প্রিয়মুখ ফিরবে কি, জবাব পায় না পরিবার
জঙ্গলমহলে নিখোঁজদের নিয়ে সেই উদাসীন প্রশাসন
ঙ্গলমহল এখন ‘আপাত শান্ত’। প্রশাসনেরও দাবি, গত ২৪ নভেম্বর জামবনির বুড়িশোলের জঙ্গলে কিষেণজি নিহত হওয়ার পর মাওবাদীরা অনেকটাই ‘কোণঠাসা’। মাওবাদী-দলের অনেকে হয় ধরা পড়েছে, না-হয় আত্মসমর্পণ করেছে। আরও অনেকে গত দু’-তিন বছরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে নিহতও হয়েছে। ইতিমধ্যে রাজ্যেও ঘটেছে পালাবদল। সব মিলিয়ে আগের চেয়ে অনেকটাই ‘স্থির’ জঙ্গলমহল।
কিন্তু এই আপাত ‘শান্তি’ কতটুকুই বা প্রলেপ দিতে পেরেছে স্বজনহারা অগণন অশান্ত মনে? সন্ত্রাসের দিনগুলোয় অনেকেরই প্রাণ গিয়েছে অকালে। জীবনের ক্ষয় পক্ষ-নির্বিশেষেই। আরও অনেকে স্রেফ উধাও হয়ে গিয়েছেন। তালিকা বেড়েছে নিখোঁজের। সেই সব নিখোঁজের পরিজনেদের মানসিক যন্ত্রণা অন্য মাত্রার। স্ত্রী জানেন না, স্বামী বেঁচে না নিহত! সন্তান জানে না, তার বাবা আর আছে কি না! অসহায়, অস্থির দিনযাপন পরিজনেদের। সরকারি তরফে আপাত শান্তির বার্তায় কী-ই বা এসে যায় তাঁদের? তাঁরা জানতে চান, প্রিয়মুখ আর কি ফিরবে ঘরে? তাঁদের জিজ্ঞাসা আর্তনাদ হয়েই ফিরছে জঙ্গলমহলের আকাশে-বাতাসে।
আপাত শান্তির সময়েও তাই অস্থিরতা অনেকেরই মনের আনাচে-কানাচে।
২০০৯-এর ২৪ জুন লালগড়ের ঝিটকার বছর একত্রিশের সজল সাহা ও তাঁর বন্ধু শালবনির ঢ্যাংবহড়ার সঞ্জয় দাস রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। সজলবাবু বাস-কনডাক্টর। আর শালবনির ভীমপুর বাজারে ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্রের দোকান ছিল সঞ্জয়বাবুর। ব্যক্তিগত কাজে দুই বন্ধু একটি মোটরবাইকে ঝিটকার জঙ্গলপথে গোয়ালতোড় যাচ্ছিলেন। আচমকা কয়েকটা বোতল হাতে ঝিটকার বাড়িতে ফিরে আসেন সজলবাবু।
আজফার মেকাইল সজল নন্দলাল সম্প্রীতি
স্ত্রী কৃষ্ণাকে জানান, জঙ্গলপথে জলপাই পোশাকের সশস্ত্র কয়েক জন তাঁদের দু’জনকে আটকায়। সঞ্জয়কে আটকে সশস্ত্র লোকগুলো জানায়, জল এনে দিলে তবেই সঞ্জয়কে ছাড়বে। জল পৌঁছতে এবং বন্ধুকে ছাড়াতে ফের জঙ্গলে যান সজলবাবু। সজল-সঞ্জয়, দু’জনেই তার পর কর্পূরের মতো উবে যান!
ঝাড়গ্রামের আখড়াশোলের ৬৪ বছরের বৃদ্ধ নন্দলাল মাহাতো ছিলেন পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অয়্যারলেস অপারেটর। ২০১০-এর ১০ মে রাতে বাড়ির উঠোনে খাটিয়ায় বসে প্রতিবেশীর সঙ্গে গল্প করছিলেন। ৮-১০ জন এসে ‘মিটিঙে যেতে হবে’ বলে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল নন্দলালবাবুকে। পরিজনেদের দাবি, যারা এসেছিল, তাদের কয়েক জন পরিচিত স্থানীয় লোক। বাকিরা মাওবাদী স্কোয়াড-সদস্য। পুলিশে নিখোঁজ ডায়েরি করার ‘অপরাধে’ নন্দলালবাবুর বাড়িতেও পরে লুঠপাট চালানো হয়। ২২ মাস পরেও নন্দলালবাবুর সম্পর্কে কোনও খবরই তাঁর পরিজনেদের দিতে পারেনি পুলিশ।
ঝাড়গ্রামের আগুইবনির বছর তিরিশের অজিত গিরি বিরিহাঁড়ি বিদ্যাপীঠে ভূগোলের পার্শ্বশিক্ষক ছিলেন। ২০১০-এর ২ জুলাই বিকেলে মোটরবাইকে স্কুল থেকে ফেরার পথে নিখোঁজ হন। সন্দেহ, মাওবাদীরাই অজিতকে অপহরণ করে। অজিত যখন নিখোঁজ হয়েছিলেন, তাঁর শিশুকন্যা প্রেরণার বয়স ছিল ৩ মাস। এখন প্রায় দু’বছরের সেই মেয়ে। বাবা কে, চেনেই না! বেলিয়াবেড়ার গোহালউড়া গ্রামে বাপের বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার দিনযাপন অজিতের স্ত্রী রিনা গিরির। গত ১২ জুলাই ঝাড়গ্রামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে কোনও মতে নিখোঁজ স্বামীর ব্যাপারে তদন্তের দাবিপত্র দিতে পেরেছিলেন রিনা। অভাবের সংসারে মেয়েকে নিয়ে বাঁচার জন্য চাকরির আর্জিও জানিয়েছিলেন। এর পর আরও দু’বার মুখ্যমন্ত্রী ঝাড়গ্রামে এলেও ধারেকাছে পৌঁছনোরও সুযোগ পাননি রিনা-রা।
উদয় অজিত কাঞ্চন সাবির
বেলপাহাড়ির ওড়লি গ্রামের যুবক ‘প্রাক্তন মাওবাদী’ উদয় মাহাতো মূলস্রোতে ফিরতে চেয়েছিলেন। এলাকাবাসীকে নিয়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় গ্রামে উন্নয়নমূলক নানা কাজ শুরু করেছিলেন। গরিব স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের জন্য ‘স্বপ্নপুরী’ নামে আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্রও গড়ে তুলেছিলেন উদয়। ২০১০-এর ২২ সেপ্টেম্বর চাকাডোবা থেকে মোটরবাইকে ওড়লি ফেরার পথে নিখোঁজ হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে পরিজনেদের দাবি, সিপিএমের লোকেরাই উদয়কে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। প্রথমে পুলিশ অভিযোগ পর্যন্ত নিতে চায়নি। পরে বাঁশপাহাড়ি ফাঁড়ি অভিযোগ নিলেও আজ পর্যন্ত কোনও খোঁজ দিতে পারেনি উদয়ের।
২০১০-এরই ১৯ নভেম্বর লালগড়ের বেলাটিকরি অঞ্চলের জামদা গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী সম্প্রীতি মাহাতোকে মাওবাদী-কমিটির লোকেরা তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। এখনও খোঁজ মেলেনি তাঁরও। ওই ঘটনার পর আতঙ্কিত হয়ে সম্প্রীতির মা-বোন-ভাইয়েরা গ্রামছাড়া হয়ে যান।
গত বছর ২৩ অগস্ট বিনপুরের আঁধারিয়ায় চাদর ফেরি করতে গিয়ে নিখোঁজ হন কেশপুরের উঁচাহার গ্রামের শেখ মেকাইল ও আজফার আলি মল্লিক। কেশপুরের আরও কয়েক জন চাদর বিক্রেতা তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। বাকিরা ফিরে এলেও এই দু’জনের আর খোঁজ মেলেনি। পুলিশ ও প্রশাসনিক মহলে বহু বার আবেদন জানিয়েছেন পরিজনেরা। জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের মাধ্যমে রাজ্য প্রাশাসনের শীর্ষকর্তাদের কাছেও বিষয়টি জানান তাঁরা। তার পরেও মেলেনি কোনও খবর!
গত তিন বছরে সন্ত্রাস-দীর্ণ জঙ্গলমহলের শতাধিক বাসিন্দা নিখোঁজ হয়েছেন। বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাওবাদী-জনগণের কমিটির বিরুদ্ধেই উঠেছে অপহরণের অভিযোগ। আবার মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েক জনের নিখোঁজ হওয়ার পিছনে আগেকা শাসক সিপিএমের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। মাওবাদী সন্দেহে ধৃতদের জেরা করে পরে কয়েক জনের দেহাবশেষ মাটি খুঁড়ে উদ্ধার হলেও অধিকাংশেরই খোঁজ মেলেনি এখনও (গত ১৭ সেপ্টেম্বর ঝাড়গ্রামের নহরিয়া জঙ্গলে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার হওয়া দেহাবশেষটি ২০১০-এর ৫ অক্টোবর থেকে নিখোঁজ চন্দ্রির যুবক স্বরূপ পালের বলে শনাক্ত হয়। যদিও এখনও কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি স্ত্রী অলকা পাল। গত ১২ ফেব্রুয়ারি বাঘঝাঁপার জঙ্গল থেকে মাটি খুঁড়ে ৩টি দেহাবশেষ উদ্ধার হয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ফের আগুইবনির শিমলির জঙ্গলে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার হয় একটি কঙ্কাল)। পুলিশ-প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরে চলেছেন অধিকাংশ নিখোঁজের পরিজনেরা। অনেক ক্ষেত্রেই নিখোঁজেরা আর বেঁচে নেই বলেই আশঙ্কা। তবুও নিখোঁজ স্বামীর অপেক্ষায়, মঙ্গল-কামনায় এখনও সিঁদুরে সিঁথি রাঙান স্ত্রী! রাজ্যের ক্ষমতায় নতুন সরকার আসার পরেও নিখোঁজদের ব্যাপারে সেই উদাসীনতাই রয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। এক সময়ে যাঁদের বিরুদ্ধে অপহরণ-সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছিল, এমন অনেকে পর্যন্ত এখন আবার শাসকদলের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন বলেও অভিযোগ! ‘বিহিতে’র আশা তাই ক্রমেই কমছে।
যেমন, সব-রকম আশা-ভরসাই প্রায় হারাতে বসেছেন সাবির মোল্লা ও কাঞ্চন গরাইয়ের পরিজনেরা। ২০০৯-এর ৩০ জুলাই লালগড় থেকে মোটরবাইকে ধরমপুর ক্যাম্পে ফেরার সময়ে বৃন্দাবনপুরের কাছে নিখোঁজ হয়েছিলেন রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের এই দুই কনস্টেবল। গত বছর লালগড়ের ধরমপুর অঞ্চলের ঢ্যাংবহড়া লাগোয়া জঙ্গল-এলাকা থেকে কিছু হাড়গোড় উদ্ধারের পরে ওই দুই পুলিশকর্মীর পরিজনেদের রক্তের নমুনা নেওয়া হয়েছিল ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। কিন্তু সেই হাড়গোড় আদৌ সাবির-কাঞ্চনের কি-না, তা-ও আজ পর্যন্ত জানতে পারেননি পরিজনেরা!
তা হলে আর ভরসা রাখবেনই বা কার উপরে!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.