ইনসুলিন না নিলে প্রাণ বাঁচবে না। আর তার জন্য কখনও কখনও দিনে দু’বারও রক্ত পরীক্ষা প্রয়োজন। কিন্তু সেই খরচ বহন করার ক্ষমতা কোথায় গরিব পরিবারে? এ দেশে টাইপ-ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের একটা বড় অংশের তাই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই ভবিতব্য ছিল। সে সমস্যা সমাধানে এ বার ভারত সহ মোট মোট ন’টি দেশে শুরু হচ্ছে শিশুদের টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস প্রতিরোধের বিশেষ প্রকল্প।
নিখরচায় ডাক্তার দেখানো বা ইনসুলিন পাওয়াই নয়, গ্লুকোমিটার, রক্ত পরীক্ষার স্ট্রিপ, এমনকী প্রয়োজনীয় অন্যান্য পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগও পাওয়া যাবে এই প্রকল্পে। সচেতনতা বাড়ানোর জন্য দেওয়া হবে প্রয়োজনীয় বইপত্রও। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস রোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগও পাবেন। পূর্বাঞ্চলে একমাত্র কেন্দ্র হিসেবে এই স্বীকৃতি পেয়েছে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতাল। বৃহস্পতিবার রাজ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু হল।
ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব পেডিয়াট্রিক এন্ডোক্রিনোলজি এবং অন্য দুটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, তাঞ্জানিয়া, উগাণ্ডা-সহ মোট ন’টি দেশে এই প্রকল্প শুরু হচ্ছে। এ দেশে এখনও পর্যন্ত টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে তেমন নির্ভরযোগ্য নথি নেই। আঠারো বছরের কম বয়সী রোগী সংক্রান্ত তথ্যের অভাব আরও বেশি। এসএসকেএমের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক শুভঙ্কর চৌধুরী বলেন, “১০০ জন শিশু বা কিশোর ডায়াবেটিস আক্রান্ত হলে তার মধ্যে পঞ্চাশ জনই টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর একমাত্র চিকিৎসা হল ইনসুলিন। বহু পরিবারেরই সেটা আয়ত্তের বাইরে। এই প্রকল্প বহু শিশুর বাঁচার রাস্তা খুলে দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।”
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের উপসর্গ কী? এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায় জানালেন, শরীরের বৃদ্ধি না হওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব, বমি, দুর্বলতা, সংক্রমণ সারতে না চাওয়া ইত্যাদি দেখলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, “টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে অনেক দেরিতে। কখনও কখনও ডায়াবেটিক কোমা হয়ে যাওয়ার পরে জানা যায়, রোগটা আসলে কী। শিশুদের অসুখ হলে চিকিৎসকেরা অন্য অনেক পরীক্ষানিরীক্ষাই করে থাকেন, কিন্তু রক্তে শর্করার পরিমাণ সহজে পরীক্ষা করেন না। আসলে বাচ্চাদের ডায়াবেটিসের আশঙ্কা অনেকেই করেন না। এই সচেতনতাটা এখন প্রয়োজন।”
ইদানীং বহু ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত ওজন, অনিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়া, দৈহিক পরিশ্রমের অভাবে শিশুরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু সেটা টাইপ টু ডায়াবেটিস। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে শরীরে ইনসুলিনের প্রবল ঘাটতি থাকে। তাই ইনসুলিন না নিলে রোগীরা স্বাভাবিক থাকতে পারে না। সরকারি হাসপাতালে গরিব রোগীদের জন্য নিখরচায় চিকিৎসার ব্যবস্থা আগেও ছিল। সেখানে কাগজে-কলমে বিনা পয়সায় ইনসুলিনের বন্দোবস্ত থাকলেও বহু সময়েই সরবরাহের অভাবে তা রোগীর হাতে পৌঁছয় না। এমনকী রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থাও রোগীর পরিবারকেই করতে হয়। নতুন এই প্রকল্পে একই ছাতার তলায় সমস্ত কিছুরই বন্দোবস্ত থাকবে বলে এসএসকেএমের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন।
প্রকল্পের অন্যতম চিকিৎসক সুজয় ঘোষের কথায়, “পৃথিবীর অন্যান্য দেশে শিশু বা কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের প্রকোপ নিয়ে যে তথ্য জানা যায়, ভারতের সঙ্গে সেটা বহু সময়েই মেলে না। আসল কথা হল, এখানে চিকিৎসার আওতায় আসা রোগীর সংখ্যা খুবই কম। অনেকেরই রোগ ধরা পড়ে না, কিংবা ধরা পড়লেও চিকিৎসার খরচ জোটানো যায় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার সামর্থ্য থাকলেও সচেতনতার অভাবে চিকিৎসকের কাছে আসেন না বাবা-মায়েরা।”
প্রশ্ন হল, এমন একটি প্রকল্পের খবর মানুষের কাছে পৌঁছবে কী করে? প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকেরা জানান, রাজ্যের অন্যান্য সরকারি হাসপাতাল তো বটেই, এমনকী যে চিকিৎসকেরা প্রাইভেটেও জুভেনাইল ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করেন, তাঁদের কাছ থেকে রোগীদের নাম-ঠিকানা নেওয়া হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যারা ডায়াবেটিস নিয়ে কাজ করে, তাদেরও সাহায্য নেওয়া হবে। |