রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
এলেম নতুন দেশে
সি লায়নের হারেমে
আমাকে টেনে সরিয়ে দিয়ে ধমকে উঠলেন জেইলিন, ‘বলেছিলাম না কাছাকাছি যাবে না? ও তোমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করছে।’ আসলে চোখের সামনে, বালির ওপরে সার সার সি-লায়ন শুয়ে আছে দেখে ক্রমশ বিরল হতে থাকা ওই প্রাণীদের ক্যামেরাবন্দি করার লোভ সামলাতে পারিনি। বালির স্তূপের ওপর থেকে দ্রুত নেমে এসেছিলাম সমুদ্রতটে। আচমকাই ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে বালির মধ্য থেকে রীতিমত ধেয়ে এল এক জন। খোলা মুখে বিশাল দাঁত দেখা যাচ্ছে। পড়ি কী মরি করে দৌড়তে গিয়ে ভারসাম্য হারালাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে টেনে ধরলেন জেইলিন গুডি। ভাগ্যিস তিনি কাছেই ছিলেন। না হলে বিদেশ-বিভুঁইয়ে শেষ পর্যন্ত সিন্ধুঘোটকের এক জাতভাইয়ের হাতে নাস্তানাবুদ হতে হত। দাঁতে চামড়া ফালাফালা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তো ছিলই, বিশাল ওজনের (প্রায় ৩০০ কেজি) পুরুষ প্রাণীটার তলায় চাপা পড়লে দম বন্ধ হয়ে যাওয়াও আশ্চর্য ছিল না। আমার ওই অভিজ্ঞতার দিনকয়েকের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত পপ গায়িকা শাকিরা একই ভাবে ওদের সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে। শাকিরার পায়ে দাঁত প্রায় বসিয়েই দিয়েছিল একটি সি-লায়ন। তাঁকে শেষ মুহূর্তে বাঁচিয়ে দেন ভাই। আমায় যেমন বাঁচিয়েছেন জেইলিন।
সি-লায়ন আসলে এক প্রজাতির সিল। যে সব সিলের কান রয়েছে তাদেরই সি-লায়ন বলে। কিন্তু আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবার কারণ? দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারু দ্বীপের প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের অন্যতম কর্তা জেইলিনের ব্যাখ্যা, ‘ওরা সামুদ্রিক প্রাণী। তাই সমুদ্রের জলের নীচের পরিবেশের সঙ্গে ওদের চোখ সয়ে গিয়েছে। ডাঙায় ওদের দৃষ্টিশক্তি খুবই ক্ষীণ। তোমার অবয়বটা ওরা ঠাহর করতে পারছে না। একটা কালো ছায়ার মতো মনে হচ্ছে। মনে করছে বোধ হয় আর একটা পুরুষ আসছে।’
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া পর্যটনের কেন্ট রোজিটার আমার হাত ধরে ফের টেনে তুললেন বালির স্তূপের ওপর। আঙুল তুলে দেখালেন একটি ঝোপের দিকে। দেখলাম, এক টান টান হয়ে শুয়ে থাকা মা সি-লায়নের দুধ খাচ্ছে একটা শাবক। মা-কে পাহারায় রয়েছে আরও কয়েকটি বিভিন্ন আকারের সি-লায়ন। জেইলিনের ব্যাখ্যা, ‘ছোট্ট শাবকদের পুরুষরা সহ্য করতে পারে না। কারণ, যত দিন শিশু মায়ের স্তন্যপান করে, তত দিন মা আর প্রজননক্ষম থাকে না। বাচ্চা মরে গেলে ফের মা প্রজননক্ষম হবে। তাই পুরুষ প্রাণীরা মেরে ফেলতে চায় শিশুদের। পুরুষের হাত থেকে বাঁচতে মা বাচ্চাকে নিয়ে চলে এসেছে এতটা ওপরে, কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই।’ বাচ্চারা কিছুটা স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত মা সি-লায়ন তাদের আগলে রাখে। আশপাশের অন্য সি-লায়নগুলি মনে হচ্ছে ওই মায়েরই বিভিন্ন সময়ের বাচ্চা। পুরুষ সি-লায়ন তার প্রায় ৩০০ কেজির ভারী শরীর নিয়ে যে খাড়া বালির স্তূপের ওপরে ওঠার ঝুঁকি নেবে না, সেটা মা ও তার মেয়েরা জানে।
বালিতে এক এক জায়গায় শুয়ে রয়েছে চার-পাঁচটি সি-লায়ন। তাদের আড়াআড়ি ভাবে আড়াল করে রেখেছে একটা করে বিশাল চেহারার পুরুষ। জেইলিন বলছিলেন, ‘এগুলি এক-একটা পুরুষ সি-লায়নের হারেম। এখানে যে সব স্ত্রী প্রাণী রয়েছে, তাদের সঙ্গে ওই পুরুষেরই একমাত্র সঙ্গমের অধিকার রয়েছে। বাকি পুরুষদের এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ।’ অল্পবয়সি একটা একাকী পুরুষ সি-লায়ন সঙ্গী খুঁজে বেড়াচ্ছিল। নিজের ফ্লিপার দুটো দিয়ে সে ঢুঁ মারছিল এক-একটা হারেমে। সেই হারেমের মালিকের অসতর্ক মুহূর্ত খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু প্রতি জায়গাতেই প্রত্যাখ্যাত হল সে। এক জায়গায় দেখলাম দুই হারেমের দুই মালিক তাকে একযোগে বাধা দিচ্ছে। এক সময়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে বেচারা সবার আড়ালে গিয়ে বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে রইল।
আর বালিতে যখন তারা মুখ গুঁজে পড়ে থাকে, তখন মনে হয় ওদের চেয়ে নিরীহ প্রাণী বোধ হয় কিছু আর নেই। আর এই ভুলটাই আমি করেছিলাম।
দূর থেকে মনে হচ্ছিল বোধ হয় বরফের চাদরের ওপর শুয়ে রয়েছে প্রাণীগুলি। সূর্যের আলো যে ভাবে ঠিকরে বেরোচ্ছিল, তাতে এই ভ্রম হওয়াটা স্বাভাবিক। আর বইতে, বিভিন্ন ডকুমেন্টারি বা সিনেমায় সি-লায়ন বা সিলের সঙ্গে আমাদের যা পরিচয়, তাতে ওই প্রাণীরা যে মেরু প্রদেশ, কিংবা ঠান্ডা এলাকার বাসিন্দা এমনই একটা ধারণা জন্মেছিল। ভুল ভেঙে গেল দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এই দ্বীপভূমিতে এসে। কড়া রোদে চাঁদি ফেটে যাচ্ছে, বন দফতরের আধিকারিকেরা বার বার চামড়ায় সানস্ক্রিন ঘষে নেওয়ার জন্য ঘোষণা করছেন, আর ওই প্রচণ্ড গরমে বালির ওপর দিব্যি এলিয়ে পড়ে আছে সি-লায়নগুলি। এরা দিনের বেলার বেশির ভাগ সময়টাই কাটায় সমুদ্র তটে।

সিলের আঁতুড়ঘরে
তবে সি-লায়নদেরই জাতভাই নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয় ফার সিলেরা কিন্তু মোটেই রোদ পছন্দ করে না। সূর্যদেব উঁকি দিলেই ওরা লুকিয়ে পড়ে পাথরের খাঁজে কিংবা ডুব দেয় জলে। এই দুই প্রজাতির সিলের শরীর মোড়া নরম তুলতুলে লোমশ চামড়ায়। অস্ট্রেলিয় প্রজাতির গায়ের রং কিছুটা ফ্যাকাশে। আকারে কিছুটা ছোট নিউজিল্যান্ড সিলের গায়ের পোশাকের রং কালো।
এটা ক্যাঙারু দ্বীপের অন্য দিক। সমুদ্র তট এখানে পাথুরে। প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে ডুবো পাহাড়ের ছড়াছড়ি এই এলাকায়। এখানে সেখানে মাথা তুলেছে পাথর। কোনওটা খাড়া, কোনওটা চাতালের মতো সমতল। সেখান থেকে পিছলে সোজা পড়া যায় সমুদ্রের জলে। এই জায়গা সিলদের অতি প্রিয়। দুটি চাতাল যেখানে একে অপরের সঙ্গে মিশেছে, সেখানে তৈরি হয়েছে খাঁজ। আর সেই খাঁজেই বাচ্চার জন্ম দেয় মা সিল। বাবা সিল তার বড় শরীর নিয়ে ওই খাঁজে ঢুকতে পারে না। শিশু সিল তার মায়ের উপস্থিতি গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারে। মা কাছে এলে সে খাঁজ ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
হঠাৎ ছয় ফুট পাঁচ ইঞ্চির কেন্ট রোজিটার বাচ্চা ছেলের মতো লাফিয়ে উঠলেন, ‘ওই যে ওখানে, পাথরের খাঁজটার পাশে।’ যা দেখলাম, অবাক হওয়ারই মতো। প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাথরের চাতালে। আর সেই চাতালের একটু ওপরে বড়সড় একটা ইঁদুরের বাচ্চার মতো মাঝেমধ্যে কেঁপে উঠছে, ওটা কী? গায়ের রংটা কালো। মাথাটা নাড়াচ্ছে। ওটা আসলে একটা সিলের বাচ্চা। কয়েক মিনিট আগে জন্মেছে মনে হয়। বাচ্চার জন্ম দিয়েই মা ঝাঁপিয়েছে জলে। মা সিল কিন্তু নিজের দায়িত্ব জানে। এই মুহূর্তে জলে থাকলেও ওর মন বাচ্চাটার দিকেই পড়ে। প্রমাণও পেলাম। এক সময় আমাদের ছায়াটা পড়ল পাথরের চাতালের ওপরে। মুহূর্তে জল থেকে সাঁ করে চাতালে উঠে নিজের সন্তানকে আড়াল করল মা সিল। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নেয়, সাধ্য কার!
এত দিন অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট, ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি আর ডিসকভারি চ্যানেলের দৌলতে সিলের জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরা দেখেছি। কিন্তু একেবারে প্রকৃতিতে সিলকে ডুব-সাঁতার দিয়ে শিকার করতে দেখব, ভাবনার মধ্যে ছিল না। সাঁ করে প্রাণীটা চলে যাচ্ছে জলের তলায়। আর ফিরে আসছে কিছু ক্ষণের মধ্যেই। মাছের ঝাঁককে তাড়া করে চার-পাঁচটা সিল নিয়ে এসেছিল তীরের কাছাকাছি। মুহূর্তে সিলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল মাছের ঝাঁকে। পলকের মধ্যে দেখা গেল ছোট-বড় প্রতিটা সিলের মুখে একটা করে মাছ।
এক জায়গার পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রাকৃতিক একটা খিলানের মতো তৈরি হয়েছে সমুদ্র-সংলগ্ন পাহাড়ে। সেই খিলানের নীচে পৌঁছয় না সমুদ্রের আলো। এই জায়গা সিলেদের কাছে আদর্শ। দেখলাম ছায়া পাথরের ওপর ঘুম লাগাচ্ছে বেশ কয়েকটা সিল। একটার গলায় ক্ষতচিহ্ন। জেইলিন বললেন, ‘বোধ হয় হাঙরে কামড়েছে কিংবা মৎস্যজীবীদের জালে জড়িয়ে গিয়েছিল মাথাটা।’ তাঁর বিশ্লেষণ, সিলের এই দলটা এখানকার নয়। নিরাপত্তার জন্য এখানে আশ্রয় নিয়েছে। আসলে সিল, সি-লায়নদের প্রধান শত্রু তিমি, হাঙর আর মৎস্যজীবীরা। তিমি আর হাঙরদের খাদ্য ওরা। আর মৎস্যজীবীদের জালে জড়িয়ে অনেক সময়েই মারা যায় সিলেরা। প্রশান্ত মহাসাগরের এই অঞ্চলে মৎস্যজীবীদের মাছ ধরা নিষেধ। আর গোটা এলাকায় জলের নীচে প্রবাল প্রাচীর থাকায় তিমি বা হাঙরেরা তিমি বা হাঙরেরা এড়িয়ে যায় এই এলাকা। অথচ, স্কুইড, নানা ধরনের মাছ খাবার এবং নিরাপত্তার জন্য প্রবাল প্রাচীরের আড়ালকে ব্যবহার করে। অর্থাৎ, এক দিকে খাদকের কোনও উৎপাত নেই, অন্য দিকে প্রচুর খাবার মজুত। সমুদ্রতটে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় প্রজননেও কোনও বাধা নেই।

সুলেমান-নেফারতিতির দ্বীপে
ব্রিসবেন নদী থেকে আমাদের ক্যাটামারান সবে প্রশান্ত মহাসাগরে পড়েছে। প্রচণ্ড ঢেউয়ে দোল খেতে শুরু করেছে জলযানটি। ঠিক এই সময় ক্যাপ্টেনের গলা মাইকে গমগম করে উঠল, ‘আমাদের বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখুন। ভেসে যাচ্ছে এক ঝাঁক ডলফিন। ওরা ইন্দো-প্যাসিফিক প্রজাতির ডলফিন।’ ডেকে এসে দেখলাম ক্যাটামারানের পাশে পাশে সার বেঁধে চলেছে ওরা। কখনও ডুবছে, কখনও ভুস করে ভেসে উঠছে। এক, দুই করে পাঁচ পর্যন্ত গোনার পর হঠাৎ উধাও হয়ে গেল দলটা। ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে বছরের এই সময়টায় ওরা এটুকু পথ আমাদের সঙ্গে যায়। সংখ্যায় এক সময় ছিল পাঁচ, এখন বেড়ে হয়েছে আট। বছর চারেক ধরে ওদের দেখছি।’
আমাদের দেশে এর আগে বেশ কয়েকবার ডলফিন বা শুশুক দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। অসমের ব্রহ্মপুত্রে আর ওড়িশার চিলিকা হ্রদে ডলফিন দেখেছি। তবে সেগুলি গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন। আকারে ছোট। গায়ের রং ফ্যাকাশে। অরণ্যদেবের কাহিনিতে যে সুলেমান, নেফারতিতির কথা পড়েছি, তারা চেহারায় অনেক বড়। ক্যাটামারানের পাশে যেগুলিকে দেখলাম, তাদের মতো। ওরা নিশ্চয়ই ওই সুলেমান, নেফারতিতির তুতো ভাই-বোন হবে। গায়ের রং চকলেটের মতো। তাতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। পেটের দিকটা সাদা।
সেই দিনই সন্ধেয় ট্যাঙ্গালুমায় সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম। সমুদ্রের নীল জলকে রাঙিয়ে দিয়ে সবে ডুবেছে সূর্য। এমন সময় শান্ত জলে আলোড়ন। হাঙরের আকৃতির একটা জীব তীরের কাছে পাক খাচ্ছে। জলের ওপর ডিগবাজি খাচ্ছে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বালানো নিষিদ্ধ। জ্বালানো চলবে না তীরের হ্যালোজেন আলোগুলিও। কিন্তু চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওদের। একটা নয়, দুটো নয়, একেবারে আটটা। আর কানে আসছে সাইরেনের মতো তীক্ষ্ন একটা শব্দ। ক্যাপ্টেন বলেছিলেন ডলফিনেরা মুখ দিয়ে নানা রকম শব্দ বার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। পরিবেশ শান্ত থাকলে তা শোনাও যায়। ট্যাঙ্গালুমার সমুদ্রতীরের এই ডলফিনেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছিল ওই শব্দের মাধ্যমেই।
ট্যাঙ্গালুমার লাগোয়া সমুদ্রকে তাদের নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে খুঁজে পেয়েছে সুলেমান, নেফারতিতিরাও। গত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটা ছিল মৎস্যজীবীদের একটা দ্বীপ। তিমির চর্বি থেকে তেল বের করার একটা কারখানাও ছিল এখানে। কিন্তু ষাটের দশকে তৎকালীন কুইন্সল্যান্ড প্রশাসন দ্বীপে মৎস্যচাষ বন্ধ করে দেয়। তুলে নেওয়া হয় চর্বি কারখানাও। এর পরেই পাকাপাকি ভাবে প্রাণী সংরক্ষণের জন্য এই দ্বীপটিকে অধিগ্রহণ করা হয়। শুরু হয়েছিল পাখি সংরক্ষণ দিয়ে। অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কুকাবুরা-র অবাধ বিচরণ এখানে। রয়েছে কর্মোর্যান্ট, পেলিক্যান আর বুশ স্টোন কারলিউ। ওই পাখিরাও জানে এই দ্বীপে কেউ তাদের ক্ষতি করবে না। তাই দিব্যি পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায় ওরা। ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে গেলে ক্যামেরার দিকে নির্ভয়ে তাকিয়ে থাকে কুকাবুরা দম্পতি। কর্মোর্যান্ট ডানা ঝাপটায়। বুশ স্টোন কারলিউ ঝোপের দিকে সরে গিয়ে ফটোগ্রাফারদের মনোরঞ্জন করে।
ট্যাঙ্গালুমার পর্যটন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে চাদ ক্রফ্ট এই দ্বীপ ভ্রমণে আমাদের সঙ্গী ছিলেন। দ্বীপের কাছেই ডুবো পাহাড় রয়েছে অনেকগুলি। বিভিন্ন সময়ে ওই পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ডুবে গিয়েছে বহু জাহাজ। চাদের মন্তব্য, ওই ডুবো পাহাড় তৈরি করেছে এক নতুন ইকো সিস্টেম। ডুব দিয়ে তার স্বাদ পেতে ছুটে আসেন অনেক পর্যটক। শীতকালে এই দ্বীপের কাছ দিয়ে অনেক সময় চলে যায় তিমির ঝাঁক। আর এই জন্যই এক সময়ে এই দ্বীপে তৈরি হয়েছিল চর্বির কারখানা। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এখনও কিন্তু আসে তিমির দল। এখন এই দ্বীপ ওদের কাছে নিরাপদ, বলছিলেন চাদ।

ইকো টুরিজম কারে কয়
বারো আসনের ছোট্ট বিমানটিতে অ্যাডিলেড থেকে এই দ্বীপে আসার পথে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া পর্যটন বিভাগের কেন্ট বলছিলেন, ‘এত দিন ইকো-ট্যুরিজমের কথা শুনেছেন অনেক। এ বার দেখবেন আদতে সেটা কী।’
ক্যাঙারু দ্বীপে আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল সি-লায়ন আর সিল মাছ দেখতে বের হওয়ার সময় কোনও রকম খাবার জিনিস সঙ্গে না নিতে। এমনকী, জলের বোতল, টফি, ক্যাডবেরি, ফল পর্যন্ত নয়। মধ্যবয়সি জেইলিন বাসে ওঠার সময় জানিয়ে দিলেন,‘আমরা চাই না বাইরের কোনও খাবার, জল এই দ্বীপপুঞ্জের স্বাভাবিক ইকোলজিকে দূষিত করে। এই ব্যাপারটায় আমরা খুবই কড়া। যদি কেউ সঙ্গে প্লাস্টিকের প্যাকেট, জলের বোতল বা অন্য কোনও খাবার এনে থাকেন, দয়া করে হোটেলে রেখে আসুন। ধরা পড়লে কিন্তু কড়া জরিমানা হবে। ৫০০ ডলার পর্যন্ত দিতে হতে পারে।’
বাস ব্যাটারিতে চলে বলে কোনও দূষণ ছড়ানোর আশঙ্কা নেই। জেইলিন নিজেই চালক-কাম-গাইড। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এই দ্বীপে কিছু চিংড়ি চাষের প্রকল্প রয়েছে। রয়েছে বড় বড় কয়েকটি পশুপালন কেন্দ্র আর মধু তৈরির একটি কারখানাও। বাকি অংশটা জঙ্গল। সেখানে ক্যাঙারু, কোয়ালারা নিরাপদে ঘুরে বেড়ায়। আর ওই জঙ্গলের মাঝে এক জায়গায় রয়েছে ছোট একটা সংগ্রহশালা। ওই সংগ্রহশালায় নামিয়ে জেইলিন গেলেন খাবারের খোঁজ করতে।
দশ মিনিট পরে ডাক পড়ল। একটা চাতালে কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ ও টেবিলের ওপরে কাগজের প্লেট ও কাঁটা-চামচ সাজিয়ে প্রস্তুত জেইলিন। নিজেই বাক্স থেকে বের করছেন নানা ধরনের স্যালাড, কয়েক ধরনের রুটি, মাখন, চিজ, খোসা ছাড়ানো চিংড়ি মাছ, খোসা ছাড়ানো সেদ্ধ ডিম আর নানা ধরনের ফল। আমরা হাত লাগালাম। কেন্ট বললেন, ‘চিংড়ি মাছ, স্যালাড, সস সব কিন্তু জেইলিন তৈরি করেছেন নিজের বাড়িতে। এমন ভাবে খাবারগুলি নিয়ে আসা হয়েছে, যাতে এর থেকে খুব কমই নষ্ট হয়।’
খাবার যেটুকু বাঁচল, জেইলিন ঢুকিয়ে নিলেন তাঁর বাক্সে। বাস থেকেই বের করে দিলেন জলের বোতল। জল খেয়ে তা আবার রাখতে হল নির্দিষ্ট জায়গায়। বাইরের কোনও জিনিস যাতে সমুদ্রের তীরে এবং জঙ্গলে না পড়ে, সে ব্যাপারে প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে জেইলিন। কেন্টের মন্তব্য, ‘এত পর্যটক বছরভর এখানে আসেন, কোথাও এতটুকু খাবারের টুকরো, জলের বোতল, প্লাস্টিক পাবেন না। এখানে কোনও ঝাড়ুদার, চৌকিদার নেই। জেইলিন আর তাঁর সঙ্গীরাই সব। এটাই আদর্শ ইকো-ট্যুরিজম।’
শুধু ক্যাঙারু দ্বীপ কেন, কুইন্সল্যান্ডের দ্বীপ ট্যাঙ্গালুমাতে গিয়েও কড়া পরিবেশবিধি মেনে চলতে হয়েছে। সন্ধের সময় ডলফিনরা যখন সমুদ্র তীরে এসে জড়ো হয়, তখন জলে নামার আগে ভাল করে হাত-পা ধুয়ে নিতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিকে ধুতে হয় পা, যাতে অজান্তে কোনও জীবাণু জলে না মেশে। সমুদ্রের ধারে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। দ্বীপে প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ। আইন ভাঙলেই তৎপর প্রশাসন। সমুদ্রের ধারে বসে এক পর্যটক সিগারেট খাচ্ছিলেন। দেখলাম পৌঁছে গেল জল-পুলিশ। ওই পর্যটককে গুনে গুনে ৩০০ ডলার জরিমানা দিতে হল। এর পরের বার সিগারেট খেতে দেখলে তাঁকে দ্বীপ থেকে বের করে দেওয়া হবে বলেও সতর্ক করে দেওয়া হল পর্যটকটিকে।
দ্বীপের এখানে ওখানে খোলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে সামুদ্রিক পাখিরা। খাবারের খোঁজে চলে আসছে রিসর্টের ঘরের দরজায়। কিন্তু ঘরে কোনও খাবার নিয়ে যাওয়া বারণ। খাবার যা, তা ডাইনিং হলে বসেই খেতে হবে। চাদ বললেন, ‘আমরা সব সময় সবার ওপরে কিন্তু নজর রাখছি। এখানকার প্রশিক্ষিত কর্মীরা ছাড়া আর কেউই পাখিদের খাবার দিতে পারবেন না। দিলেই কিন্তু নজরদারেরা ঠিক খুঁজে বার করবেন। আর আইনভঙ্গকারীদের জন্য রয়েছে কড়া শাস্তি।’
আমাদের দেশে যাঁরা ইকো-ট্যুরিজম নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন, তাঁরা এক বার কিন্তু ক্যাঙারু আইল্যান্ড বা ট্যাঙ্গালুমা ঘুরে আসতে পারেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.