|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
চণ্ডালের চোখে চণ্ডাল-জীবন |
গৌতম রায় |
ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন, মনোরঞ্জন ব্যাপারি। প্রিয়শিল্প প্রকাশন, ২৫০.০০ |
মনোরঞ্জন ব্যাপারি একজন নমঃশূদ্র, অর্থাৎ ‘ছোটলোক’। তাঁর চণ্ডাল জীবন তাঁকে ভদ্রলোকের সমাজ ও ভুবন থেকে, পেশা ও বৃত্তি থেকে, সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতা থেকে নির্বাসিত করেছে।
মনোরঞ্জন ব্যাপারি একজন বাঙালি উদ্বাস্তু। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে শৈশবেই শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে যান, সেখান থেকে রুক্ষ রাঢ় বাংলার শরণার্থী শিবিরে, সেখান থেকে কলকাতার খালপাড়ের ঝুপড়িতে।
তাঁর লেখাপড়া শেখা হয় না, সাবান মেখে চান করা হয় না, এমনকী একটা আস্ত হাফপ্যান্ট পরারও সুযোগ হয় না। হতদরিদ্র, নিঃস্ব, হাভাতে মনোরঞ্জন খুব ছোটবেলা থেকেই অনাহারে অভ্যস্ত হয়ে যায়, কিন্তু অপমানে অভ্যস্ত হতে পারে না। ভদ্রলোকের পোলাপানদের অপমানের জবাব দিতে মারপিটেও হাত পাকিয়ে ফেলে। তার পর একদিন ক্ষুধার ভূগোলে আটকে পড়া পরিবারের একটা পেট বাঁচানোর ‘দায়িত্ববোধ’ থেকে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়।
তার জীবনের অর্ধেক কাটে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, বাকিটা উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনিতে। সর্বত্রই খাটিয়ে নিয়ে পারিশ্রমিক না-দেওয়া মালিকদের খপ্পরে পড়তে হয় কিশোর মনোরঞ্জনকে। প্রায়শ উপকারীর ছদ্মবেশধারী ধর্ষকামী আশ্রয়দাতা বা অন্নদাতার পায়ুমৈথুনের শিকারও হতে হয়। ঘৃণায়, বিবমিষায় তিক্ত তার জীবন তবু ভরসা হারায় না। প্রাণপণে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে, বেঁচে থাকে।
এই বেঁচে থাকাই অন্যান্য উদ্বাস্তু পরিবারের সঙ্গে মনোরঞ্জনকেও দণ্ডকারণ্যের ঊষর পাথুরে প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে ফেলে। বাংলার সজল মাটির জন্য তার প্রাণ কাঁদে। সুন্দরবনে পুনর্বাসনের বামপন্থী প্রতিশ্রুতির ভরসায় অন্য অনেকের মতো সেও লুকিয়ে পালিয়ে আসে কলকাতায়। তার বাবা পৌঁছে যান মরিচঝাঁপিতে। কিন্তু ক্ষমতাসীন বামপন্থী ভদ্রলোকদের কাছে তত দিনে ছোটলোক উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনীতি করার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই পুলিশ ও ক্যাডার লেলিয়ে মরিচঝাঁপি উদ্বাস্তুমুক্ত করা হয়। মনোরঞ্জনের বাবা তাঁর অপুষ্ট, ক্ষুধাজর্জর, রোগজীর্ণ শরীরে পুলিশের লাঠিতে ভাঙা পাঁজর নিয়ে বেশি দিন যুঝতে পারেন না।
মনোরঞ্জন কলকাতার অসংগঠিত ক্ষেত্রের অনিশ্চিত দিনযাপনে অভ্যস্ত হতে থাকে। সত্তরের দশকের রাজনীতির গরম হল্কাও তার গায়ে এসে লাগে। বোমা বাঁধতে শিখে যায়, ছুরি ধরতেও। অন্ধকার জগতের সঙ্গেও পরিচয় ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। বর্ধমানে অ্যাকশনে ডাক পড়ে। বোমার মশলায় বিড়ির আগুন পড়ে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণে সর্বাঙ্গ পুড়ে গেলে ভদ্রলোক কমরেডরা তাকে সে অবস্থাতেই ফেলে পালান। নদীর জলে তার পোড়া দেহটা ভাসিয়ে দিতে গিয়েও নিচু জাতের মুনিষ খাটা সর্বহারারা কিন্তু নিজেদের ঘটিবাটি বেচে শুশ্রূষায় তাকে বাঁচিয়ে তোলে। মনোরঞ্জন কলকাতায় ফেরে। বিনাবিচারের বন্দি হয়ে দু’ বছরের জন্য জেলে চালান হয়ে যায়। এই যুবা বয়স পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিরক্ষর, এ বার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ধুলোমাখা উঠোনে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে শুরু হয় ওর হাতেখড়ি, বর্ণপরিচয়। তার পর চলতে থাকে পড়াশোনা। রাত জেগে, হাতের কাছে যে-বই পায়, তা-ই গোগ্রাসে পড়তে থাকে। সারা জীবন ভাতের খিদে যাকে তাড়া করে ফিরেছে, তার চেয়েও উগ্র, উদগ্র এক খিদে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। প্রথমে জেলের লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে, ছাড়া পাওয়ার পর পাড়ার লাইব্রেরি থেকে। পেশা হয় রিক্শ চালানো, ফাঁকে-ফোকরে বই পড়া। মনোরঞ্জনের সামনে খুলে যায় জ্ঞানের ভুবন, যার অধিকার শুধু ভদ্রলোকের। রিক্শর সিটের নীচে এখন আর চাকু থাকে না, থাকে থরে-থরে বই। সওয়ারি না-থাকলেই দু-চোখের সামনে মেলে ধরে বইয়ের পাতা।
এতে তার দারিদ্র ঘোচে না, ঘোচে না আগামী কাল কী খাবে সেই অনিশ্চয়তা, মোছে না ছোটলোকের পেশার গ্লানি, ভদ্রলোকের ছুঁড়ে দেওয়া অপমান। কিন্তু এখন সে সব যেন আর তাকে স্পর্শ করে না, করলেও হৃদয়ে সৃষ্টি করে না কোনও গভীর ক্ষত, যা থেকে নিয়ত রক্তক্ষরণ হবে। কিংবা হয়তো হয়, মনোরঞ্জন উপেক্ষা করে। যন্ত্রণা সহ্য করার শ্রেষ্ঠ উপায় যে তাকে উপেক্ষা করা, সে তো তার চণ্ডাল জীবন আশৈশব জেনেছে। ক্রমে সে লিখতে শুরু করে। বিভিন্ন লিট্ল ম্যাগাজিনে তার গল্প ছাপা হতে থাকে, প্রশংসিতও হয়। তাকে নিয়ে ভদ্রলোক বুদ্ধিজীবীরা সেমিনার করে। সেই সেমিনারে সাব-অলটার্ন পণ্ডিতরা হয়তো তাঁর আখ্যানের মেথডলজি নিয়ে গুরুগম্ভীর চর্চা করেন, তাই কোনও দিন স্কুলেও না-পড়া মনোরঞ্জন সেখানে আমন্ত্রণ পান না। রবাহূত তিনি তবুও প্রেক্ষাগৃহে হাজির হন ব্যক্তি থেকে তিনি কী ভাবে বিষয় হয়ে উঠলেন, সেই রগড় দেখতে। ভদ্রলোক বিদ্বজ্জনরা পর্যাপ্ত পরিশীলন ও কৌতূহলের সঙ্গে তাঁকে নিরীক্ষণ করেন। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
তাঁর গল্পের ইংরেজি অনুবাদ পর্যন্ত জায়গা করে নিতে থাকে বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ সংকলনে। চণ্ডাল জীবন নিয়ে চণ্ডালের লেখা তো আগে কেউ পড়েনি। ছোটলোকদের কথা অনেকেই লিখেছে, কিন্তু তিতাস-পাড়ের ‘মালো’ জীবনের কাহিনীকার অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছাড়া আর সব লেখকই তো ভদ্রলোক, উচ্চ বর্ণের অভিজাত, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী। চণ্ডাল কী ভাবে তার জীবনকে দেখে, নমঃশূদ্র কী ভাবে দেখে তার অবমানব অস্তিত্বকে, অনুভব করে সেই অস্তিত্বের অপমান আর গ্লানি, বাংলা সাহিত্যে কি এর আগে তা এ ভাবে ব্যক্ত হয়েছে?
মনোরঞ্জন ব্যাপারি তাই অ-সাধারণ। এখন আর তিনি রিক্শ চালান না। কিন্তু তাঁর কোনও স্থায়ী রোজগারও নেই। একটা অনাথ-আশ্রমে রাঁধুনির চাকরি, নামমাত্র বেতনে। দু’ বেলা আড়াইশো জনের রান্না করা। একা, কোনও সাহায্যকারী ছাড়াই। মঙ্গলবার এক বেলা ছুটি।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ‘দাড়িওলা বুড়ো’র এই বক্তব্যে মনোরঞ্জন সহমত নন। এমনকী স্বজাতীয় ছোটলোকরাও তাঁর সঙ্গে আজীবন যে আচরণ করেছে, যে শোষণ, পীড়ন, বিদ্রুপ তাঁকে উপহার দিয়েছে, তাতে তিনি অপরের মনুষ্যত্বে বিশ্বাস রাখতে বুঝি আর তত ভরসা পান না। কিন্তু এই বাণীর যাথার্থ্যে আমরা বিশ্বাসী। তা না হলে কোথায় পেতাম মনোরঞ্জন ব্যাপারি আর তাঁর চণ্ডাল জীবনের ইতিবৃত্তকে? মুখে মনোরঞ্জন যতই বিশ্বাস হারানোর কথা বলুন, মনে-মনে তিনি মনুষ্যত্বের অপরাজেয়তায় গভীর বিশ্বাসী। তা না হলে নিজের ছেঁড়াখোঁড়া জীবনকে এত নিপুণ হাতে সেলাই করতে-করতে তিনি এত দূর পৌঁছলেন কেমন করে, ভদ্রসমাজের প্রতি প্রত্যাশিত তিক্ততা, বিদ্বেষ ও ঘৃণার গরলে নীলকণ্ঠ না হয়েও? |
|
|
|
|
|