বাস্তব বলছে এক কথা। অথচ ‘নীতি’র প্রশ্ন তুলে বাস্তবের উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে চলতে চাইছে রাজ্য সরকার। যদিও তাতে শেষরক্ষা হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই অন্তত দু’টি ক্ষেত্রে ‘নীতি’ হার মেনেছে ‘বাস্তব’-এর কাছে।
নীতিটা কী? বাস্তবই বা কী?
নীতি হল: কোনও পরিষেবার জন্য বাড়তি দাম না-নেওয়া। আর বাস্তব, ভর্তুকির ওই বিপুল চাপ সামলানোর মতো ক্ষমতা নেই রাজ্য কোষাগারের। নিট ফল: আয়-ব্যয়ের সমতা না-থাকায় ক্রমশ নিম্নগামী হয় পরিষেবার মান। যেমন, কয়লার বাড়তি দাম মেটাতে গিয়ে নাভিশ্বাস ওঠে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনে। সরকারি দুধ সংস্থায় লালবাতি জ্বলতে বসে। যাত্রী-ভাড়া না-বাড়ায় রাস্তা থেকে একের পর এক উধাও হতে থাকে বাস-মিনিবাস।
তবে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘অবাস্তব নীতি’ থেকে সরে আসতে শুরু করেছে রাজ্য সরকার। উদাহরণ, বিদ্যুৎ ও দুধ। কী রকম?
লোকসান সামাল দিতে সরকার বাধ্য হয়ে বিদ্যুতের দর বাড়িয়েছে। যদিও অনেকটা ‘চুপিসাড়ে।’ গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন দফায় বণ্টন কোম্পানির বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ইউনিট পিছু গড়ে ১ টাকা ২৬ পয়সা। এক বার বকেয়া মাসুল আদায়ে অনুমতিদানের মাধ্যমে, পরের দু’বার ফুয়েল সারচার্জ বৃদ্ধি মারফত। পাশাপাশি দুধের দাম বাড়ানো হয়েছে অদ্ভুত কৌশলে। মূল্যবৃদ্ধি না-হওয়ায় সরকারি দুধ-সংস্থা মাদার ডেয়ারি’র যখন ‘গণেশ উল্টানোর’ দশা, তখন সংস্থা কর্তৃপক্ষ বাজারে আনেন ‘মা শক্তি’ নামে একটি নতুন ব্র্যান্ড, যার দাম সাধারণ দুধের চেয়ে অনেকটাই বেশি। ক্রমশ ‘মা শক্তি’র উৎপাদন বাড়িয়ে সাধারণ দুধের উৎপাদন কমানো হচ্ছে। তাতেই ভার কমছে লোকসানের।
কিন্তু সরাসরি দাম না-বাড়িয়ে এ ভাবে ‘ঘুরপথ’ ধরা হচ্ছে কেন?
সরকারি কর্তাদের একাংশের ব্যাখ্যা: বাস্তব পরিস্থিতি যা-ই হোক, দাম না-বাড়ানোর ‘জনপ্রিয়’ পথ থেকে সরে আসতে পারছে না রাজ্যের বর্তমান সরকার। প্রশাসনিক মহলের খবর: বিদ্যুৎক্ষেত্রের সঙ্কট সম্পর্কে রাজ্যের বিদ্যুৎ-কর্তারা মুখ্যমন্ত্রীকে বারবারই ওয়াকিবহাল করছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, কয়লা-সহ উৎপাদনের অন্যান্য খরচ যে ভাবে বেড়েছে, তাতে মাসুল না-বাড়ালে বিদ্যুৎ উৎপাদন মার খেতে বাধ্য। সেটা হলে ব্যাপক লোডশেডিংয়ে আখেরে আমজনতাই ভুগবে। ধাক্কা খাবে শিল্প উৎপাদনও।
বস্তুতই, অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। এবং সরকার তা বুঝতে পেরেও গত নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ-মাসুল বাড়াতে দেয়নি। কিন্তু ডিসেম্বরে পরিস্থিতি যখন কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল, তখন সরকারের টনক নড়ে বলে বিদ্যুৎ দফতর সূত্রের খবর। তখনই ইউনিটপিছু ৪৪ পয়সা মাসুলবৃদ্ধির অনুমতি দেওয়া হয়। সূত্রের দাবি: মাসুল বাড়াতে না-দিলে যত ভর্তুকি দিতে হবে, তা জোগানোর ক্ষমতা যে রাজ্যের এখন নেই, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল এই ‘সত্যিটা’ শেষ পর্যন্ত তাঁকে বোঝাতে পেরেছিলেন বলেই মাসুল সংশোধনের অনুমতি মিলেছে।
ডিসেম্বরের পরে জ্বালানি সারচার্জ বাবদ আরও দু’দফায় সরকারি বিদ্যুতের দর বেড়েছে। বণ্টন-বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি গড় মূল্য ৪ টাকা ২৭ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ টাকা ৫৩ পয়সা। এতে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির ঘরে বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় আসবে বলে সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে। লোকসানের ভার কিছুটা লাঘব করতে পেরে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন বিদ্যুৎ-কর্তারা।
একই ভাবে দুধের ক্ষেত্রেও সরাসরি দাম না-বাড়িয়ে কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। মাদার ডেয়ারি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: সরকারের কাছে বারবার দুধের দাম বাড়ানোর আবেদন জানিয়েও লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত তুলনায় উন্নতমানের ‘মা শক্তি’ দুধের প্যাকেট বাজারে ছেড়ে লিটারপিছু দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অন্য দিকে কম দামের দুধের উৎপাদন ও বিক্রি ক্রমশ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা হলেও কোনও নতুন ব্র্যান্ডের উৎপাদন বাজারে ছাড়ার স্বাধীনতা আছে মাদার ডেয়ারি কর্তৃপক্ষের। তাঁরা এরই সুযোগ নিয়েছেন। এবং এতে সরকারি নির্দেশ ‘অমান্য করার’ও কোনও প্রশ্ন থাকছে না বলে সংস্থা সূত্রের দাবি।
ফল মিলেছে হাতে-নাতে। মাদার ডেয়ারি’র এক কর্তা জানিয়েছেন, গত ডিসেম্বরে যেখানে তাঁদের লোকসানের অঙ্ক ছিল তিন কোটি টাকার বেশি, জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৪ লক্ষে। ফেব্রুয়ারিতে আরও কমে ৩৪ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, ‘মা শক্তি’র মহার্ঘ দাওয়াইয়ে এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মাদার ডেয়ারি।
কিন্তু এমন কোনও ‘কৌশল’ এখনও প্রয়োগ করা হয়নি পরিবহণে। সরকারি বা বেসরকারি কোথাওই। রুগ্ণ বিভিন্ন সরকারি পরিবহণ নিগমকে ‘নিজের পায়ে’ দাঁড়াতে বলে তাদের কাছ থেকে ভর্তুকির খুঁটি সরিয়ে নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছে রাজ্য। অথচ যে সিদ্ধান্ত নিগমগুলোকে জিইয়ে তোলার ‘অক্সিজেন’ জোগাতে পারত, সেই সরকারি ট্রাম-বাসের ভাড়া বাড়ানোর কথা সরকার মুখেও আনছে না। আর দাম না-বাড়ানোর এই ‘জনপ্রিয়’ নীতির টানেই তারা বেসরকারি বাস-মালিকদেরও ভাড়াবৃদ্ধির অনুমতি দিতে নারাজ। তাই গত ক’বছর ধরে জ্বালানি ও যন্ত্রাংশের দাম দফায় দফায় বাড়লেও ভাড়া বাড়েনি বাস-মিনির। পরিণাম?
বাস-মালিকেরা জানাচ্ছেন, যে বাস এক বার খারাপ হচ্ছে, তা মেরামতির কথা ভাবা হচ্ছে না। একেবারে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার দরুণ গত ক’মাসে রাস্তায় বেসরকারি বাসের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। একই অবস্থা সরকারি বাসেরও। মেরামতির অভাবে পাঁচ পরিবহণ নিগমের বড় সংখ্যক বাস পথে নামানো যাচ্ছে না। এর সুরাহা কী?
সরকারি এক কর্তার বক্তব্য, “সুরাহা একটাই। ভাড়া বাড়ানো। সোজা পথে হোক বা ঘুরপথে, সরকারকে এক সময়ে ভাড়া বাড়াতেই হবে। না-হলে মানুষ রাস্তায় নেমে বাসই পাবেন না। বাস্তবে ক্ষতিটা তো তাঁদেরই!”
এখন প্রশ্ন, দুধ-বিদ্যুতের মতো পরিবহণে এই ‘বাস্তব’টা কবে বুঝবে রাজ্য?
যত দিন না বুঝবে, তত দিন রোজকার ভোগান্তির মাধ্যমে আমজনতাকে তার খেসারত দিয়ে যেতে হবে বলে সরকারি-কর্তাদের একাংশই আক্ষেপ প্রকাশ করছেন। |