ইস্টবেঙ্গল ০ (৪)
প্রয়াগ ইউ: ০ (২) |
পাপস্খালন না, পুনরুত্থান? না কি শুধুই পাল্টা জবাব?
মোহালির গুরপ্রীত সিংহ সাঁধু শুক্রবার যুবভারতীতে ঠিক কোনটা করলেন?
কাটখোট্টা মেজাজের ছয় ফুটের ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার প্রশ্নটা শুনে ভ্রু কোঁচকালেন। তার পর জবাব এল, “জানি না। যে কোনওটাই ধরতে পারেন।”
টাইব্রেকারে আই এফ এ শিল্ড জেতা ইস্টবেঙ্গল টিমের সবাই যখন তাঁর দিকে দৌড়াচ্ছে কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য, তখন দেখা গেল আকাশে মুষ্টিবদ্ধ দু’হাত তুলে রয়েছেন গুরপ্রীত। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে হাতে রুখে দিয়েছেন জেমস সিংহ আর বেলো রাজ্জাকের দু’টো শট, সেই প্রসারিত বাহু-দ্বয়ের উদ্ধত ভঙ্গি দেখে মনে হল জবাবই হয়তো দিতে চেয়েছিলেন। শুধু সঞ্জয় সেনের প্রয়াগ ইউনাইটেডকেই নয়, হয়তো সদস্য-সমর্থকদেরও।
কী দ্রুতই না জীবন বদলে যায় পারফরমারদের!
৩১ জানুয়ারি ২০১২ প্রয়াগের বিরুদ্ধেই আই লিগে হেরেছিল ইস্টবেঙ্গল। শেষ দিকে গোল ছেড়ে এগিয়ে এসে গোল করতে গিয়ে দলকে ডুবিয়েছিলেন গুরপ্রীত। ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা লাল-হলুদ সমর্থকদের ছোড়া বোতল আর ইটের হাত থেকে বাঁচতে পিছনের গেট দিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয়েছিল তাঁকে। |
শিল্ড জয়ের পরে গুরপ্রীত সিংহকে নিয়ে টোলগে-ওপারার উল্লাস। শুক্রবার। ছবি: উৎপল সরকার |
১৬ মার্চ ২০১২গুরপ্রীতকে ছোঁয়ার জন্য উদ্বেল জনতা। মহানায়ককে ঘিরে মিডিয়ার হুড়োহুড়ি। বিপক্ষের কোচও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শিল্ডের সেরা কোচ হিসেবে রহিম ট্রফি পাওয়া সঞ্জয় সেন বলে দিয়েছেন, “ওর কাছেই হারলাম। দারুণ গোলকিপিং করেছে ছেলেটা।” “ঢাকায় সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের বহু আকাঙ্ক্ষিত শততম সেঞ্চুরির গাঁট পেরোতে লাগল ৩৬৮ দিন। আর গুরপ্রীতের ‘পাপস্খালন’ করতে লাগল ৪৫ দিন।” হাসতে হাসতে তুলনা টানছিলেন ইস্টবেঙ্গলে গুরপ্রীতের কিপার কোচ অতনু ভট্টাচার্য। “সুপার কাপটা গুরপ্রীত জিতিয়েছিল। টাইব্রেকারে। আমি জানতাম এই ম্যাচটা টাইব্রেকে গেলে দু’একটা শট আটকাবেই,” বলছিলেন প্রাক্তন এশিয়ান অলস্টার।
এক দশক পর শিল্ড জয়। তাও আবার এমন একটা দলকে হারিয়ে যাদের কাছে বারবার ঠোক্কর খেয়েছে ট্রেভর মর্গ্যানের ইস্টবেঙ্গল। উচ্ছ্বাসটা তাই একটু যেন বেশিই ছিল ইস্টবেঙ্গলে। ড্রেসিংরুমে ঢোকার আগে নিজের জার্সিটা টোলগে ছুড়ে দিয়ে গেলেন অপেক্ষমান সমর্থকদের। বিশাল ট্রফিটা নিয়ে দৌড়ানোর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যিনি, সেই অ্যালভিটো ডি’কুনহা দশ বছর আগেও ছিলেন টিমে। এর সঙ্গে গ্যালারিতে ব্যান্ড, আবির, মশাল, উদ্দাম নাচ তো ছিলই। অন্য সবাই যখন আবেগের গামলায় ভাসছেন, তখন লাল-হলুদের ব্রিটিশ কোচকে দেখে মনে হল বেশ অভিমানী। “সদস্য-সমর্থকরা ট্রফি পেয়ে খুশি হয়েছেন। কর্মকর্তারাও নিশ্চয়ই এ বার খুশি।” শেষ লাইনটা বলার পর অবশ্য মর্গ্যান-সুলভ একটা হাসি বেরোল। বুঝতে অসুবিধা হল না, কী চাপ নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। ইস্টবেঙ্গল কোচ অবশ্য স্বীকার করে নিলেন, “জয়টা পেলাম লটারি জেতার মতো। টাইব্রেকার মানেই লটারি। যে কেউ জিততে পারে।”
লটারি জেতাই বটে! উনিশ-বিশের পার্থক্য নিয়ে নামা দু’টি দল নেমেছিল যুদ্ধ জিততে। দলে এক ঝাঁক বিদেশি তারকা থাকা সত্ত্বেও দুই কোচই চেয়েছিলেন মাঝমাঠ দখলে নিতে। এই লড়াইয়ে অবশ্য সামান্য হলেও পাল্লা ভারী ছিল পেন-খাবরাদের দিকেই। বিশেষ করে প্রথমার্ধে। ফলে বল বক্স টু বক্স দুলল পেন্ডুলামের মতো। টোলগের হেড ক্রসপিসে লেগে ফিরল একবার নয়, দু’-দু’বার। একবার তো ভিতরের দিকে লেগে বল ফিরল। কিন্তু প্রয়াগও গোলের সুযোগ পেয়েছিল অন্তত গোটা চারেক। ভিনসেন্ট নামার পর ওপারা-গুরবিন্দররা কেঁপে গেলেন। অতিরিক্ত সময়ে শঙ্কর ওঁরাও ফাঁকা গোলে বল ঠেলতে পারলেন না।
টোলগে-রবিন-পেনএই ত্রিভুজকে কাজে লাগিয়ে আগের তিনটি ম্যাচে ফসল ফলিয়েছিলেন লাল-হলুদ কোচ। মর্গ্যান-স্ট্র্যাটেজি ভাঙতে প্রয়াগ কোচ পাল্টা টোটকা হিসাবে ব্যবহার করলেন জোনাল ও ডাবল কভারিং সিস্টেম। পেনের পিছনে তিনি লাগিয়ে দিয়েছিলেন জয়ন্ত সেনকে। আর টোলগে বা রবিন বল ধরলেই ঘিরে ধরছিলেন বেলো রাজ্জাক-অনুপম সরকাররা। টুর্নামেন্ট সেরা ফুটবলার হয়ে শৈলেন মান্নার নামে ট্রফি পেলেন অনুপম। তাঁদের দাপটে বিপক্ষকে আটকে, সুযোগ পেলেই প্রতি আক্রমণে যাচ্ছিল সঞ্জয় সেনের দল। মর্গ্যান অবশ্য শুরু থেকেই জেতার জন্য ঝাঁপিয়েছিলেন। কিন্তু সতেরো মিনিটের মধ্যেই সুশান্ত ম্যাথু চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় তাঁর অঙ্ক সামান্য ধাক্কা খেল। প্রয়াগের উইংকেও তিনি কার্যকর হতে দেননি। ওপারাকে দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন ইয়াকুবুকেও।
দুই কোচের অঙ্ক এবং পাল্টা অঙ্কের দৌলতে ম্যাচটা টাইব্রেকারে গড়াল। নির্ধারিত সময়ে গোল না হওয়ায়। হারলেও প্রয়াগকে কৃতিত্ব দিতে হবে অন্য কারণে। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগেই ১২০ মিনিটের ম্যাচ খেলার পরও এ দিন শেষ মিনিট পর্যন্ত তারা জমি ছাড়েনি বলে। টাইব্রেকারের শুরুতেই প্রয়াগের জেমস আর বেলোর শট আটকে যেতেই উল্লাস শুরু হয়েছিল গ্যালারিতে। মাঠের মধ্যে মর্গ্যান-ব্রিগেড কিন্তু ছিল লক্ষ্যে স্থির। টোলগে, পাইতে, রবিন, সুবোধকুমাররা গোল করে গেলেন নিশ্চিন্তে। জয়ন্ত বা ইয়াকুবুর গোল তাই কাজে লাগল না।
২০০২-০৩ মরসুমের পর ২০১২। প্রায় দশ বছর পর ফের শিল্ড গেল ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে। তার চেয়েও বড় কথা শিবদাস-বিজয়দাসদের ঐতিহাসিক শিল্ড জয়ের শতবর্ষে এ বার ট্রফিটা কিন্তু গিয়ে ঢুকল লাল-হলুদ শিবিরে।
ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, সৈকত (পাইতে), ওপারা, গুরবিন্দার, সৌমিক, সুবোধকুমার, পেন, সুশান্ত (সঞ্জু), খাবরা (রবার্ট), টোলগে, রবিন। |