|
|
|
|
কিন্নরী, উর্বশী, আমি যাচ্ছি, চলে এসো |
তাবড় পশ্চিমী শহরে বাস চলছে, দেখাদেখি কলকাতায়ও নেমে পড়ল বাস। ঘোড়ায় টানা।
কত ধুলোই উড়ল রাজপথে। তার পর, ধুলো থেকে ধোঁয়া। গৌতম বসুমল্লিক |
কলকাতা শহরে প্রথম বাস চলেছিল আজ থেকে প্রায় ১৮২ বছর আগে। সে বাস অবশ্য এখনকার মতো পেট্রল বা ডিজেল-চালিত নয়, সে ছিল ঘোড়ায় টানা বাস। তিন ঘোড়ার ‘bullock drawn bus’ প্রথম চলেছিল ১৮৩০-এর ২২ নভেম্বর, এসপ্ল্যানেড থেকে ব্যারাকপুর। তবে এইটুকুই জানা যায়, সে বাস কত দিন চলেছিল, কারা তার সওয়ার হতেন সে সব ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি। কলকাতায় জনপরিবহনের জন্য ‘মোটর বাস’ চালানো আরম্ভ হয় ১৯২২ নাগাদ, অর্থাৎ, আজ থেকে নব্বই বছর আগে। এই বাস চলার পিছনে একটি কারণ আছে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি রেল চালু হওয়ার পর অন্যান্য পরিবহন মাধ্যমগুলির সামনে একটা প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ আসে, কী করে আরও দ্রুতগামী হওয়া যায়। এই সূত্রেই ১৮৭৩-র ২৪ ফেব্রুয়ারি দু’টি ঘোড়া দিয়ে টানা ট্রামের যাত্রা শুরু হল কলকাতায়। তবে সে ট্রাম ছিল পণ্যবাহী। অচিরে সেটা বন্ধও হয়ে যায়। যাত্রী পরিবহনের জন্য বাণিজ্যিক ভাবে প্রথম ট্রাম চালু হয় ১৮৮০’র ১ নভেম্বর, শিয়ালদহ থেকে বউবাজার হয়ে ডালহৌসি। একে একে চিৎপুর রোড, চৌরঙ্গি, ধর্মতলা স্ট্রিট, স্ট্র্যান্ড রোড, শ্যামবাজার, খিদিরপুর, ওয়েলেসলি ট্রামের মানচিত্রে স্থান করে নেয়। শুরু হয়েছিল ঘোড়া দিয়ে, দেখতে দেখতে বাহন বদলাল। ১৮৮২’তে এল বাষ্পীয় ইঞ্জিন, ১৯০২ থেকে যাত্রা শুরু করল বিদ্যুৎচালিত ট্রামগাড়ি। ১৯০৬ থেকে যাত্রী বহনের জন্য মোটর-চালিত ট্যাক্সিও কলকাতায় চালু হয়েছিল, কিন্তু তার ভাড়া বেশি, তাই সাধারণ যাত্রীর ভরসা বলতে ওই বিশ্বস্ত ট্রামগাড়িই। পণ্য পরিবহনের জন্য তত দিনে এসে গিয়েছে মোটর-চালিত লরি। |
|
বিশ শতকের কুড়ির দশকের গোড়ার দিক থেকেই বিভিন্ন দাবিতে ট্রামকর্মীরা মাঝে মাঝেই ধর্মঘট করতেন। কোনও কোনও সময় তা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উঠত। যে সব কোম্পানির পণ্য পরিবহনের লরি ছিল তারা অনেকে অফিস-বাবুদের সুবিধের জন্য লরির মাথায় চাঁদোয়া টাঙিয়ে তার নীচে লম্বা বেঞ্চি পেতে যাত্রীদের পৌঁছে দিয়ে টাকা রোজগার শুরু করল। এর চমৎকার বিবরণ পাই কলকাতাবিশারদ রাধারমণ মিত্র মশাইয়ের লেখায়। অভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, ‘‘...কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল তাদের, সে সব জায়গায় বাবুরা একে একে জড়ো হতেন, আর তাঁদের উঠিয়ে নিয়ে যেত সেই সব লরী, উঁচু তার পাটাতন, ছেলেছোকরারা লাফিয়ে উঠতো, কিন্তু মধ্যবয়সী যাঁরা, একটু বা মোটা হয়েছেন, ভুঁড়ি হয়ে গেছে বেশী, তাদেরই হতো অসুবিধা। অমন ভারী চেহারা নিয়ে ওঠবার চেষ্টা করতেন, আর ওপর থেকে ২-৩ জন তাঁদের টেনে তোলবার চেষ্টা করতো, এমনকি নীচে থেকে ঠেলতো। মাল বইবার জন্য জন্য যাদের ছিল লরি’র কারবার, তারা পুলিশ কমিশনারের অনুমতি নিয়ে এ এক ব্যবসাই চালু করলো। বাসের মতো টিকিট করলে তারা। লরীর ওপর বেঞ্চি পাতা, একটা কাঠের মই থাকতো, সেটা নামিয়ে দিত যাত্রীদের ওঠা-নামার দরকারে।’’
ওই লরি-বাস থেকেই দেখতে দেখতে এল ‘আসল’ বাস। গোড়ার দিকে তাদের দারুণ সব নাম হত, যেমন ‘মা’, ‘মেনকা’, ‘কিন্নরী’, ‘ঊবর্শী’, ‘পথের বন্ধু’, ‘আমি যাচ্ছি’, ‘চলে এসো’। আবদুস সোভান নামে এক নাগরিক শহরতলি থেকে সার্কুলার রোড (এখন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড) দিয়ে কলকাতার ভিতর পর্যন্ত বাস চালানো শুরু করেন। ১৯২৬ নাগাদ ‘Walford’ কোম্পানির দোতলা বাস আসে কলকাতায়। তবে সেগুলি ছাদওয়ালা নয়, একেবারে খোলা। বৃষ্টি পড়লে ছাতা মাথায় দিয়ে বসতে হত। এদের বাস চলত শ্যামবাজার থেকে কলেজ স্ট্রিট, বৌবাজার, ডালহৌসি হয়ে কালীঘাট। এক সময় তাদের মাথায় ছাদ এল। অনেক কাল সেই দোতলা বাস রমরমিয়ে চলেছে মহানগরী জুড়ে। এক সময় এসেছে ‘আড়াই তলা’ ট্রেলার বাস, কলকাতার নাতি-চওড়া রাস্তায় তারা ঐরাবতের মতো চলাফেরা করত, বেশির ভাগ যাত্রীর মনে হত, পাইলট সাহেব ক-ত দূরে! স্মৃতিটুকু থাক।
এ কালের কলকাতায় বাস অনেক, কিন্তু তাদের তেমন কোনও গল্প নেই। তবু একটা কথা বলে শেষ করি। লোকসান কমাতে ১৯৯২-এর ৪ নভেম্বর থেকে ট্রাম কোম্পানি বাস চালানো আরম্ভ করে। এটাই কিন্তু তাদের প্রথম বাস চালানো নয়। সে কালেও, ‘Walford’ কোম্পানির বাস জনপ্রিয় হওয়ায়, ট্রাম কোম্পানি শ্যামবাজার থেকে আলমবাজার এবং বেলেঘাটা রাসমণি বাজার থেকে ডালহৌসি অবধি বাস চালানো আরম্ভ করল। কিন্তু সুবিধে করতে না পেরে তারা মামলা করল বাস-কোম্পানির বিরুদ্ধে। মামলায় হেরে গিয়ে ওয়ালফোর্ড উঠে গেল বটে, কিন্তু ট্রাম কোম্পানিও বাস-সার্ভিস বন্ধ করে দিল।
ও হ্যাঁ, স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কলকাতায় শুধু ব্যক্তিমালিকানার প্রাইভেট বাসই চলত, ১৯৪৮ থেকে রাজ্য সরকার ‘ক্যালকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন’ গড়ে পাশাপাশি সরকারি বাস-সার্ভিসও চালু করে। |
|
|
|
|
|