|
|
|
|
সাড়ে তিনশো, নট আউট |
সাত পা একসঙ্গে চললে নাকি বন্ধুত্বের জন্ম হয়। তাই বাস আমাদের পরমতম বন্ধু।
প্যারিসে প্রথম ‘বাস’টি চলেছিল ঠিক ৩৫০ বছর আগে। ১৮ মার্চ, ১৬৬২। শিশির রায় |
পথের ধারে তার প্রতীক্ষায় কেটেছে কত যে অন্তহীন মুহূর্ত, উদ্বিগ্ন মিনিট! আজ দেখা মিলবে কি তার? আজও পাব তো অনেক মানুষের ভিড়ে তার চিরচেনা, নিভৃত স্পর্শটুকু! ভাবছেন, কে এই পরানসখা? সে আপনার আপিস-পথের, চেনা রুটের, ভালবাসাটি, ভাল-‘বাস’টি। নিতান্ত বন্ধ-দিন ছাড়া (আজকাল সে দিনেও আছে) যে আপনার বাধ্য, বলিষ্ঠ বাহন, কালো ধোঁয়া আর রাস্তার ধুলো উড়িয়ে যে ঠিক ঠিক হাজির হয় মোড়ের মাথায়। জীবনের অনেকটাই এই বাসের সঙ্গেই তো বসবাস।
এবং জেনে রাখুন, আজ বাদে কালই এই মহাযানটির রাজপথে চলার সাড়ে তিনশো বছর পূর্ণ হচ্ছে। আজকের বাসের পূর্বপুরুষের আত্মপ্রকাশ ১৬৬২ সালের ১৮ মার্চ, প্যারিস শহরে। আর যন্ত্রের পেছনে যন্ত্রীর অমোঘ উপস্থিতি বাসের ‘হয়ে ওঠা’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফরাসি গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ, উদ্ভাবক, লেখক-দার্শনিক ব্লেজ পাস্কাল-এর নাম। পাস্কাল, যাঁর নাম অমর হয়ে আছে বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় চাপ-এর (প্রেশার) এস. আই. এককে, হাইড্রোস্ট্যাটিক্সের ‘পাস্কাল’স ল’-এ, যাঁর নামে আছে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান সম্মাননা, গোটা একটা বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকী রোবের্তো রোসেলিনির বানানো চলচ্চিত্রও।
|
ব্লেজ পাস্কাল |
বছর ঊনচল্লিশের যুবাটি অভিজাত কিছু বন্ধুবান্ধবের মদতে আর রাজা চতুর্দশ লুইয়ের ডিক্রি নিয়ে প্যারিসের রাজপথে চালু করলেন ঘোড়ায় টানা ‘বাস’, আর বাসের ‘রুট’ও। সর্বসাকুল্যে ছিল সাতখানা গাড়ি, প্রতিটায় ধরত ছয় থেকে আট জন প্যাসেঞ্জার। তখন অবশ্য লোকে বলত ‘ক্যারেজ’। এমনিতে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে রইস আদমিরা চড়তেনই, কিন্তু পাস্কালের চালু করা যে ব্যাপারটা সবার মনে ধরেছিল, তা হল নির্দিষ্ট একটি রুটের ধারণা। বেশ তো মজা, অমুকের দোকানের সামনে থেকে তমুক সময়ে গাড়ি ছাড়ল, হ্যাটকোট পরা বাবুবিবিরা উঠলেন, নির্দিষ্ট কিছু পাড়া আর রাস্তা পেরিয়ে (একটা সার্কুলার রুটও ছিল) ফের এসে থামল সেই সূচনাবিন্দুতেই। ঘড়ির কাঁটা ধরে ওঠানামা এক অভিনব আনন্দ। উদ্বোধনী দিনটায় বিশাল এক জমায়েত হয়েছিল, যত না চড়তে, তারও বেশি দেখতে। রাজার আদেশ, এই ঘোড়া-বাসে উঠবে কেবল রাজপরিবারের আর অভিজাত লোকেরা।
সৈন্যদের আর জনতার চড়া বারণ। গাঁ-গঞ্জ থেকে ছুটে আসা মানুষ হাঁ করে দেখছিল, খান আটেক আসন দখলের লোভে মঁসিয়ে-মাদাম ’রা কেমন ঢুঁসোচ্ছেন একে অন্যকে, ঠেলাঠেলিতে ফ্যাশনের দফারফা। রাজা স্বয়ং চড়েছিলেন একা একটা ঘোড়া-বাসে, যার ফরাসি নাম carosses a cinq sous, বাংলা করলে কাছাকাছি দাঁড়ায়, পাঁচ পয়সার গাড়ি। শুরুর মজা মজে আসে অচিরেই, যখন পয়সাওলা ফরাসিবাবুদের নেকনজর উঠে যায় এই গাড়িগুলোর ওপর থেকে, যার ফলে ভাড়াও বেড়ে চলে যায় আয়ত্তের বাইরে। পাস্কাল মারা যান ১৬৬২-তেই, আর পড়ে থাকা গাড়িগুলোর ওপর জমতে থাকে অনাদর আর বিস্মৃতির ধুলো। ১৬৭৫ সালের মধ্যেই লোকে ভুলে যায় ঘোড়া-বাসের কথা। |
|
‘বাস’ শব্দটা এসেছে ‘অমনিবাস’ থেকে। সে-ও এক মজার গল্প। ১৮২৭ সালে ফ্রান্সের নঁন্ত্ (Nantes) শহরে বড্রি নামের এক অবসৃত মিলিটারি অফিসার ব্যবসায়িক প্রয়োজনে একটা বাঁধাধরা সময়ের গাড়ি চালানোর বন্দোবস্ত শুরু করেন। এই গাড়ির একটা জুতসই নাম খুঁজতে গিয়ে তাঁর চোখে পড়ে ‘Omnes’ নামের এক টুপি বিক্রেতার দোকানের সাইনবোর্ড, যেখানে লেখা আছে, ‘ওমনেস ওমনিবাস’, মানে ‘ফর অল’। বড্রি তাঁর গাড়ির নাম পেয়ে গেলেন, L’Omnibus’। বড্রি আর সেই টুপিওয়ালাকে কেউ মনে রাখেনি, রয়ে গেছে ‘অমনিবাস’, আর তারই শব্দছুট ‘বাস’। ‘সব্বাইকার জন্য’ এমন একখান যানের বিকল্প কিছু আর আছে কি?
১৮২০’র দশকের প্যারিসের ঘোড়ায়-টানা অমনিবাস ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় শহরেও। নিউ ইয়র্ক শহরে ১৮২৭-এই দেখতে পাই এই অমনিবাসকে। মালিক অ্যাব্রাহাম ব্রাউয়ার ছিলেন নিউ ইয়র্ক শহরের দমকল বিভাগের অন্যতম প্রাণপুরুষ। স্টেজ কোচের মতো দেখতে এই বাসের ড্রাইভার বসে থাকত সামনের দিকে, একটা উঁচু বেঞ্চিতে। পথচারীরা হাত নাড়লেই থেমে যেত (কলকাতার মতোই), আর কেউ নামতে চাইলে বাসের মধ্যে ঝোলানো একটা চামড়ার স্ট্র্যাপ-এ দিত নাড়া। লম্বা স্ট্র্যাপ-এর অন্য অংশটা বাঁধা থাকত, ও হরি, ড্রাইভারের পায়ের গোড়ালিতে! নিউ ইয়র্ক সহ আমেরিকার অন্যান্য শহরগুলিতে ঘোড়ায় টানা অমনিবাস দেখা যেত ১৯০৫ অবধি, আর লন্ডনে ১৯১৪ পর্যন্তও। ১৮৩০-এর দশকে লন্ডনে প্রথম ‘স্টিম বাস’ চালু করেন স্যর গোল্ডওয়ার্দি গার্নি। ১৮৮২-তে আসে ইলেকট্রিক ট্রলিবাস। চলত মাথার ওপর ঝোলা ইলেকট্রিকের তার ছুঁয়ে ছুঁয়ে, আমাদের ট্রামের মতো। বাস-প্রযুক্তিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে ১৮৯৫ সালে, যখন বাস চলতে থাকে ইন্টারনাল কম্বাশন ইঞ্জিন পেটে পুরে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকটায় সমগ্র পরিবহন ব্যবস্থাই হয়ে পড়ে মোটরাইজড, অমনিবাসও নাম বদলে হয়ে যায় অটোবাস। |
পথ যদি না...। ‘ছোটি সি বাত’ ছবির একটি দৃশ্য। |
কালে কালে কত জল বয়ে গিয়েছে স্যেন-টেমস্-হাডসন নদী দিয়ে, আর প্রযুক্তির উৎকর্ষে এসেছে হাই-ব্রিড ইলেকট্রিক বাস, ফুয়েল-সেল বাস, সি এন জি/ বায়ো-ডিজেল বাস আরও কত কী! এক ছাদের বাস ছাড়াও ঘোড়ায়-টানা ‘ডাবলডেকার’ও এসে গিয়েছে লন্ডনে সেই কবে, ১৮৫০-এর দশকে। মোটরচালিত ডাবলডেকার আসে অনেক পরে, ১৯২৩ সালে, আর বিখ্যাত ‘রুটমাস্টার’ ডাবলডেকার ১৯৫৪ সালে।
দেশকাল, জলহাওয়া, পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতায় বাসের জুড়ি মেলা ভার। যুগে যুগে সে নিজেকে প্রয়োজন মতো পাল্টেছে, বহিরঙ্গে, অন্তরঙ্গেও। এশিয়ার তপ্ত আবহাওয়ায় তার গায়ে লেগেছে এসি মেশিন, উত্তর আমেরিকার পর্বতপথে সে শিরোধার্য করেছে সাইকেল-মাউন্ট। আফ্রিকার ‘মালটা বাস’ আপন খোলনলচে-কলকবজা বদলে নিয়ে নিজেকে করে তুলেছে ‘গ্লোকাল’ এক সংস্কৃতির বাহক। কিউবা উদ্ভাবন করেছে ‘ক্যামেলো’, বা ক্যামেল বাস। আজ ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশে, অনেক শহরে আরও দেখতে পাবেন ‘বিশালাকৃতিক্স’ কিছু ‘বাঞ্চ্ড বাস’, যাদের পোশাকি নাম ‘আর্টিকুলেটেড বাস’। অতি-আগ্রহী পাঠকেরা খোঁজ করতে পারেন ‘বেন্ডি বাস’, ‘বানানা বাস’, ‘স্লিঙ্কি বাস’, ‘ক্যাট বাস’, বা ‘ক্যাটারপিলার বাস’-এরও। বাসেতিহাসের শাখা, বোঝাই যাচ্ছে কতটা পল্লবিত।
জনগণপ্রিয় এ হেন শকটটি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই, স্থান করে নিয়েছে গল্প-কবিতায়-চলচ্চিত্রে। সাদা-কালো যুগের বাংলা সিনেমায় শহর কলকাতার দৃশ্য মানেই তার সগর্ব উপস্থিতি। ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ মনে পড়ে? দিঘার পথে হুডখোলা গাড়িতে চড়ে যেতে যেতে নায়ক দেখতে পান প্রাণোচ্ছল কলেজ পড়ুয়ারা গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে, অবশ্যই একটি বাসে! সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া একটি বাংলা সিনেমায়ও দেখা গিয়েছে কন্ডাকটর আর তার ‘মুন্নি’ নামের বাসটির অযান্ত্রিক ভালবাসা। ১৯৯৪-এর বলিউড কাঁপানো অ্যাকশন ছবি ‘স্পিড’-এর অবিসংবাদিত নায়ক বোমা বাঁধা ওই বাসটিই তো! মেরিলিন মনরো অভিনীত ১৯৫৬-র ছবি ‘বাস স্টপ’-এর কাহিনির অনেকাংশেই আছে সেই আদি-অকৃত্রিম বাস। কিংবা ১৯৬৩-র ‘সামার হলিডে’, টুকটুকে বাসটি যে ছবির এক অনবদ্য চরিত্র।
শুরু করেছিলাম ভনিতার ছলে। এখন আর বলতে বাধা নেই, বাস হয়ে পড়েছে বাঙালি-সংস্কৃতিরও একটা নাছোড়বান্দা অঙ্গ। ছোটবেলার ‘স্কুল বাস’, ‘এক্সকারশন বাস’-এর স্মৃতি, ‘এগজ্যামিনেশন বাস’-এর ভীতি, কৈশোরের ‘পিকনিক বাস’-এ প্রথম দেখা, ভাল-লাগার সুর, ‘ট্যুরিস্ট, ভলভো বাস’-এ ভালবাসার ট্যুর, যৌবনে ‘বরযাত্রী/ কনেযাত্রী বাস’-এর হুল্লোড়, তারুণ্যে ‘ব্রিগেড বাস’-এর চিৎকার, প্রৌঢ়ত্বে ‘তীর্থযাত্রীর বাস’-এর পুণ্যসঞ্চয় বাঙালির সর্বঘটে ‘বাস’ যেন এক অনন্ত কাঁঠালি। শত ঘটনা-দুর্ঘটনার রক্ত-ঘাম-ক্লেদ-কষ্ট বয়ে নিয়ে চলে সে, প্রতিবাদে-প্রতিরোধে পেতে দেয় আপন কাচঘেরা বুক। কত না বদ্ধপরিকর মুষ্টি ধরেছে তার হাতল, কত আশাহীন দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়েছে তার গা। কত অযাচিত, কাঙ্ক্ষিত স্পর্শ তার সর্ব অঙ্গে। সাড়ে তিনশো বছর পার করেও সে, বাস, চলেছে যুগান্তরের দিকে। |
|
|
|
|
|