী)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.