|
|
|
|
মহাঅপেক্ষার ৩৬৮ দিন |
সব্যসাচী সরকার • কলকাতা |
যুদ্ধে আর প্রেমে নাকি কোনও কিছুই অন্যায় নয়। কিন্তু ক্রিকেটে? বাইশ গজে ব্যাট-বলের টক্করে? ক্রিজে পৌঁছনোর মুখে বোলার যদি ব্যাটসম্যানের পথ আটকে দাঁড়ায় আর রান আউট হতে হয়, সেটা একশোবার অন্যায়। হাজার বার অনৈতিক। অন্তত সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের এতে কোনও সংশয় ছিল না।
ব্রেট লি-র পিঠে ধাক্কা খেয়ে রান আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে বিরক্তিতে ব্যাট ছুড়ে দিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। যা কেউ কখনও শোনেনি বা দেখেনি। বেশি দিন নয়, মাত্র ২৬ দিন আগের কথা। ত্রিদেশীয় সিরিজে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ। টিম বাসে নয়, সে দিন সবার অলক্ষ্যে বোলিং কোচকে নিয়ে মাঠে এসেছিলেন দেড় ঘণ্টা আগে। ধরেই নিয়েছিলেন, প্রিয়তম সিডনিতে আসছেই একশো নম্বর। ওই সফরে ম্যানেজার থাকা বিশ্বরূপ দে-র স্মৃতিচারণ বলছে, “স্তব্ধ ড্রেসিংরুমে বসে বারবার নিজের রান আউটটা দেখছিল ও আর বারবার অস্ফুটে বলছিল ‘দিস ইজ নট ফেয়ার!’ |
|
অপেক্ষার শেষ। ফরিদাবাদে খুদে ক্রিকেটারদের সচিন-বন্দনা। ছবি: পিটিআই |
ব্রেট লি সে দিন ‘আনফেয়ার’ কি না অন্য প্রশ্ন, কলকাতা থেকে কন্যাকুমারি, বরাবরই সচিনের ব্যাপারে ‘আনফেয়ার’। তাঁর কাছে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবটা সব সময়ই আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা। অন্য একটা মানদণ্ড ঠিক করে দেওয়া। শুক্রবার সকালে ঢাকার হোটেল থেকে বেরনোর আগে সম্ভবত সচিনের রুমের আয়নাটাও ফিসফিস করে বলেছিল, ‘উইশিং ইউ ফর ইয়োর হান্ড্রেডথ স্যর!’
যে শব্দবন্ধ গত ৩৬৮ দিন, ৮৮৩২ ঘণ্টা ধরে শুনে এসেছেন তিনি। টিমমেট, পরিবার-পরিজন, বন্ধু, স্টেডিয়ামের গেটকিপার, হোটেলের রিসেপশনিস্ট, রেস্তোরাঁ বয়, আমি-তুমি-আপনি, আমরা-ওরা, রাম-শ্যাম-যদু-মধু। এক কথায় আকবর বাদশা থেকে হরিপদ কেরানি, সবাই। আর গোটা দেশের একশো কোটির আকুতি তো একটাই। ‘একশোখানা একশোটা প্লিজ এ বার করে দিন, অনেক হয়েছে!’ করে দেওয়াটা যেন অর্ডার দিলে হোটেলের ঘরে রুম সার্ভিসের চটজলদি পৌঁছে যাওয়ার মতো!
কবে কখন? কোথায়? কী ভাবে? কেন এত দেরি হবে? এত কাছে তবু এত দূরে কেন?
বোঝা যায়, তাঁর পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছে অনাবশ্যক সব প্রশ্নচিহ্ন। পরিষ্কার, কেন সব সময় তাঁর কানে থাকে হেডফোন, কেন মাঠ ছাড়া সব সময় বহির্জগত ও তার পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন। সচিন তেন্ডুলকরের কাছে ভারতবাসীর চাওয়া-পাওয়াটা বরাবরই আকাশ নয়, মহাকাশ ছোঁয়া। গত ৩৬৮ দিনে যা নানা রূপে আবির্ভূত। ওভালে গত বছরের অগস্টে ৯১-এর পরে ঘরের মাঠ মুম্বইয়ে নভেম্বরে ৯৪! সেখানেও সেই তো ‘এত কাছে তবু এত দূরে’-র কাহিনি। ভাগ্যের সঙ্গে, অপেক্ষার সঙ্গে ডুয়েলে ২২ বছরের কেরিয়ারে এর আগেও নামতে হয়েছে সচিনকে। গাওস্করের ৩৪ ছুঁয়ে ফেলার পরে ৩৫তম টেস্ট সেঞ্চুরিতে পৌঁছতে লেগেছিল পাঁচটি টেস্ট, সাত ইনিংস। |
এশিয়া কাপে ভারতের ভাগ্য কোন পথে |
• রবিবার পাকিস্তানকে হারাল ভারত। শ্রীলঙ্কা মঙ্গলবার হারাল বাংলাদেশকে। পয়েন্টের বিচারে ফাইনালে যাবে ভারত।
• পাকিস্তানকে রবিবারের ম্যাচে হারাল। আর মঙ্গলবার বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে হারাল সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পয়েন্ট সমান হবে। নেট রান রেটে ধোনিরা সাকিবদের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকায় ফাইনালে যাবে ভারত। তবে ভারত বা বাংলাদেশ কেউ বোনাস পয়েন্টে জিতলে সুবিধা পাবে তারা।
• ভারত পাকিস্তানের কাছে হারল। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশকে হারাল। তখন রান রেটের বিচারে ভারতের যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদি না শ্রীলঙ্কা বোনাস পয়েন্টে যেতে।
• ভারত পাকিস্তানের কাছে হারল। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে হারাল। পয়েন্টের বিচারেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান ফাইনাল হবে সে ক্ষেত্রে। |
|
তার পর ৩৬ নম্বরটা আসতে লেগেছিল ১৭ মাস, ১৭ ইনিংস এবং দশটা টেস্ট! ১৯ মে, ২০০৭। চট্টগ্রামে এসেছিল সেই সেঞ্চুরি। পরের পৌনে পাঁচ বছরে সচিন আবার সচিন। টেস্টে ১৫টা সেঞ্চুরি, ওয়ান ডে-তে সাতটা, দু’ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে সাড়ে সাত হাজার রান, ওয়ান ডে-তে প্রথম দুশো, বিশ্বকাপ জয়। বিশ্বকাপেই গত বছর নাগপুরে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে ১১১ আর তার পর থেকে শুরু অনন্ত অপেক্ষা। এ বারের অপেক্ষার স্থায়িত্ব ৩৩ ইনিংস, ১১ টেস্ট, ১৩ ওয়ান ডে। মোহালি হোক বা মেলবোর্ন, মু্ম্বই হোক বা সিডনি, প্রতিটি কেন্দ্র তৈরি থেকেছে একশোখানো একশোর জন্য। কোথাও ৮৫, কোথাও ৯১ বা ৯৪! অপেক্ষা এবং দিনের শেষে পরিণতি হাহুতাশ ও দীর্ঘশ্বাস। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কোনও সচিনপ্রেমী তার ঈশ্বরকে লিখেছে, “শুধু একশোটা করিয়ে দাও প্লিজ, জীবনে ওকে আর ভগবান বলে ডাকব না!” প্রেমিক তার প্রেমিকাকে লিখেছে, “শুধু সচিনের একশোটা হতে দাও, দেখবে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমাদের ঝগড়া হবে না!”
এ যেন স্যামুয়েল বেকেটের নাটক ‘ওয়েটিং ফর গোদো’। যেখানে বলা হচ্ছে, “কিন্তু প্রশ্নটা এই নয়। আমরা এখানে কেন, সেটাই আসলে প্রশ্ন। আর আমরা ঈশ্বরের বর পেয়ে ভাগ্যবান, কারণ আমরা উত্তরটা জানি। হ্যাঁ, এই অভূতপূর্ব সংশয়ের মধ্যে একটা বিষয় পরিষ্কার। উই আর ওয়েটিং ফর গোদো টু কাম।” গত এক বছর ধরে গোটা ক্রিকেটদুনিয়ার কোরাস ‘ওয়েটিং ফর হান্ড্রেডথ টু কাম’। কোটি কোটি সচিন-ভক্তের মতো অপেক্ষার পরীক্ষা দিয়ে গিয়েছেন সচিন। ৪৯টা ওয়ান ডে সেঞ্চুরির প্রথমটা আসতে লেগেছিল পাঁচ বছর, বিশ্বকাপ পেতে লেগে গিয়েছে ২২ বছর। আরও বিস্ময়কর, টেস্ট ও ওয়ান ডে মিলিয়ে দেশের হয়ে মোট ৭৬২ ইনিংসে ২৭ বার সচিন আউট হয়েছেন নব্বইয়ের ঘরে। ক্রিকেটের ভগবান যেমন দু’হাত ভরে দিয়েছেন, মাঝে মাঝে কেড়েও নিয়েছেন।
অতিমানবিক এই কীর্তিকে স্মরণীয় করে রাখার যুদ্ধ চলেছে মিডিয়ারও। ছিল আগাম প্রস্তুতি। শুধু অপেক্ষাতেই খরচ হয়েছে হাজার হাজার টন নিউজপ্রিন্ট। তার পরেও যে কোনও খবরের কাগজে ক্রিকেটলিখিয়ে অপেক্ষায় থেকেছে, তৈরি রেখেছে যাবতীয় পরিসংখ্যান সহ চার্ট। টিভি চ্যানেল বিশেষ অনুষ্ঠানের প্যাকেজ পকেটে রেখেছে, নখ খুঁটতে খুঁটতে ওয়েবসাইটের ডিজাইনার তৈরি করেছে বিশেষ পেজ ডিজাইন, ফুটেজ এডিট করা হয়েছে, তুলে রাখা হয়েছে নামী দামিদের উদ্ধৃতি। ওই দিন যদি না পাওয়া যায়।
একশোর আবর্তে ক্রমাগত ঘুরপাকে দাঁড়ি পড়ল মীরপুরে, কিন্তু কোথাও যে রয়ে যাচ্ছে মন খারাপের মেঘ। হেরে যাওয়া ম্যাচে একশো এল যে! |
এখন পয়েন্ট টেবল |
|
ম্যাচ |
পয়েন্ট |
রান রেট |
পাকিস্তান |
২ |
৯ |
+০.৭৩০ |
ভারত |
২ |
৪ |
+০.৪২৩ |
বাংলাদেশ |
২ |
৪ |
-০.১৩৪ |
শ্রীলঙ্কা |
২ |
০ |
-১.০৬৮ |
|
যাহা নিরানব্বই, তাহাই আটানব্বই, তাহাই আবার একশো। এই একশোটা আসলে কী? আগের সচিন হলে হয়তো বলতেন, “কী আবার? দিনের শেষে স্রেফ একটা নম্বরই তো!”
সংখ্যায় কী এসে যায়? অনেকে অনেকবার বলেছেন, নিরানব্বইতে থেমে গেলে সচিন কি আর সচিন থাকতেন না? নিশ্চয়ই থাকতেন। আবার থাকতেনও না। না হলে আর এত কিছু কেন? সংখ্যা তো এসে যায়ই। নিরানব্বই আর একশোর মধ্যে কী কফাত, গত ৩৬৮ দিন ধরে হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন সচিন। নয়তো কেন বলবেন, “একশোটার মধ্যে এটাই ছিল টাফেস্ট!”
সচিন না হয় আধুনিক ডন। আজ থেকে তা হলে ডনকে ‘প্রাচীন সচিন’ বলা হবে না কেন? এই ‘ডন-’ও তো বচ্চনের ‘ডন’-এর মতোই। যাঁর কীর্তিকে ছোঁয়াও স্রেফ ‘মুশকিলই নেহি, না মুমকিন হ্যায়!” |
|
|
|
|
|