কলকাতায় ৫০ কোটি
আর্সেনিক গবেষণাকেন্দ্র খাতে বরাদ্দ, উঠল প্রশ্নও
লকাতায় একটি বিশ্বমানের আর্সেনিক গবেষণাকেন্দ্র তৈরির জন্য বাজেটে ৫০ কোটি টাকা ধার্য করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। গত মাসে শহরে আর্সেনিক দূষণ সংক্রান্ত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এসে এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশ। শুক্রবার অর্থমন্ত্রী তাতেই সিলমোহর লাগালেন।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে এমন গবেষণাকেন্দ্রের আদৌ দরকার আছে কি না, সে প্রশ্নও ইতিমধ্যে উঠে গিয়েছে। এ রাজ্যে যাঁরা গত আড়াই দশক ধরে আর্সেনিক-দূষণ সংক্রান্ত গবেষণা ও সচেতনতাবৃদ্ধির কাজে যুক্ত, তাঁদের অধিকাংশের বক্তব্য: এখানে গবেষণাকেন্দ্রের চেয়ে বেশি জরুরি মানুষকে আর্সেনিক-মুক্ত পানীয় জল সরবরাহ, এবং দূষণে আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ওঁদের অভিযোগ, রাজ্য সরকারের বসানো গভীর নলকূপ থেকে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত জল বেরোচ্ছে, মানুষ তাই খাচ্ছেন। ন্যূনতম চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন না। জনস্বাস্থ্য বা স্বাস্থ্য দফতর থেকে নিয়মিত সমীক্ষাও হয় না। “যেখানে মানুষকে আর্সেনিকমুক্ত জল দেওয়া যাচ্ছে না, আর্সেনিক দূষণের ফলে ক্যানসারে আক্রান্তের চিকিৎসা হচ্ছে না, সেখানে ৫০ কোটি দিয়ে গবেষণাকেন্দ্র বানিয়ে কী লাভ?” প্রশ্ন তুলছেন ওঁরা।
রাজ্য অবশ্য মনে করছে, গবেষণাকেন্দ্রটি হলে আখেরে আর্সেনিক-পীড়িতদেরই লাভ। জয়রামকে তিনিই এটি গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে দাবি করে রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরিমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “পূর্বতন সরকার আর্সেনিক প্রতিরোধের কোনও প্রযুক্তিই স্থির করে উঠতে পারেনি। আমরা গবেষণাকেন্দ্রের মাধ্যমে সেটা করতে পারব। বিশ্বের কোথায় কী গবেষণা হচ্ছে, তার ফলাফল ভাগাভাগি করে নিতে পারব।” প্রস্তাবিত গবেষণাকেন্দ্রের জন্য কল্যাণীতে ৮ একর জমিও চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানান সুব্রতবাবু।
শুধু কি সঠিক প্রযুক্তির অভাবেই আর্সেনিক মোকাবিলার কাজ আটকে রয়েছে?
আর্সেনিক-বিশেষজ্ঞদের অনেকের অবশ্য তা মানতে নারাজ। বরং তাঁদের মতে, বামফ্রন্ট সরকার আর্সেনিক দূষণ মোকাবিলায় যে ভুল করেছিল, নতুন সরকার তা-ই করছে। পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক দূষণ নিয়ে গত পঁচিশ বছর ধরে গবেষণা করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজের অধিকর্তা দীপঙ্কর চক্রবর্তী। তাঁদের সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা জানাচ্ছে, রাজ্যের নতুন নতুন এলাকা আর্সেনিকের গ্রাসে পড়ছে। কী রকম?
দীপঙ্করবাবু বলছেন, “নদিয়ায় ৯৭টি প্রাথমিক স্কুলের নলকূপের জল পরীক্ষা করে দেখেছি, ৭৫টিতেই আর্সেনিক রয়েছে বিপজ্জনক মাত্রায়। উত্তর ২৪ পরগনায় ১৯৭টি প্রাথমিক স্কুলের ৩৬ শতাংশে একই ছবি। দেগঙ্গায় ৯০৭টি গভীর নলকূপের জল পরীক্ষা করেছি। তিনশোটিতেই আর্সেনিকের মাত্রা বিপজ্জনক!” তাঁর আক্ষেপ, “আমরা আগেই জানিয়েছিলাম, ওই সব নলকূপ থেকে ভবিষ্যতে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক উঠবে। এখন তা-ই উঠছে। তবু সরকার গভীর নলকূপ বসিয়েই দায় সারছে।”
সমস্যার সুরাহা কী?
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, নদী বা পুকুরের জল শোধন করে বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করাটাই আর্সেনিক মোকাবিলায় মূল প্রযুক্তি। কুয়োর জলও আর্সেনিকমুক্ত। কিন্তু তাঁদের অভিযোগ, রাজ্য সরকার এ সবের বদলে গভীর নলকূপে আর্সেনিক দূরীকরণ যন্ত্র লাগিয়ে জল সরবরাহে বেশি আগ্রহী। এতেই সমস্যা জটিল হয়েছে। আরও বেশি মানুষ দূষিত জল খাচ্ছেন। ক্যানসারের কবলে পড়ছেন। বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়ছে ফসলে, এমনকী গরুর দুধেও।
এবং এ হেন পরিস্থিতিরই প্রেক্ষিতে গবেষণাকেন্দ্র গড়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। গত পঁচিশ বছর যাবৎ আর্সেনিক-পীড়িত আট জেলায় সচেতনতাবৃদ্ধির কাজে যুক্ত অশোক দাসের মন্তব্য, “রাজ্যের কোনও হাসপাতালে আর্সেনিক দূষণে আক্রান্তদের চিকিৎসা হয় না! এসএসকেএমে একটা আর্সেনিক চিকিৎসাকেন্দ্র হলেও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আগে মানুষগুলোর চিকিৎসার ব্যবস্থা হোক। আর্সেনিকমুক্ত জল দেওয়া হোক। তার পরে তো গবেষণা!” আর দীপঙ্করবাবুর মন্তব্য, ‘‘এ যেন রুটি পাওয়া যাচ্ছে না বলে কেক খেতে বলা হল!”
পশ্চিমবঙ্গে আর্সেনিক দূষণে আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই কেন?
জনস্বাস্থ্য কারিগরিমন্ত্রীর জবাব, “আমার দায়িত্ব বিশুদ্ধ জল দেওয়া। চিকিৎসার ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতরকে জিজ্ঞাসা করুন।” অন্য দিকে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের দাবি, এ রাজ্যে আর্সেনিক দূষণ মোকাবিলা শুরু হওয়ার পর থেকে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কাজ হয় জনস্বাস্থ্য কারিগরির অধীনে। এসএসকেএমের আর্সেনিক চিকিৎসাকেন্দ্রটি কেন বন্ধ হয়ে গেল, সে সম্পর্কেও স্বাস্থ্য দফতরের কোনও ফাইলে কোনও নোট নেই বলে সূত্রটি জানিয়েছেন।
তবে আর্সেনিকের দাপট যে রাজ্যে দিন দিন বাড়ছে, সুব্রতবাবু তা স্বীকার করেছেন। তিনি নিজেই জানাচ্ছেন, “নতুন নতুন এলাকা আক্রান্ত হচ্ছে। যেমন বর্ধমানে আগে কম ছিল। এখন গোটা জেলাই আর্সেনিক-আক্রান্ত বলা চলে।” সরকার কি শুধু গভীর নলকূপে আর্সেনিক দূরীকরণ যন্ত্র বসিয়েই দায় সারতে চাইছে? সুব্রতবাবু বলেন, “ভূস্তরের উপরের জল শোধন করে সরবরাহে জোর দিচ্ছি। এ ব্যাপারে আমরা নতুন পরিকল্পনা নিয়েছি (ভিশন ২০২০)। আর্সেনিকের সঙ্গে ফ্লোরাইড, লবণাক্ত জলের বিপদ রয়েছে। তারও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।”
মন্ত্রীর এই আশ্বাসেও বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা কাটছে না। বরং তা বেড়েছে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর অন্য একটি ঘোষণায়। পূর্ব ভারতে সবুজ বিপ্লবকে ‘আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে’ বাজেটে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করেছেন প্রণববাবু। যে প্রসঙ্গে এক বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, “এখানে সেচের সুবিধা তেমন নেই। তাই আরও বেশি চাষ হওয়ার অর্থ মাটির নীচ থেকে আরও বেশি জল তোলা।”
এবং এতেই আর্সেনিক-দূষণের ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হবে বলে ‘অশনি সঙ্কেত’ দেখছেন ওঁরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.