প্রবন্ধ ...
অ-মিত্রাক্ষর
বীন্দ্রনাথের সৌজন্যে সার্ধশতবর্ষের মুহূর্তটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গীতাঞ্জলি প্রকাশের শতবর্ষও পালিত হল সাড়ম্বরেই। অথচ বাঙালির নানা পার্বণে প্রায় উচ্চারিতই হল না যে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ দেড়শো বছর অতিক্রম করল। ১৮৬১ সালের জানুয়ারিতে এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়, ফেব্রুয়ারিতে কালীপ্রসন্ন সিংহের বিদ্যোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে কবির সংবর্ধনা, এপ্রিল মাসে মেঘনাদবধ কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ড পুস্তকাকারে প্রকাশ পায়। জন্মলগ্ন থেকেই সে খ্যাতিমান, কিন্তু বিতর্কিত। ‘গীতাঞ্জলি’কে সরিয়ে রাখলে গত দু’শো বছরের সবচেয়ে স্মরণীয় কাব্যগ্রন্থ মেঘনাদবধ ও সাতটি তারার তিমির। কিন্তু সে প্রসঙ্গ উহ্য রেখে বলা যাক, যেমন সে যুগে, তেমন এ যুগে মেঘনাদবধ কাব্য বিখ্যাত ও সংবর্ধিত অথচ আমাদের সৌন্দর্যচেতনা তার কবিত্ব নিয়ে নিঃসংশয় নয়, কোথাও একটা অস্বস্তি থেকে গেছে।
‘নয়ে নাটুয়া’ গোষ্ঠীর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ নাটকে গৌতম হালদার
আদি যৌবনের উত্তেজনায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আক্রমণ করেছিলেন মধুসূদনের কাব্যকে। যৌবনাবসানে তিনি প্রায়শ্চিত্তের আয়োজন করেন অন্য একটি লেখায়। তাতে শুধু প্রমাণিত হয় যে, আত্মপ্রকাশের মুহূর্তে প্রধান প্রতিপক্ষকে চিনতে তাঁর ভুল হয়নি। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই বইয়ের ভূমিকায় মধুসূদনের ভূয়সী প্রশংসা সত্ত্বেও লিখেছিলেন, ‘বাক্যের জটিলতা-দোষই তাহার রচনার প্রধান দোষ; অর্থাৎ যে বাক্যের সহিত যাহার অন্বয় বিশেষ্য বিশেষণ, সংজ্ঞা সর্বনাম এবং কর্তা ক্রিয়া সম্বন্ধ তৎপরস্পরের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান; সুতরাং, অনেক স্থলে অস্পষ্টার্থ দোষ জন্মিয়াছে, অনেক পরিশ্রম না করিলে ভাবার্থ উপলব্ধ হয় না।’ আর বঙ্কিমচন্দ্র যতই জাতীয় পতাকায় শ্রীমধুসূদনের নাম উৎকীর্ণ দেখতে আগ্রহী হোন না কেন, ‘দ্য ক্যালকাটা রিভিয়ু’-এ (১৯৭১) আলোচনার সময় মধুসূদনের অবিরত পুনরুক্তি যে প্রায়ই বিবমিষা জাগায়, তা জানিয়েছেন। ত্রিশের দশকের আধুনিকদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে তীব্র অভিশাপ বুদ্ধদেব বসুর: ‘সমগ্র কাব্যটি হয়েছে যেন ছাঁচে-ঢালা কলে-তৈরি নিষ্প্রাণ সামগ্রী; দোকানের জানলার শোভা, ড্রইং রুমের অলংকরণ, কিন্তু অন্তঃপুরে অনধিকারী।’
এমনকী বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথরাও বুঝতে চাইছিলেন না, বা মধুসূদনের তৎসম শব্দের ঝংকারে ভুলে গিয়েছিলেন যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্য লেখককে দোষারোপ করা অন্যায়। আসলে বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের প্রধান ত্রুটি, সে শুধু মাধ্যমগত ও প্রকরণগত পরিসরে কাব্য বিচার করে। বুঝতেই পারে না যে, মাইকেল বয়ান-অতিরিক্ত সন্দর্ভ। ফলে মেঘনাদবধ রচয়িতার আত্মা যদিও নশ্বরতার সীমা পার হয়েছে, তার দেহ অদ্যাবধি রক্তাক্ত। বাঙালি অনিয়মের লাবণ্য দূর থেকে সসম্ভ্রমে দেখে, গৃহে নিমন্ত্রণ জানায় না। দৃষ্টান্ত এই বিসমবাহু ত্রিভুজ মাইকেল-মানিক-ঋত্বিক।

এক জন কবি কখন তাঁর ভাষার অহঙ্কার হয়ে ওঠেন? জীবনানন্দ এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ‘কী হিসেবে শাশ্বত’ নিবন্ধে, যে ‘লেখা কেউই প্রায় পড়ে না, তবুও লেখক অমর।’ মধুসূদনের চূড়ান্ত সার্থকতা যে তিনি উন্নীত চৈতন্যের ভাষা হিসেবে বাঙালি মানসে শিকড় ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাব্যসমূহ শোককেই জরায়ু ভেবেছে। যেমন পশ্চিমে অর্ফিউস। যেমন পুবে বাল্মিকী। মধুসূদন ব্যতিক্রম নন। এই যে প্রমীলার সহমরণ নবম সর্গের প্রাক্ অন্তিম চরণ বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে! এ তো আমাদের জাতীয় শোকোচ্ছ্বাস। জীবনানন্দ এই বিষাদপ্রতিমাকেই আবিষ্কার করবেন বেহুলা হিসেবে রূপসী বাংলায়। আর ঋত্বিক ঘটকের ছবির পর ছবিতে জেগে থাকবে এই আর্তমানবী: বাঙালির মাতৃমুখ।
বোদলেয়ার যাকে করসপঁদস বলেন ও এলিয়ট অবজেক্টিভ কো-রিলেটিভ শোকের প্রতিরূপ রচনায় মধুসূদন তার শিখর প্রদেশ।
অনাদরে। মধুসূদন দত্তের মূর্তি।
পয়ারের কমলবনে বাংলা কবিতা যখন এলিয়ে পড়েছে নিরন্তর মধুপানে, তখন কী যে দৈবী নির্দেশে (মতান্তরে মিলটনের বদান্যতায়) মধুসূদন কালাপাহাড়ের মতো অমিত্রাক্ষরকে প্রবেশাধিকার দিলেন! যিনি বাংলা কবিতায় মধুসূদনের প্রকৃত ধার্মিক উত্তরসূরি সেই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এটুকু খেয়াল করেছিলেন, কিন্তু বুঝতে পারেননি যে মধুসূদনের ভ্রষ্টাচার প্রায় ‘ভার্টিকাল ইনভেশন’ পিকাসো সম্বন্ধে যে অভিধাটি ব্যবহার করেন জন বার্জার। যেমন পিকাসো ‘দেমোয়াজেল দাভিগনোঁ’ পটে সমতলীয় পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহার করে চিত্রকলাকে সমূহ পতনের হাত থেকে উদ্ধার করেন, তেমন ভাবেই মধুসূদন কবিয়ালের লাস্য থেকে আমাদের কবিতাকে পথ খুঁজে দেন পরিত্রাণের জ্যামিতিক কাঠিন্য সঞ্চার করে। ফরাসি শিল্পবোধও পিকাসোকে আরূঢ় ভনিতা ভেবেছিল, যেমন সহজীবীরা ভেবেছিলেন মাইকেলকে।
হয়তো মধুসূদনের মাদ্রাজের অভিজ্ঞতাই তাঁকে দ্রাবিড় অন্তর্ঘাতনায় প্ররোচিত করে। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের মনোযোগ রাবণ ও ইন্দ্রজিৎ, রাম ও লক্ষ্মণ, বিভীষণ প্রমুখ পুরুষ চরিত্রদের প্রতিই নিবদ্ধ থেকেছে। মধুসূদন তো ইতিহাসের নির্দেশে ‘ইমাজিনারি কমিউনিটি’র আত্মকথাই লিখছিলেন। রূপকের আড়াল থেকে, উপাখ্যানের স্তবকে স্তবকে হোমার বা বাল্মীকি, এমনকি কৃত্তিবাসকে ছাড়িয়ে আমাদের চেতনার বিন্যাস পাল্টাতে থাকে। কিন্তু যা আমরা খেয়াল করি না, তা হল, এই কাব্যের চতুর্থ সর্গ আসমুদ্রহিমাচলের পক্ষেই প্রথম অন্তঃপুর যাত্রা। অশোকবন এমন এক মনঃপরিসর, যা শাসকের অজানা, যা অন্দরমহলের কারুবাসনা, যা ভার্নাকুলার’কে পৃথক করে দেয় নিয়মতান্ত্রিক উচ্চারণের থেকে।
‘ছিনু মোরা, সুলোচনে। গোদাবরী তীরে,
কপোত কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষ-চূড়ে
বাঁধি নীড়, থাকে সুখে,’
অপুর সংসারে অপূর্ব ও অপর্ণাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, আমাদের দাম্পত্যপ্রেমের সূচনা তো মধুসূদনেই। একটু ধৈর্যশীল হলে বোঝা যায়, তাঁর নারীরা মধ্য উনিশ শতকেই পুরুষের সাহায্য ব্যতিরেকেই কী জীবন্ত! সমুদ্রতীরের রণরক্তসফলতা কী ভাবে স্তব্ধ নির্বাক পড়ে থাকে অশোকবনে, যেখানে সীতা: ‘একটি কুসুম মাত্র অরণ্যে যেমতি।’

বিহারীলাল চক্রবর্তীর মতো সামান্য রোমান্টিক নন, রবীন্দ্রনাথের উত্থানের পক্ষে আবশ্যিক ছিল মধুসূদনের প্রতিকূলাচার, তা সুধীন্দ্রনাথ প্রথম উল্লেখ করেন। কিন্তু সংস্কৃতিবিদ্যা যাকে অধিকতর জরুরি ভাবে, তা হল মেঘনাদবধ কাব্যের বিচিত্র গতি। তার চিন্তন ও ভাষাবিস্তার কাব্যের সীমা ছাড়িয়ে উপচে পড়ে বাইরের ইতিহাসে। আমাদের আধুনিকতাকে প্রাদেশিকতার দায় থেকে মুক্তি দেওয়ার পথিকৃৎ মধুসূদন দত্তই। আমাদের নারী-চেতনার ইতিহাস লিখিত হলে মধুসূদনের শ্রমের পারিপাট্য জ্বলজ্বল করবে তাতে। বঙ্গভাষী সমাজ তাঁর নানা পঙ্ক্তি স্রষ্টার নাম না জেনেই প্রবচনের মতো ব্যবহার করে: বায়ুতে, জলে, অরণ্যের আন্দোলনে জাতির শরীরে বিলীন হয়ে যাওয়াই তো কবির চরম সার্থকতা। ‘আত্মবিলাপ’-এর থেকে জরুরি আত্মার বিবরণী আর কোন বাঙালি কবি লিখেছেন?
পার্ক স্ট্রিটের সমাধিভূমিতে রাত্রি নামে। রুশ ঔপন্যাসিক দস্তয়েভস্কি এক বার স্বদেশীয় কবি পুশকিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পুশকিন তাঁর কবরে কিছু গোপনীয়তা সংরক্ষিত রেখেছেন। আমাদের দায়িত্ব তা উদ্ধার করা।’
হে পাঠক, এ বার বোধ হয় অমরতার সমায়তন এই কাব্যগ্রন্থের জন্য আপনারও পুনর্বিবেচনার পালা। মেঘনাদবধ কাব্য, কেননা তা নেহাত কাব্য নয়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.