মহাকীর্তির উৎসব ভেস্তে গেল প্রয়াত বন্ধুর জন্য শপথে
মানজারুল ইসলাম রানা।
শুক্রবার মীরপুরের মাঠে উপস্থিত এগারো জন বাঙালি নন। শততম সেঞ্চুরির মহাকীর্তির দিনে সচিন তেন্ডুলকরের সবথেকে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দেখা দিলেন প্রয়াত এই বাংলাদেশি ক্রিকেটার! মহাকীর্তির মেজাজ তুবড়ে দিয়ে ভারতের ফাইনাল যাওয়ার পাশেই বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন বসিয়ে দিলেন। মহানায়ককে ঘিরে মহোৎসব ভেস্তে দিয়ে তাঁকে ঠেলে দিলেন নতুন চ্যালেঞ্জের দিকে।
উননব্বইয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রিকেট-যাত্রা শুরু করেছিলেন ঝাঁকড়া চুলের বিস্ময় বালক। মহাকীর্তির দিনে নতুন চ্যালেঞ্জ এশিয়া কাপের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে তবেই ফাইনাল খেলা নিশ্চিত করো।
২০০৭-এর ১৬-ই মার্চ মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় অকালে নিভে যায় রানার জীবনদীপ। পরের দিন, ১৭ মার্চ পোর্ট অব স্পেনে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলতে নামবে বাংলাদেশ। শোকস্তব্ধ হবিবুল বাশারের টিম শপথ নেয়, রানার আত্মার শান্তির জন্য তাঁরা ভারত-ম্যাচ জিতবে। তাদের সেই প্রতিজ্ঞবাদ্ধ মুখচোখের সামনে হেরে বিশ্বকাপ থেকে অকাল বিদায় নেয় গুরু গ্রেগ এবং দ্রাবিড়ের ফেভারিট ভারত।
এ দিন মাঠের মধ্যে সচিন শততম সেঞ্চুরি পুরণ করার মুহূর্তে এই শপথের গভীরতা টের পাওয়া যায়নি। স্কোয়ার লেগে ঠেলে এক রান নিয়ে তিনি সেঞ্চুরি করা মাত্র সমস্ত বাংলাদেশি ক্রিকেটার ছুটে এলেন অভিনন্দন জানাতে। সন্ধ্যায় ২৯০ টার্গেট সামনে রেখে ব্যাট করতে নেমে এঁরাই তেন্ডুলকরের সেঞ্চুরি অব সেঞ্চুরিজের উৎসব ভেস্তে দিয়ে গেলেন। শুক্রবার রানার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। এই বাংলাদেশ টিমে তাঁর সবথেকে ঘনিষ্ঠ ছিলেন মাশরাফি মর্তুজা। তিনিই টিমকে মনে করিয়ে দেন ১৬ মার্চ প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু দিন। এর পর টিম মিটিংয়ে অধিনায়ক মুশফিকুর এবং অন্যান্যরা বলেন, ম্যাচটা আমাদের রানার জন্য খেলতে হবে। অবধারিত ভাবে চলে আসে ২০০৭ বিশ্বকাপের সেই ম্যাচের কথা। বাংলাদেশ টিম মিলিত ভাবে শপথ নেয়, হার-জিত পরের কথা। কিন্তু ম্যাচটা আমরা জানপ্রাণ দিয়ে লড়ব।
স্বপ্ন যখন সত্যি। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে, শুক্রবার। ছবি: এএফপি
পাঁচ বছর আগে রানার জন্য খেলতে নেমে বাংলাদেশ শেষ করে দিয়েছিল সচিন, দ্রাবিড়, সৌরভদের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন। এ দিন পাঁচ উইকেটে হারিয়ে অনিশ্চিত করে তুলল ধোনির টিমের এশিয়া ফাইনাল খেলা। হওয়ার কথা ছিল সচিনের সেঞ্চুরির মহোৎসব। হয়ে দাঁড়াল বাংলাদেশের বিজয় উৎসব। সচিন, ধোনিরা মাঠ থেকে বেরোতে গিয়ে দেখলেন, মীরপুরের রাস্তা যেন ২ এপ্রিলের মেরিন ড্রাইভের আকার নিয়েছে। পুরো রাস্তা জুড়ে চলছে বাংলাদেশি ক্রিকেট-ভক্তদের বাঁধনহারা উৎসব। হাজারে হাজারে লোক। ব্যান্ড বাজছে। নাচানাচি চলছে। বাংলাদেশের বিশাল জাতীয় পতাকা দোলানো হচ্ছে। সাকিব, তামিমদের নামে জয়ধ্বনি চলছে। এখানকার সময় রাত দশটাতেও যে উচ্ছ্বাস থামার কোনও লক্ষণ নেই।
মাঠে এঁরাই ফেভারিটদের ছিটকে দিয়েছেন। কখনও তামিম ইকবাল। কখনও সাকিব-আল-হাসান। সচিন পর্যন্ত বলে গেলেন, সাকিবের ৩১ বলে ৪৯ বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। ঘটনা হচ্ছে, ভারতের বিরুদ্ধে নামার আগে এক বন্ধুর বাড়িতে নৈশভোজে সচিনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়ে যান সাকিব এবং তামিম। দু’জনকেই বেশ কিছু মূল্যবান পরামর্শ দেন তিনি। আজ সেই পরামর্শ ভেস্তে দিয়ে গেল সচিনেরই উৎসবের রাত।
অশোক দিন্দা যিনি এ দিন খেললেন বিনয় কুমারের চোট থাকার জন্য, তিনি যখন শেষ ওভার বল করতে ছুটছেন, তখন বাংলাদেশের জেতার জন্য দরকার ২ রান। স্লগে এর আগে মুশফিকুর (২৫ বলে ৪৬) প্রবীণ কুমারদের এমন ঠেঙিয়েছেন যে, শেষ ওভারের আগেই দফারফা সারা। সেই ঠ্যাঙানি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, স্লো খেলার জন্য একা সচিনকে দায়ী করা ঠিক হবে না। বাংলাদেশের ওপেনার তামিম ইকবাল যথেষ্ট কার্যকরী ইনিংস খেলে গেলেন। ৯৯ বলে ৭০। তাঁরও স্ট্রাইক রেট ৭০-এর সামান্য বেশি। এই ভারতীয় বোলিং নিয়ে বিশ্বের কোথাও কোনও মহাকীর্তিই বোধ হয় সুরক্ষিত নয়।
আবার মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছে, ক্রিকেট কোথায়? এ তো জীবন-মৃত্যুর খেলার মতো! এক জন জীবন্ত কিংবদন্তি যুদ্ধক্ষেত্রে আক্রান্ত, অপমানিত, রক্তাক্ত হতে হতে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। লক্ষ্য পূরণ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরকে খুঁজছেন। প্রয়াত বাবাকে খুঁজছেন। শিরস্ত্রাণ খুলে তার ওপর অবস্থিত তেরঙ্গায় ব্যাট দিয়ে টোঁকা মেরে হয়তো বলার চেষ্টা করছেন, আমি সচিন তেন্ডুলকর...এই তেরঙ্গার জন্যই খেলি। রেকর্ডের জন্য জায়গা আঁকড়ে পড়ে আছি বলে যে প্রচার করা হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। মহাকীর্তির দিনে ভীষণ অর্থবহ দেখাচ্ছিল ব্যাট দিয়ে হেলমেটে ঠোকা মারাটা। এর আগে নিরানব্বইটা সেঞ্চুরি করার ক্ষেত্রে যা কখনও তাঁকে করতে দেখা যায়নি। আরও অর্থবহ লাগছিল কারণ সচিন কাণ্ডটা ঘটালেন ড্রেসিংরুমের দিকে তাকিয়ে। নানা তির্যক প্রশ্ন যে সেখানেও উঠে পড়েছিল।
মাহেন্দ্রক্ষণের কিছুক্ষণ পরে মাঠেও তো অদ্ভুত দৃশ্য! রায়না আউট হয়ে ফিরলেন। ধোনি নামলেন। শততম সেঞ্চুরির মালিক এগিয়ে গেলেন অধিনায়কের দিকে। এ সব ক্ষেত্রে সবথেকে আকাঙ্খিত দৃশ্য হচ্ছে, প্রথমেই ক্রিজে আসা নতুন ব্যাটসম্যান হাত বাড়িয়ে দেবেন নতুন কীর্তি স্থাপকের দিকে। ধোনি হাত বাড়ালেন না। মুখে অভিনন্দন জানিয়ে থাকলে অত ওপরের প্রেসবক্স থেকে বোঝার উপায় নেই। পরে যদিও দেখা গেল সচিন যখন আউট হয়ে ফিরছেন তখন ধোনি হাততালি দিচ্ছেন।
সচিন তেন্ডুলকর
ম্যাচ রান সেঞ্চুরি
৬৫১ ৩৩৮৫৪ ১০০
নিকটতম নক্ষত্র

ম্যাচ রান সেঞ্চুরি
রিকি পন্টিং ৫৫৪ ২৭৩০৫ ৭১
জাক কালিস ৪৮৮ ২৪৩৮৩ ৫৯
মাহেলা জয়বর্ধনে ৫৩৫ ২১৬৩০ ৪৫
কুমার সঙ্গকারা ৪৬৩ ২০৬৯৬ ৪১
গ্যালারির প্রতিক্রিয়া গুলোও কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। সচিন নব্বইয়ের ঘরে যখন আটকে পড়েছেন, তখন তিনি এক-একটা ‘ডট’ বল খেলছেন আর গ্যালারি হাততালিতে ফেটে পড়ছে। সচিন আটকে গিয়েছেন দেখে বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর সাত জনকে সিঙ্গলস ঠেকানোর জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। সচিন সেই চক্রব্যূহে অনেকক্ষণ আটকে রাইলেন। একটা ওভার মেডেনও হল। আবার যে-ই তিনি ৯৯-তে স্ট্রাইক নিচ্ছেন, গোটা স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে জনতার মনোভাব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে সচিন, তুমি সেঞ্চুরিটা করো। কিন্তু এমন ভাবে কোরো না যাতে আমরা ম্যাচটা হেরে যাই।
সচিন সেঞ্চুরি করলেন শেষ পর্যন্ত ১৩৮ বলে। গোটা ইনিংসের হিসেব ১৪৭ বলে ১১৪। স্ট্রাইক রেট ৭৭-এর সামান্য বেশি যা সচরাচর তাঁর ওয়ান ডে ইনিংসে খুঁজে পাওয়া কঠিন। রাতের আলোয় বাংলাদেশ যখন ম্যাচ ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে তখন ফের আক্রান্ত দেখাল সচিনকে। বলাবলি হতে থাকল, আজ ভারত ম্যাচ হেরে গেলে কাকে কাঠগড়ায় তোলা হবে? ড্রেসিংরুম কী চোখে দেখবে তাঁর ৭৭ স্ট্রাইক রেট-কে? আর পাঁচটা দিনে হয়তো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ২৮৯ যথেষ্ট রান হত। কিন্তু শুক্রবারের বাংলাদেশ টিম মানে যে প্রয়াত বন্ধুর আত্মাকে শ্রদ্ধার্ঘ দিতে নামা বাংলাদেশ টিম।
মহাকীর্তির দিনে জীবন্ত কিংবদন্তিকে তাঁরা ফেরত পাঠালেন বাকরুদ্ধ, শোকস্তব্ধ করে!

ভারত
গম্ভীর বো ইসলাম ১১
সচিন ক মুশফিকুর বো মর্তুজা ১১৪
কোহলি বো রজ্জাক ৬৬
রায়না ক তামিম বো মর্তুজা ৫১
ধোনি ন.আ. ২১
রোহিত রান আউট ৪
জাডেজা ন.আ. ৪
অতিরিক্ত ১৮
মোট ৫০ ওভারে ২৮৯-৫।
পতন: ২৫, ১৭৩, ২৫৯, ২৫৯, ২৬৭।
বোলিং: মর্তুজা ১০-১-৪৪-২, ইসলাম ৫-০-২৪-১, সাহাদাত ১০-০-৮১-০,
সাকিব ১০-০-৬৩-০, রজ্জাক ১০-৪১-১, মাহমুদুল্লাহ ৪-০-২৪-০, নাসির ১-০-৬-০।

বাংলাদেশ
তামিম ক জাডেজা বো প্রবীণ ৭০
নাজিমুদ্দিন ক রোহিত বো প্রবীণ ৫
জহিরুল ক রোহিত বো জাডেজা ৫৩
নাসির ক রায়না বো প্রবীণ ৫৪
সাকিব স্টা: ধোনি বো অশ্বিন ৪৯
মুশফিকুর ন.আ. ৪৬
মাহমুদুল্লাহ ন.আ. ৪।
অতিরিক্ত ১২
মোট ৪৯.২ ওভারে ২৯৩-৫।
পতন: ১৫, ১২৮, ১৫৬, ২২৪, ২৮৮।
বোলিং: প্রবীণ ১০-০-৫৬-৩, ইরফান ৯-০-৬১-০, দিন্দা ৫.২-১-৩৮-০,
রায়না ৭-১-৩০-০, রোহিত ২-০-১৩-০, অশ্বিন ১০-০-৫৬-১, জাডেজা ৬-০-৩২-১।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.