|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা ১... |
|
অসামান্য |
গতি হলিউডি। আত্মা কলকাত্তাইয়া। যোগফল সাফল্য। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় |
প্যান্ডেলের ভারা বাঁধছে পুজোর কলকাতা।
ফুটপাথে মুখ ধুচ্ছে ভোরের কলকাতা।
প্লাস্টিকের ছাঁকনিতে চা ছাঁকছে গলির কলকাতা।
আর এ সবের মধ্য দিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্ফীতগর্ভা বিদ্যা বালন।
‘পা’, ‘ইশকিয়া’, ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ পেরিয়ে ‘ডার্টি পিকচারে’র দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রি থেকে সটান এ শহরে তিনি। লন্ডন থেকে আসা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের একলা চলার ‘কহানি’ শোনাতে।
চার সংখ্যাটা কি সুজয় ঘোষের জন্য পয়া? কে জানে? ‘ঝঙ্কার বিটস’, ‘হোম ডেলিভারি’, ‘আলাদিন’ মাঝারি সাফল্য বা ফ্লপের চেয়ে বেশি কিছু পায়নি এর আগে তাঁর তিন-তিনটি ছবি। কিন্তু চার নম্বরে এসে কেল্লা ফতে! ‘কহানি’ এমন একটা ছবি, যেখানে সুজয়ের প্রায় সব ক’টা সার্ভিস জায়গা মতো পড়েছে!
নাহ, ভুল বলা হল বোধহয়। টেনিস একার খেলা! সিনেমা তো টিমগেম! বরং বলি, সুজয় দুর্দান্ত ক্যাপ্টেন্সি করেছেন! বিদ্যা বালন কুম্ভ হয়ে ছবিটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন! আবার একই সঙ্গে বিদ্যাকে এতটুকু খাটো না করেও বলছি, তিনি কিন্তু ‘একা’ কুম্ভ নন! এ ছবিতে তাঁকে ঘিরে আছে অসংখ্য ছোট-বড় জ্যোতিষ্ক, তারা প্রত্যেকে নিজেদের আলোয় ভাস্বর শুধু নয়। তারা প্রত্যেকে অপরিহার্য।
|
|
কহানি
বিদ্যা, পরমব্রত,
শাশ্বত, ইন্দ্রনীল,
খরাজ, শান্তিলাল, ধৃতিমান, আবির |
‘কহানি’-র সবচেয়ে বড় গুণ বোধহয় এটাই। প্রায় কোনও কিছুই বাড়তি নয় এ ছবিতে। এত মেদহীন ‘থ্রিলার’ বলিউডে খুব বেশি হয়নি, সেটা জোর দিয়ে বলা যায়। তার চেয়েও বড় কথা হল, ভারতীয় জনপ্রিয় সিনেমার ধারায় থ্রিলারকে ‘থ্রিলার’-এর মতো করে সবটা করে ওঠাও বেশ কঠিন। কারণ ক্লাসিকাল বলিউডের স্বভাবই হল অলস দুপুরের ঘুমের মতো বেশ খানিকটা গা এলিয়ে গল্প বলা। হাতে যত রকম উপাদান আছে, নাচ-গান-রোম্যান্স-অ্যাকশন, সব স-অ-অ-ব যথাসম্ভব উপুড় করে দেওয়া। সব রকম ফর্মুলা, বাজারের সব রকম অঙ্ককে ছুঁয়ে রাখতে চাওয়া। যাতে কেউ দুঃখ না পায়, কোনও দর্শক খালি হাতে না ফেরে। ইদানীং সেই ট্রেন্ডটা বদলাতে শুরু করেছে। গল্পের দাবি অনুযায়ী ছবির আঙ্গিক নির্ধারিত হচ্ছে। ‘কহানি’ তার একটা খুব বড় মাপের উদাহরণ হয়ে থাকবে। এবং অত্যন্ত স্বতন্ত্র দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
কেন? দু’টো কারণে। হলিউড প্রাণিত হওয়া সত্বেও (মনে করুন, ‘টেকিং লাইভ্স’) ছবিটা কিন্তু কখনওই হলিউডি হয়ে ওঠেনি। ‘কহানি’ তার আত্মায়, চিত্রভাষায় পুরোপুরি ভারতীয় একটা ছবি। এবং আদ্যন্ত থ্রিলারের মেজাজ ধরে রাখতে গিয়ে গল্পের মানবিক আবেদনের দিকটা এক বারের জন্যেও ঢাকা পড়তে দেয়নি। বরং থ্রিলার বা অ্যাকশন ছবির গা থেকে বেশির ভাগ সময়েই যে উগ্র ‘মেল পারফিউম’-এর গন্ধ আসে, তার নটেগাছটি এখানে গোড়া থেকেই মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে! এর জন্য সুজয়কে আলাদা করে ধন্যবাদ!
ধন্যবাদ আরও অনেক কারণেই অবশ্য তাঁর প্রাপ্য। হিন্দি ছবিতে মুম্বই-দিল্লি-পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশ যে পরিমাণে এসেছে, কলকাতা সে তুলনায় কতটুকু? ‘যুবা’, ‘ক্যালকাটা মেল’ আর ‘পরিণীতা’য় কিছু ঝলক আছে। কিন্তু সেটা ঝলকই। ক্লাইভের শহর তার হাওড়া ব্রিজ-ট্রাম-ভিক্টোরিয়া আর দুর্গাপুজোর পিকচার পোস্টকার্ডের সঙ্গে যে রক্তমাংস-ঝুলকালি নিয়ে প্রতিদিন নানা বীভৎস মজায় বেঁচে থাকে, তার চিত্রায়ণ সে
ভাবে হয়েছিল কই? ‘আমি সত্যি বলছি’, বলিউডের পর্দায় নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো আর বিশ্বম্ভর মল্লিক লেন থেকে শুরু করে মায় খাদি এম্পোরিয়াম লেখা প্যাকেটটা অবধি দেখতে পেয়ে বড় আনন্দ পেয়েছি! বাঙালি জিভে হিন্দি উচ্চারণ এত দিন তামাশার নিশানা হয়েছে। এ ছবিতে সেটাই অলঙ্কার হয়ে উঠতে দেখে নির্মল মজা পেয়েছি।
সেই সঙ্গে রীতিমতো গর্ব হয়েছে, একসঙ্গে টালিগঞ্জের এত জন কলাকুশলীকে পর্দা আলো করে থাকতে দেখে! বিদ্যা বালন, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি (খটখটে আইবি অফিসার ‘খান’-এর ভূমিকায় দুরন্ত অভিনয় করেছেন), মাসুদ আখতার আর দর্শন জারিওয়ালা ছাড়া প্রায় সব্বাই তো ‘দ্যাশে’র লোক! পরমব্রত-শাশ্বত-ইন্দ্রনীল-খরাজ-শান্তিলাল-ধৃতিমান-আবির-কল্যাণ-কুনাল-অনিন্দ্য-ফাল্গুনী-নিত্যপ্রিয়-কমলিকা। আর দুই শিশুশিল্পী। শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ের পুত্র ঋতব্রত (মোনালিসা লজের ‘রানিং হট ওয়াটার’। ছোট্ট ছোঁয়ায় সত্যজিৎ রায়ের প্রতি সুজয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য)। আর কৌশিক সেনের পুত্র ঋদ্ধি (চায়ের দোকানের পল্টু)। প্রত্যেকে ভাল অভিনয় করেছেন শুধু নয়, যেটা আগেই বলছিলাম, ছবিতে এঁদের প্রত্যেকের উপস্থিতিই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং গোটা দেশ যে এই ছবিটার সুবাদে বাংলার শক্তি-ভাণ্ডার দেখার সুযোগ পেল, সেটা বড় কম কথা নয়! তারই মধ্যে আলাদা করে বলতে হবে দু’জনের কথা। পরমব্রত আর শাশ্বত।
পুলিশ অফিসার সাত্যকির ভূমিকায় পরমব্রত এ ছবিতে বিদ্যার ছায়া-সঙ্গী। সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন। বিশেষত বিদ্যার প্রতি তাঁর চাপা অনুরাগ ঝিলিক দেওয়ার মুহূর্তগুলোয় তিনি অনবদ্য! আর শাশ্বত? কন্ট্র্যাক্ট কিলারের চরিত্রে তাঁকে দেখে আমাদের বিস্ময়ে বাক্ বন্ধ!
এ বার আসি বিদ্যা প্রসঙ্গে। এই শহর জানে তাঁর প্রথম অনেক কিছু। ‘ভাল থেকো’ দিয়ে প্রথম বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ। সহ-অভিনেতা ছিলেন পরমব্রত। ‘পরিণীতা’ হিন্দিতে প্রথম নায়িকার ব্রেক। তাতে ছিলেন খরাজ। ‘ভাল থেকো’, ‘পরিণীতা’, ‘কহানি’ একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল যেন! ‘ডার্টি পিকচার’-পরবর্তী বিদ্যা এখন যে উচ্চতায় রয়েছেন, সেখানে পৌঁছনো খুব কঠিন। তার চেয়েও কঠিন, সেখানে টিকে থাকা। ‘কহানি’ সে দিক থেকে বিদ্যার একটা বিরাট পরীক্ষা ছিল। বিদ্যা আবারও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট!!!
কী সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা যে খেলেছেন বিদ্যা! দৃঢ় এবং পেলব, উচ্ছল এবং বিষণ্ণ তিনি। একই সঙ্গে। বুদ্ধি এবং আবেগের মধ্যে সেখানে সংঘাত নেই। মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের মধ্যে দেওয়াল নেই। তাঁর ভয়, কান্না, খুনসুটি কোথাও তাঁকে অশক্ত করে না। তাঁর ধৈর্য, জেদ, নাছোড়পনা তাঁর লাবণ্যকে কোথাও ব্যাহত করে না। তাঁর জন্য চোখের জলে ভিজে গিয়েও বলে ওঠা যায় না, আহা বেচারি! কোথাও যেন মনে হতে থাকে, ওই বেঢপ পেটটা ওঁর দুর্বলতা নয়, শক্তি! বিদ্যার মতো অভিনেত্রী ছাড়া এতগুলো রং বিচ্ছুরিত হওয়া মুশকিল ছিল!
তবু আবারও বলব, ‘কহানি’ কেবলমাত্র বিদ্যার ছবি নয়! ‘কহানি’র মেরুদণ্ড, তার চিত্রনাট্য (ইচ্ছে করেই এই থ্রিলারের কোনও ‘কহানি’-চুম্বক এখানে দিলাম না)! ছোটখাটো কিছু গলদ যে নেই, তা নয় (সাত্যকি অর্জুনের বন্ধু, ‘সারথি’ নয়। ডাক্তার গাঙ্গুলি খুন হলেন, কিন্তু তাই নিয়ে তেমন হেলদোল দেখা গেল না!)। ইচ্ছাপূরণের লজিককে যে সব সময় অস্বীকার করা গিয়েছে তা-ও নয়! তবু, চিত্রনাট্যের মজবুত ইমারতটা ছাড়া এ ছবি সম্ভব হত না! অধিকাংশ সময় থ্রিলারে লাটাই গুটোনোর পর্বটায় সুতো আলগা হয়ে যাওয়ার যে ব্যাধি দেখা যায়, তুলনায় এ ছবি যথেষ্ট আঁটসাট। তার সঙ্গে আছে তুখোড় সম্পাদনা। ছবির লয় এবং সাসপেন্স ধরে রাখতে, গল্পের পাপড়ি একটা একটা করে খুলতে নম্রতা রাওয়ের কাঁচি লা-জবাব। তারপর আছে সেতু-র ক্যামেরা। এ শহরের হাড়-পাঁজরকে অপার রহস্যে মুড়ে পেশ করেছেন তো তিনিই! কলকাতা যে এই ছবির ‘পটভূমি’ হয়ে না থেকে ‘চরিত্র’ হয়ে উঠেছে, তার অনেকটা কৃতিত্বই তাঁর। এ বার যোগ করুন, আবহসঙ্গীত। কানের পর্দা কাঁপিয়ে ধাপে ধাপে চুড়োয় ওঠা ‘সাসপেন্স মিউজিকে’র রদ্দি ছক ছেড়ে শহরের নিজস্ব সাউন্ডস্কেপ অনেক বেশি জায়গা পেয়েছে ছবিতে। তার সঙ্গে আছে আরও এক বিখ্যাত বাঙালির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। আর ডি বর্মন। ‘ঝঙ্কার বিট্স’ থেকেই যাঁর প্রতি সুজয়ের ভালবাসা। তার জন্য বাহবা প্রাপ্য সিসিল সেরেজো-র। বিশাল-শেখরের সুরে একাধিক গান রেকর্ড হলেও ছবিতে ব্যবহার হয়েছে একটাই অমিতাভ বচ্চনের অদ্বিতীয় কণ্ঠে ‘একলা চলো রে!’
পরতে পরতে টুইস্ট-সম্পন্ন ‘কহানি’, তবে তুমি কার? সুজয় ঘোষের? বিদ্যা বালনের? গোটা টিমের? নাকি কলকাতার? িvদ্যা বাগচি থাকলে হেসে বলতেন, “ক্যায়া ফর্ক পড়তা হ্যায়?” |
|
|
|
|
|