|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
চোর |
নন্দিতা বাগচী |
আজও সেই এক ব্যাপার। দু’স্লাইস ব্রেড, একটা ডিম, একটা আপেল, আর কিছু স্ন্যাক্স মিসিং ফ্রিজ থেকে। কর্নফ্লেক্সের বাক্সটায় লাল কালির দাগ দিয়ে রেখেছিল সুখ। দুধের ক্যানটাতেও। সে দুটোরও লেভেল নেমে গিয়েছে।
আজ দু’দিন ধরে ফ্রিজ থেকে, কাবার্ড থেকে, খাবার চুরি যাচ্ছে সুখবিন্দরের।
গত সোমবারে গ্রোসারিতে গিয়েছিল সুখ। সোমবারে ওর কাজের চাপ কম থাকে। তাই ওই দিনই সারা সপ্তাহের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনে। বারোটা ডিম, ছ’টা কলা, ছ’টা আপেল প্রত্যেক সোমবারেই আনে। এ ছাড়া আসে দুধ, কর্নফ্লেক্স, ব্রেড, বিস্কিট। মাসে এক বার সাবান-শ্যাম্পু-ডিটারজেন্ট।
বুধবার সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে সুখ দেখল, দশটা ডিম রয়েছে। অথচ সোমবারেই বারোটা ডিম কিনে এনেছে ও। মঙ্গলবার সকালে একটা খেয়েছে শুধু। সোমবারে তো ব্রেকফাস্টের পরেই গ্রোসারিতে গিয়েছিল। তবে আর একটা ডিম গেল কোথায়? শুধু ডিম নয়, একটা কলাও গুনতিতে কম। কয়েকটা বিস্কিটও যেন মিসিং। সন্দেহটা তখনই দানা বেঁধেছিল ওর মনে। কেমন যেন একটা ভৌতিক ব্যাপার মনে হচ্ছিল। গত কাল অর্থাৎ বৃহস্পতিবারে যখন দেখল মাত্র আটটা ডিম রয়েছে, তখনই কর্নফ্লেক্সের বাক্সে আর দুধের ক্যানে লাল মার্কার দিয়ে দাগ দিয়ে রেখেছিল ও।
তবে একটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো। কলা আর আপেল অলটারনেট ডে-তে একটা করে গায়েব হচ্ছে। এক দিন কলা তো অন্য দিন আপেল। যে-ই চুরি করুক, খুব বুদ্ধিমান বলতে হবে। ছ’টা জিনিসের ভেতরে রোজ একটা করে সরালে ধরা পড়ে যেত।
প্রথমে সুখ ভেবেছিল নিশ্চয়ই ইঁদুরের কর্ম এটা। কিন্তু আর যা-ই হোক, ওরা তো অঙ্ক জানে না। এমন হিসেব করে খাবার জিনিস সরাচ্ছে কে? দেশে হলে নয়তো ভাবা যেত কাজের লোকের হাত সাফাই। কিন্তু এ দেশে আর সে সব কোথায়? সুখ নিজেই তো এক জন কাজের লোক এখানে।
সুখবিন্দরের ফুফাজির বন্ধু বিজয় খন্না এই রেস্তোরাঁটা কিনে নেওয়ার পর থেকে সুখবিন্দরের সুখ আর ধরে না। ফুফাজির সুপারিশে সুখবিন্দর চাকরি পেল। হসপিটালিটি ট্রেনিং নিল। ইমিগ্রেশনের লাল কার্পেট ডিঙিয়ে প্রবেশ করল আমেরিকায়। যে সে জায়গায় নয়, সোজা চলে এল লাস ভেগাসে। এখানকার ‘ব্রাস হান্ডি’ রেস্তোরাঁর ওয়েটার সে। তবে কোনও কাজই তো এ দেশে ফেলনা নয়। তাই কেউ নাক সিঁটকে বলবেও না, ‘ও তো রেস্তোরাঁর বয়!’ সত্যি কথা বলতে, সুখ এখন এখানকার মেয়েদের হার্ট-থ্রব।
পাকা গমের মতো রংটা খেতিবাড়ি করে করে চমৎকার ট্যানড হয়েছে ওর। ছ ’ফুট চার ইঞ্চি লম্বা শরীর। ডেরা বাবা নানকের আখড়ায় কুস্তি লড়ে আর ডাম্বেল তুলে পাকানো হাতের গুলি, চওড়া কাঁধ, চ্যাপ্টা পেট। চমৎকার ভাবে ছাঁটা চাপা দাড়ি। কাঁধ ছাপানো ঝাঁকড়া চুলে পনিটেল। মাঝখানে সিঁথি কেটে লাল রিবন দিয়ে পনিটেল বাঁধতে ওর সেক্স অ্যাপিল বেড়ে গিয়েছে আরও একটু। নাক-চোখ-ঠোঁটেও আর্য রক্তের ছোঁয়া। কালো ট্রাউজার, সাদা ফুলহাতা শার্ট, কালো ওয়েস্ট কোট, লাল টাই আর গোড়ালি লম্বা কালো এপ্রন পরে ও যখন মেনু কার্ড হাতে নিয়ে এসে বলে, মে আই হেল্প ইউ মিস? মার্কিনি মেয়েরা মেনু দেখবে না ওকে দেখবে ভুলে যায়।
শুক্রবার ডিউটিতে গিয়েই ডেভিডকে কথাটা বলল সুখ।
হেই ডেভিড, ইউ নো দেয়ার ইজ আ গোস্ট ইন মাই অ্যাপার্টমেন্ট...
ডেভিড ওয়াইন গ্লাসগুলোকে শ্যামোয়ার টুকরো দিয়ে চকচকে করে মুছে মাথার ওপরের র্যাকে ঝুলিয়ে রাখছিল। বাদুড়ের মতো উল্টো করে।
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল সে, ‘ও জিঁয়্যান, আর ইউ কিডিং?’
কোঁকড়ানো চুলে ঠাসা মাথাটা বার কাউন্টারের ওপরে ঠুকতে লাগল কৃষ্ণকায় ডেভিড। ফার্নান্ডো চিকেন ব্রেস্ট থেকে টিক্কা কাটছিল মিসেস খন্নার দেওয়া স্যাম্পল দেখে। খিকখিক করে হেসে উঠে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইজ ইট আ গোস্ট অর ইয়োর ‘চিকা বোনিটা’’ (স্প্যানিশ ভাষায় স্বপ্নসুন্দরী)?
‘চিকা বোনিটা’ শব্দ দু’টি উচ্চারণের সময়ে দু’হাতের তর্জনী দিয়ে শূন্যে একটা ‘আওয়ার গ্লাস’ আঁকল সে। হো হো করে হেসে উঠল ডেভিড আর সুলেমান। ডেভিড বলল, ‘ইফ ইট ইজ আ ফিমেল গোস্ট, আই উড লাইক টু মিট হার।’
ওদের কথার মাঝখানে মিসেস খন্না এসে ঢুকলেন। হাসিঠাট্টা থামিয়ে কাজে মন দিল ওরা।
‘ব্রাস হান্ডি’র বার-টেন্ডার ডেভিড। লাঞ্চ আর ডিনারের সময়ে কেতাদুরস্ত হয়ে সফেন বিয়ার ঢালে সযত্নে। মাগ না উপচিয়ে। নানা রকম ভেল্কি দেখিয়ে, নেচে-কুঁদে ককটেল শেকারে বিভিন্ন মদ মিশিয়ে ককটেল তৈরি করে। কারুকাজ করা ছোট্ট পেতলের বালতিতে বরফকুচি ভরে আলগোছে শুইয়ে দেয় শ্যাম্পেনের বোতল। অন্য সময়ে অতিথিদের এঁটো গ্লাসগুলো ডিশওয়াশারে ধুয়ে শ্যামোয়ার টুকরো দিয়ে ঘষে চকচকে করে।
যখন রেস্তোরাঁতে ‘ওপেন’ বোর্ডটা ঝোলানো থাকে, সুখবিন্দর আর ফার্নান্ডোও ইউনিফর্ম পরে খাবারের অর্ডার নিয়ে সার্ভ করে। অন্য সময়ে মাংস কাটে, আনাজ কাটে, টেবিল পরিষ্কার করে, বাসনপত্র ধোয়। তবে রান্নাটা ওদের করতে হয় না, সুলেমানই কিচেন সামলায়। মিস্টার আর মিসেস খন্না সাহায্য করেন। রেস্তোরাঁ যখন খোলা থাকে তখন মিস্টার খন্না হেড ওয়েটার আর মিসেস খন্না ক্যাশিয়ার।
শুক্রবার সন্ধে থেকেই ভিড় শুরু হয়ে যায়। আমেরিকা তো বটেই, সারা পৃথিবী থেকে ভ্রমণার্থী আসেন লাস ভেগাসে। এক এক হোটেলের এক এক রকম থিম। কেউ যান ‘বেলাজিয়ো’ আর ‘ভেনেশিয়ান’ হোটেলের ইতালিয়ান কারুকাজ দেখতে, তো কেউ যান ‘লাক্সর’ হোটেলের পিরামিড আর ইজিপশিয়ান ঐতিহ্য দেখতে। কেউ ‘এম-জি-এম গ্র্যান্ড’ হোটেলের ক্যাসিনোতে গিয়ে জুয়া খেলেন, কেউ ‘ম্যান্ডলে বে’ হোটেলের নাইট ক্লাবে গিয়ে মদ খেয়ে মাতাল হন। হইহই রইরই ব্যাপার।
আমোদ ছাড়াও আছে প্রমোদ। হোটেলে হোটেলে লেট নাইট ন্যুড শো। রাতভোর দেহব্যবসা। ঝাঁ-চকচকে ম্যাগাজিনে বিবস্ত্র মানুষের ছবি আর অলিতেগলিতে নারী-মাংসের হদিশ নিয়ে দালালদের ফিসফিসানি। অবশ্য পুরুষেরাও পিছিয়ে নেই। দেহব্যবসায় তাঁদেরও সমানাধিকার এখানে। যেমন অধিকার সমকামীদের। লেসবিয়ান বা গে সকলেই স্বাগত।
তবে সাদা চামড়ার লোকগুলো যে হোটেলে গিয়েই হইহুল্লোড় করুক, তাদের রসনাটি লকলক করে ইন্ডিয়ান কারি-র জন্য। বিরিয়ানি-নান-রেশমি কাবাব-চিকেন টিক্কা মাসালা, মিরচি গোস্ত সব নাম মুখস্থ তাদের। গোটা তিনেক বড় ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ আছে লাস ভেগাসের অভিজাত রাস্তা ‘দ্য স্ট্রিপ’-এ। তবে যাঁরা সস্তা অথচ অথেনটিক ভারতীয় খাবার খেতে চান, তাঁরা চলে দাঁও মেরেছেন আজ মিস্টার খন্না। খুব ভাল মুডে আছেন। অতিথিরা চলে যাওয়ার পর প্যাকিং আপ চলছে। ভ্যানের ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে ক্রকারি-কাটলারি-গ্লাস ইত্যাদি। সুখকে ডেকে মিস্টার খন্না বললেন, তেরা ঘর তো পাসই হ্যায়, তু ঘর চলা যা। আর সবাইকে বললেন, ‘ব্রাস হান্ডি’ ওন্ট ওপেন টু নাইট, ইট ইজ আ হলিডে।
সন্ধের মুখেই বাড়ি পৌঁছে গেল সুখ। দারুণ আনন্দ হচ্ছে ওর। গরম জল দিয়ে স্নান করে একটা লম্বা ঘুম দেবে আজ। তার পর বেশি রাতের দিকে কোনও হোটেলের নাইট ক্লাবে চলে যাবে। এক জন মেয়ে বন্ধুকেও ডেকে নিতে পারে। দরজার চাবি খুলতে খুলতে সেলফোনের কন্ট্যাক্টগুলো স্ক্রোল করতে থাকে সুখ।
ঘরে ঢুকেই একটা ঝিম ধরানো আবেশ। মনে হল যেন ভুল করে অন্য কারও বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। নাকি কোনও মায়া কাননে? কুলকুল করে নির্ঝরের শব্দ ভেসে আসছে। সঙ্গে একটা মধুর গুনগুনানি। সুগন্ধী ফুলগুলোও যেন একসঙ্গে ফুটে উঠেছে সব। ঘরের ভেতর আলো-আঁধারি। চোখ বন্ধ করে ফেলে সুখ। বুক ভরে ঘ্রাণ নেয়। সম্মোহিতের মতো চলতে থাকে সে সুরভিকে, সে সুরলহরীকে অনুসরণ করে। একটা আধ ভেজানো দরজায় গিয়ে ধাক্কা খায়। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখে ওর স্নানঘরের ভেতরে এক মৎস্যকন্যা জলকেলি করছে নগ্নিকা।
সুখকে দেখে সচকিত হয় সে নারী। বাথটাব থেকে নেমে আসে। তার সোনালি চুল, নীল চোখ, আর মোমের মতো শরীর আবিষ্ট করে ফেলে সুখবিন্দরকে। হঠাৎ যেন সংবিৎ ফেরে মেয়েটির। তোয়ালে দিয়ে শরীর ঢেকে ছুটে পালায় সে। নিঃশব্দে গিয়ে ঢুকে পড়ে সুখের বিছানার পাশের ওয়ার্ডরোবটায়। হ্যাঙারে ঝোলানো বড় বড় শার্ট-প্যান্ট-কোটের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে নিজেকে।
হতচকিত হয়ে বসে থাকে সুখ। ঘণ্টাখানেক বাদে ওয়ার্ডরোবটার সামনে গিয়ে হাঁক দেয় ও, কাম আউট।
কিন্তু নিশব্দ, নিষ্কম্প অন্দর মহল। যেন কোনও হরিণী সুরক্ষার তাগিদে ঘন জঙ্গলের মাঝে আত্মগোপন করেছে।
আবারও চেঁচায় সুখ, আই সে কাম আউট।
তবুও কোনও সাড়াশব্দ নেই। যেন উধাও হয়ে গিয়েছে সে। চোখ দুটো রগড়ায় সুখ। তবে কি কোনও অলীক দৃশ্য দেখল ও? মায়া? ইলিউশন?
এ বারে সে নিজেই ঢুকে পড়ে ওয়ার্ডরোবটার ভেতরে। হ্যাঙারগুলো সরিয়ে দেখে এক পাশের দেওয়াল সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। তার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। খসে পড়ে মেয়েটার বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে থাকা তোয়ালেটা।
তিরতির করে কাঁপছে মেয়েটা। যেন কোনও মাংসাশী জন্তু এক্ষুনি লাফিয়ে পড়বে ওর ওপরে।
বজ্রগম্ভীর স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে সুখ, হাউ ডিড ইউ কাম ইন?
ভীতমুখে আঙুল তুলে বাথরুমের জানলাটা দেখায় সে। সুখের মনে পড়ে গত সোমবারে গ্রোসারিতে যাওয়ার আগে ওই ফায়ার এসকেপের সিঁড়ির জানলাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল ও। নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা স্মরণ করে চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে ওর। দাঁত কিড়মিড় করে প্রশ্ন করে, কানচইউ স্পিক?
মেয়েটি চোখ নামিয়ে বলে, নো ইংলিশ।
হোয়্যার ইজ ইয়োর হোম?
প্রাগ। চেকোশ্লোভাকিয়া।
হাউ ডিড ইউ কাম টু ইউএসএ? ডু ইউ হ্যাভ এনি আই ডি?
মেয়েটি একটি একটি শব্দে জবাব দেয়। কোনও বাক্য গঠন করতে পারে না। তবে তার শব্দগুলো সূত্র জোগায় সুখবিন্দরকে। প্রাগ-এজেন্ট-হিউম্যান ট্র্যাফিকিং-আমেরিকা-লাস ভেগাস-প্রস্টিটিউশন-এসকেপ শব্দগুলোকে গেঁথে ফেলে সুখ। একটা নিটোল কাহিনি ভেসে ওঠে ওর চোখের সামনে। বেশ্যাবৃত্তি পরিত্যাগ করে পালিয়ে এসেছে পাচার হওয়া চেক মেয়েটি।
কিন্তু এই নীলনয়না-স্বর্ণকেশী-মোমের পুতুলটিকে নিয়ে কী করবে এখন সুখ? পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবে? এই পরীর মতো সুন্দর মেয়েটির গল্প কি এমন একটি কঠোর উপসংহার দাবি করে? সুখবিন্দরের মনে হয়, ও থাক না এই ঘরটিতেই লুকিয়ে, যেমন আছে গত এক সপ্তাহ ধরে। পরীদের গলায় কি কোনও আই ডি কার্ড ঝোলানো থাকে?
অপহরণ চলছে। এক কুশলী তস্করী তার চৌর্যবৃত্তি চালু রেখেছে। এখন টানাটানি চলছে সুখবিন্দরের চিত্তটি নিয়ে।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|