|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
পেশাদারি দায়িত্বের বাইরে গিয়ে লেখা |
তাপস সিংহ |
Breaking News জঙ্গলমহল, সম্পাদনা: চিত্রদীপ চক্রবর্তী। দীপ প্রকাশন, ১৭৫.০০ |
ঘরের কাছের জঙ্গলমহল গত কয়েক বছরে দেশি-বিদেশি মিডিয়ার এ রকম বিচরণভূমি হয়ে উঠবে, তা কি ভাবা গিয়েছিল?
মোটামুটি ২০০৪ থেকে বেলপাহাড়ি, লালগড় খবরের শিরোনামে। মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টারের (এমসিসি) সঙ্গে জনযুদ্ধ গোষ্ঠী (পিডব্লিউজি) মিশে গিয়ে সিপিআই (মাওবাদী) হওয়ার পর থেকে এই তৎপরতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ‘পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি’র আড়ালে লালগড় যখন মাওবাদীদের কার্যত মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়, সে সময় থেকে প্রায় রোজ লালগড় সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। সঙ্গে শিরোনামে আসে আরও একটি নাম কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি!
নিয়মিত লালগড় ‘কভার’ করা সাংবাদিকদের ‘অন্য জঙ্গলমহল’ নিয়ে লেখার একটি সংকলন Breaking News জঙ্গলমহল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মোড়কে এই সব প্রতিবেদন যথেষ্টই আকর্ষণীয়। রোমহর্ষক প্রতিবেদন লিখতে লিখতে অনেক সাংবাদিকই কখন যে তাঁদের পেশাদারিত্বের মুখোশ সরিয়ে ফেলেছেন, তা কি তাঁরা নিজেরাও জানেন?
দারিদ্র, বঞ্চনা আর চিরকালীন নাগরিক অবহেলায় লালগড় আর জঙ্গলমহল সাধারণ ভাবে থেকে গিয়েছিল চোখের আড়ালেই। মাওবাদী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যবে থেকে জঙ্গলমহলে মিডিয়ার নিয়মিত আনাগোনা শুরু হল, তবে থেকে লালগড়ের ব্যথা-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা সামনে আসতে লাগল। পাশাপাশি ফুটে উঠল মাওবাদী আর যৌথ বাহিনীর রাইফেলের মুখে আতঙ্কিত, অত্যাচারিত লালগড়ের ভিন্ন মুখও! বড় অমানবিক সে মুখ!
সৌগত মুখোপাধ্যায়ের প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে ঝাড়গ্রামের সোনামুখী গ্রামের সেই ছবি। অভিযোগ, যৌথ বাহিনীর একাংশ গ্রামে ঢুকে মহিলাদের অত্যাচার ও ধর্ষণ করেছে। ঝাড়গ্রাম মহকুমা হাসপাতালে ওই মহিলাদের আনা হয়েছিল ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য। সেখানেই এক বিধ্বস্ত যুবকের সঙ্গে আলাপ হয় সৌগতের। তাঁদের সঙ্গেই সেই গ্রামে যান তিনি। কিন্তু মহিলারা প্রথমে মুখ খুলতে রাজি হননি। পরে সেই যুবকের চেষ্টায় চল্লিশোর্ধ্ব এক মহিলা ক্যামেরার সামনে মুখ খোলেন। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর ছেলের বয়সী জওয়ানদের হাতে তাঁর ধর্ষণের কথা জানান। দূরে এক বাড়ির দাওয়ায় বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে সেই যুবকও কাঁদছিলেন। পরে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সৌগত যুবককে প্রশ্ন করেন, ‘ওই মধ্যবয়সী মহিলা কথা না বললে আমার এই স্টোরি দাঁড়াতই না। সকলেই মুখে কুলুপ এঁটে আছেন যেখানে, কী ভাবে কথা বলতে রাজি করালে ওনাকে?” ওই যুবকের চোখে জল, “উনি আমার মা।” সৌগত লিখছেন, ‘আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।... ও চোখের দিকে তাকানোর স্পর্ধা আমার আর কখনও হয়নি।’
আসলে, পেশাদারি দায়িত্বের বাইরেও প্রতিবেদনে ব্যক্তিমানুষের আরও অনেক কিছুর মিশেলই তো থেকে যায়! বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের অভিজ্ঞতা: কলকাতা প্রেস ক্লাবে চার সাংবাদিক বন্ধুর আড্ডার মধ্যেই বিবিসি-র অমিতাভ ভট্টশালীর কাছে ফোন এল কিষেণজির। তাঁর কাছ থেকে ফোন নিলেন বিশ্বজিৎ। ‘তোমরা আড্ডা মারছ? কী খাচ্ছ, চায়ে?’ কিষেণজির এই প্রশ্নে বিশ্বজিতের উত্তর: ‘এত রাতে সাংবাদিকরা আড্ডা মারতে মারতে চা খায় না। যা খাওয়ার তাই খাচ্ছি।’ ‘ও, তা হলে তো নীতিগত বিরোধ আছে। পরে কথা হবে,’ বলে ফোনটা কেটে দিলেন কিষেণজি!
প্রায় প্রত্যেকের লেখাতেই ঘুরে-ফিরে এসেছে ‘মিথ’ হয়ে ওঠা কিষেণজির কথা। তাঁর উচ্চারণ, রসবোধ, অভ্যাস, খবরের বাইরে বেরিয়ে (বইতে অজস্র জায়গায় ‘বেড়িয়ে’) সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপচারিতার প্রসঙ্গ এসেছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ‘সংঘর্ষ’-এ তাঁর মৃত্যু নিয়েও। অন্য দিকে, ‘অতিবাম বন্দুকবাজ’দের সম্পর্কে অতি সরলীকরণও আছে। যেমন, প্রসেনজিৎ বক্সী লিখেছেন, ‘ছত্তীসগঢ় থেকে পশ্চিমবঙ্গ। প্রায় দশ বছর ধরে গোটা কুড়ি অতিবাম বন্দুকবাজের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে, ... আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, শুধুমাত্র দু’টি কারণে এরা ‘বিপ্লবী’ হয়। এক, কোনও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে। অথবা দুই, দু-বেলা খাওয়া পাওয়া যাবে এই নিশ্চয়তা। আদর্শ নামের বস্তুর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। নেতা বা শহুরে তাত্ত্বিকরা সেটাকে আদর্শের মোড়ক দেন মাত্র।’
তা হলে তো মূল ধারার রাজনীতিতে থাকতেই পারতেন অসংখ্য যুবক-যুবতী! তাতে তো জীবন এত অনিশ্চয়তায় ডুবে যেত না!
ভূমিকায় সম্পাদক লিখেছেন, ‘এখানে যাঁরা লিখেছেন, সম্ভবত নিজের পাড়াকেও তাঁরা জঙ্গলমহলের থেকে কম চেনেন।’ অথচ, সেই সংকলনে বছরের পর বছর জঙ্গলমহল চষে ফেলা কিংশুক গুপ্তের প্রতিবেদনের সন্ধান মেলে না!
এ ছাড়া, সবই আছে। গা-ছমছমে প্রতিবেদন, জঙ্গলমহলের গুমরে ওঠা কান্না, ঘাত-প্রতিঘাত। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাগুলো অনেক সময়েই একই রকম লাগে। অথচ, কিষেণজির মৃত্যু-পরবর্তী পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে কোন পথে চলবে জঙ্গলমহল বা এই রাজ্যে মাওবাদী আন্দোলন আবার দানা বাঁধবে কি না, তা নিয়ে সামগ্রিক আলোচনার বিস্তর সুযোগ ছিল এই গ্রন্থে। দিনের শেষে জঙ্গলমহল তাই যেন ‘Breaking News’ হয়েই থেকে গেল! |
|
|
|
|
|