দলের অন্দরে দীনেশ ত্রিবেদীকে ‘একঘরে’ করার কাজ শুরু করে দিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার এক দিকে যেমন তৃণমূল পরিষদীয় দলের বৈঠকে নাম না-করেও দীনেশের কড়া নিন্দা করেছেন মমতা, তেমনই মহাকরণে দাঁড়িয়ে তাঁর ‘আস্থাভাজন’ মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম সরাসরি আজ রেলমন্ত্রী দীনেশকে ‘মিরজাফর’ বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত, ববি দীনেশকে তৃণমূলের ‘বিদ্রোহী ও বিতর্কিত’ সাংসদ কবীর সুমনের সঙ্গে একই বন্ধনীতে ফেলে দিয়েছেন।
প্রত্যাশিত ভাবেই, মমতার সুরে গোটা পরিষদীয় দল দীনেশের নিন্দায় ‘সরব’ হয়েছে। মমতা ছাড়া ওই বৈঠকে দীনেশের কঠোর সমালোচনা করেছেন রাজ্যর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও। এমনকী, দীনেশের সমালোচনার পাশাপাশি মমতাও একধাপ এগিয়ে রেল-বাজেট সংক্রান্ত উদ্ভূত গোটা পরিস্থিতির পিছনে ‘অন্য খেলা’ আছে বলেও মন্তব্য করেন। মমতার ওই ‘ইঙ্গিত’ কংগ্রেসের প্রতি বলেই তৃণমূলের নেতা-বিধায়করা মনে করছেন।
দীনেশ, রেল বাজেট ও কংগ্রেসের প্রতি ইঙ্গিতের বিষয়টি জানাজানি হতে রাজ্য-রাজনীতিতে ‘চাঞ্চল্য’ তৈরি হয়। তৃণমূলের জোট শরিক কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব বলেন, “ওটা তৃণমূলের দলীয় বিষয়।” তিনি আরও একবার জানান, শাসক জোটের শরিক হওয়ায় অধিবেশনে কক্ষ-সমন্বয় করবেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় রেল বাজেট নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা থেকে শুরু করে দীনেশকে সরিয়ে মুকুল রায়কে রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে তিনি যে চিঠি পাঠিয়েছেন, সেই ঘটনাপ্রবাহ সবিস্তারে পরিষদীয় দলের বৈঠকে জানান মমতা। রেল বাজেট নিয়ে তাঁদের ‘প্রতিবাদে’র কারণ ব্যাখ্যা করে এ দিন মমতা বলেন, তৃণমূলের সংসদীয় দল ভাড়া বৃদ্ধি প্রত্যাহারের দাবি না-তুললে বিরোধী দলগুলি আন্দোলনে নামত। রেল-অবরোধ করত। সেই পরিস্থিতিতে রেলের যে ক্ষতি হত, তা এড়াতেই তৃণমূল সাংসদরা কেন্দ্রের কাছে ভাড়া বৃদ্ধি প্রত্যাহারের দাবিতে সরব হয়েছেন। |
|
রেল আইসিইউয়ে চলে গিয়েছে বলে দীনেশ দলনেত্রীকেই আক্রমণ
করেছেন। কারণ দীনেশের আগে
মমতাই রেলমন্ত্রী ছিলেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায় |
|
দীনেশকে যে তিনি দলে ‘একঘরে’ করতে চান, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা। উত্তর ২৪ পরগনার এক বিধায়ককে লক্ষ্য করে মমতা সরাসরি বলেন, ওই বিধায়কের সঙ্গে তো দীনেশের ভালই সম্পর্ক আছে! সেই বিধায়ক অবশ্য বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে তৃণমূলের অন্দরে এই তথ্য কারও অজানা নয় যে, জেলার গোষ্ঠী রাজনীতিতে ওই বিধায়ক এবং দীনেশ একদিকে। তাঁদের বিপক্ষে ‘ভাবী’ রেলমন্ত্রী, মমতার ‘কাছের নেতা’ মুকুল রায়।
এদিন বিধানসভার বাজেট অধিবেশন শুরুর ঘন্টাখানেক আগে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বৈঠক হয় তৃণমূল পরিষদীয় দলের। দলীয় নীতি না-মেনে রেল বাজেটে যাত্রীভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে রেলমন্ত্রী দীনেশের কঠোর সমালোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী-সহ পরিষদীয় দলের বিভিন্ন সদস্য। একইসঙ্গে অবশ্য মমতা জানান, উচ্চশ্রেণির ভাড়া বৃদ্ধি করলেও না-হয় বিষয়টা ‘আয়ত্তের’ মধ্যে থাকত। কিন্তু যে ভাবে নিত্যযাত্রী এবং সাধারণ শ্রেণির ভাড়াও বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা কোনওমতেই মেনে নেওয়া যায় না। দীনেশ বাজেট পেশের পর মমতা তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলেও এই কথা বলেছিলেন। যা থেকে দলের নেতাদের একাংশ এই ইঙ্গিত পাচ্ছেন যে, রেলের উচ্চশ্রেণির যাত্রীদের জন্য ভাড়া বৃদ্ধিতে তাঁর তেমন ‘আপত্তি’ ছিল না। বিশেষত, যখন কিছুদিন আগেই রেলের পণ্য-মাসুল বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং মমতা তাতে কোনও আপত্তি জানাননি। মমতার অবশ্য বক্তব্য, রেলের পণ্য-মাসুলও তাঁর অজ্ঞাতসারেই বৃদ্ধি করা হয়েছিল। পরিষদীয় দলের কয়েকজন সদস্য পরে বলেন, “আমাদের নেত্রী অত্যন্ত সংবেদনশীল। তিনি বৈঠকে পরিষ্কার বলেছেন, সাধারণ যাত্রীদের টিকিটের দাম বাড়ানোর আমরা বিরোধী। কিন্তু প্রয়োজনে রেলের উচ্চশ্রেণির ভাড়াবৃদ্ধি নিয়ে রেলমন্ত্রী দলনেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতেই পারতেন! আমাদের নেত্রী তো বলেননি, বাজেটের লরি-লরি কাগজপত্র তাঁকে দেখাতে হবে! দলীয় নীতি মেনে বাজেট করলে কোনও সমস্যাই ছিল না।”
কিন্তু ওই বিধায়করা মনে করছেন, পরিস্থিতি যেদিকে গিয়েছে, তাতে মমতার ‘কড়া অবস্থান’ নেওয়া ছাড়া কোনও রাস্তা ছিল না। দলের অন্দরে এবং প্রকাশ্যেও তাঁকে সেই ‘বার্তা’ দিতেই হত। দলীয় স্তরে যে ‘বার্তা’ তিনি নিজে দিয়েছেন। প্রকাশ্যে দিয়েছেন ফিরহাদ। বিধানসভার এদিনের অধিবেশন শেষের পর মমতার সঙ্গেই মহাকরণে যান ফিরহাদ। তারপর সেখানেই তিনি বলেন, “কবীর সুমনের মতো দীনেশ ত্রিবেদীও মিরজাফরের দলে পড়লেন। তাঁরা দু’জনেই দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। গরিব মানুষের উপর বাড়তি বোঝা না-চাপানো, জলকর না-বসানো, জোর করে জমি দখল না-করার যে নীতির উপর দাঁড়িয়ে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে দীর্ঘ আন্দোলন করে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেছেন, দীনেশ ত্রিবেদী তার বিরুদ্ধে গিয়েছেন। জনবিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছেন। ওই কাজ করার আগে তাঁর দল ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল।”
পরিষদীয় দলের প্রায় এক ঘন্টার বৈঠকে মুখ্য বক্তা ছিলেন মমতাই। দীনেশের নাম করে সুব্রতবাবু ‘ব্যঙ্গোক্তি’ করলেও মমতা একবারও রেলমন্ত্রীর নাম করেননি। তিনি দলের বিধায়কদের স্পষ্ট জানান, দলের শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে কেউ নন। তিনি মন্ত্রী হোন বা স্বয়ং তাঁর (দলনেত্রীর) প্রিয় কেউ। দলীয় নীতি ও শৃঙ্খলা কেউ ভাঙলে তা বরদাস্ত করা হবে না। মমতা বৈঠকে আরও একবার জানিয়ে দেন, রেলের ভাড়া বৃদ্ধি হলে সাধারণ মানুষের উপর বোঝা চাপানো হয়। এটা কখনই হতে দেওয়া যায় না। বৈঠকেই মমতা জানিয়েছেন, তাঁকে না-জানিয়েই সম্প্রতি রেলে পণ্য মাসুল বাড়ানো হয়েছিল।
মমতার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে সুব্রতবাবু বৈঠকে রেলমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেন, রেল আইসিইউ-তে চলে গিয়েছে বলে দীনেশ দলনেত্রীকেই আক্রমণ করেছেন। কারণ দীনেশের আগে মমতা রেলমন্ত্রী ছিলেন। ফলে রেলের দুরবস্থার জন্যে দীনেশ দলনেত্রীকেই দায়ী করেছেন! মহাকরণে ফিরহাদ বলেছেন, “বিগত বছরগুলিতে রেলকে আইসিইউ-তে পাঠানো হয়েছিল বলে রেলমন্ত্রীর মন্তব্য অত্যন্ত অন্যায় ও ঘৃণ্য। তিনি ভুলে গিয়েছেন, যাঁকে ইঙ্গিত করে তিনি ওই মন্তব্য করেছেন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দেখিয়েই তিনি নির্বাচনে জিতেছেন। তারপর সাংসদ ও মন্ত্রী হয়েছেন।” ফিরহাদের বক্তব্য, ‘‘দীনেশ ত্রিবেদী বা ফিরহাদ হাকিম কেউই দলের ঊর্ধ্বে নন। যাত্রী ভাড়া না-বাড়িয়ে রেলে চুরি বন্ধ করে, পণ্যবাহী করিডর তৈরি এবং তার ব্যবহার করে তিনি রেলের আয় বাড়াতে পারতেন। যেমন রাজ্যে গরিব মানুষের উপর জলকর না-বসিয়ে বাণিজ্যিক ও ক্ষমতাশালী গ্রাহকদের থেকে জলপ্রকল্প চালানো ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ উসুল করা হচ্ছে।”
বিধানসভা ভবনে বৈঠকের পর পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “রেলভাড়া বৃদ্ধি প্রত্যাহারের দাবি ও রেল বাজেট নিয়ে দলনেত্রীর সিদ্ধান্ত পরিষদীয় দলের সমস্ত সদস্য জোরাল ভাবে সমর্থন করেছেন।” দীনেশ-প্রসঙ্গ ছাড়াও বৈঠকে মমতা, সুব্রতবাবু, পার্থবাবু, সরকার পক্ষের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় চলতি বাজেট অধিবেশনে দলীয় বিধায়কদের ‘করণীয়’ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
বিরোধীদের মোকাবিলায় সদস্যদের সব বিষয় ‘গুরুত্ব দিয়ে জানা এবং বোঝা’র নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, অধিবেশন চলাকালীন এলাকায় কর্মসূচি রাখা চলবে না। ভাল করে ‘বাজেটের বই’ পড়তে হবে। যুক্তি-তর্ক দিয়ে অধিবেশনে বিরোধীদের মোকাবিলা করতে ‘পড়াশুনো’ করতে হবে। |