প্রশংসা প্রচুর। বিতর্ক নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট অধিবেশনের শুরুতে রাজ্যপালের ভাষণের এই হল নির্যাস।
প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘ ৩৬ পাতার যে ভাষণ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন বৃহস্পতিবার রাজ্য বিধানসভায় পাঠ করলেন (সভা ছাড়ার আগে তিনি ভাষণের দৈর্ঘ্য নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা এবং পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাল্কাসুরে খানিকটা কথাও বলে গিয়েছেন), প্রথা অনুযায়ী তা মহাকরণ তথা মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতরের তৈরি। যে মহাকরণ থেকে অহরহ ‘মা-মাটি-মানুষের সরকার’ শব্দবন্ধ উচ্চারিত হয়ে থাকে (রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীও তাঁর অধুনা-বিখ্যাত বাজেট-ভাষণ শুরু করেছিলেন সেই শব্দবন্ধ দিয়েই)। অথচ, রাজ্যপালের ভাষণে তা উচ্চারিত হল না!
এমন ‘নেই’ রাজ্যপালের ভাষণে আরও রয়েছে।
রাজ্যপালের লিখিত ভাষণের মধ্যে দিয়েই বাজেট অধিবেশন শুরু হল। গত বছরের ২০ মে শপথ নিয়েছে নতুন সরকার। আগামী ২৩ মার্চ এই সরকারের পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। স্বভাবতই অধিবেশনের শুরুতে রাজ্যপালের বক্তব্য নিয়ে কৌতূহল ছিল। দেখা গেল, সরকারের তৈরি ভাষণে গত ন’মাসের কোনও ‘বিতর্কিত’ বিষয়ই নেই। বরং রয়েছে গত ন’মাসে সরকারের বহুচর্চিত ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতিগুলিরই আবার উল্লেখ।
তথ্য বলছে, নতুন সরকারের আমলে গত ন’মাসে রাজ্যের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলির মধ্যে রয়েছে আমরির অগ্নিকাণ্ডে ৯৩ জনের মৃত্যু, মগরাহাটের
বিষমদ কাণ্ডে ১৭৩ জনের মৃত্যু, মগরাহাটেই পুলিশের গুলিতে দু’জনের মৃত্যু, পার্ক স্ট্রিট ও কাটোয়ায় ধর্ষণের অভিযোগ এবং মাওবাদী নেতা কিষেণজির মৃত্যুর ঘটনা। মমতা চান বা না-চান, এই প্রত্যেকটি বিষয় নিয়েই বিতর্ক হয়েছে। প্রতিটি বিষয়েই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা তাঁর বক্তব্য জানিয়েছেন। তা নিয়েও বিতর্ক হয়েছে বিস্তর। তার কোনওটিই রাজ্যপালের ভাষণে জায়গা পায়নি। রাজ্যে জমি-আন্দোলনের ফলে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় এসেছেন মমতা। রাজ্যপালের ভাষণে জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন নিয়েও কোনও কথা নেই। তবে শিল্পের জন্য ‘জমি-ব্যাঙ্ক’ প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাজ্যপাল। জানিয়েছেন, সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আইন তৈরি হলেও হাইকোর্টের রায়ের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। যে কথা মুখ্যমন্ত্রীও একাধিক বার জানিয়েছেন। রাজ্যপালের ভাষণে বলা হয়েছে, নতুন সরকারের ন’মাসে শিল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ-প্রস্তাব এসেছে। |
বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল। —নিজস্ব চিত্র |
বিভিন্ন জেলায় অভাবী বিক্রির জন্য এ বছর বেশ কয়েকজন চাষি আত্মহত্যা করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছিল। যেমন অভিযোগ উঠেছিল বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে শিশুমৃত্যু নিয়েও। কৃষকের আত্মহত্যার প্রশ্নে একটি ঘটনা স্বীকারও করে নিয়েছিল রাজ্য সরকার। রাজ্যপালের ভাষণে কৃষক-আত্মহত্যা নিয়ে কোনও উল্লেখ নেই। বরং বলা হয়েছে, পাঁচলক্ষের বেশি কিষাণ ক্রেডিট-কার্ড বন্টন করা হয়েছে। রাজ্যে ধান সংগ্রহের পরিমাণও গত বছরের এই মরসুমে যে সংগ্রহ ছিল, তার তুলনায় বেশি। শিশুমৃত্যু ঠেকাতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার উল্লেখ অবশ্য রাজ্যপালের ভাষণে রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি বিষয়েই লক্ষ্যণীয় উন্নয়ন হয়েছে’।
রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গত ন’মাসে নিয়ে মাঝেমধ্যেই মুখ খুলছিলেন রাজ্যপাল। ইদানীং অবশ্য তাঁর সুর অনেকটা ‘নরম’। তাঁর এদিনের ভাষণেও রাজ্য তথা কলকাতার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কোনও কথা নেই। শুধু জানানো হয়েছে, একটি শক্তিশালী, দক্ষ ও কার্যকর পুলিশবাহিনী গড়ে তুলতে রাজ্যপুলিশের অধীনে চারটি কমিশনারেট তৈরি হয়েছে। কলকাতা পুলিশের এলাকাও বাড়ানো হয়েছে।
সভার মধ্যে অবশ্য রাজ্যপাল নির্বিঘ্নেই তাঁর ভাষণ পাঠ শেষ করেছেন। যা গত কয়েক বছরে এ রাজ্যে বিরল। ভাষণ পাঠ করতে বাধা তো বটেই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেই বাধায় রাজ্যপাল ভাষণ পাঠ শেষও করতেও পারেননি। তৎকালীন প্রধান বিরোধীদল তৃণমূল সরকারের বিভিন্ন ‘ব্যর্থতার’ অভিযোগ তুলে রাজ্যপালকে বাধা দিয়েছে। এবার তা হয়নি। সরকারের সমালোচনায় বাম বিধায়কেরা স্রেফ গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে সভায় বসেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কেউ হইচই করেননি। সভায় বামফ্রন্টের তরফে উল্লেখযোগ্য একটি ‘অনুপস্থিতি’ এবং ‘উপস্থিতি’ ছিল। ছিলেন না প্রাক্তন মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা। এসেছিলেন জামিনে-মুক্ত প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষ। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং সিপিএমের বিধায়ক আনিসুর রহমানের সঙ্গে প্রথমসারিতেই বসেছিলেন সুশান্তবাবু। তাঁকে সভায় ঢুকতে দেখেই সরকার পক্ষের বিধায়করা কটূক্তি করা শুরু করেছিলেন। তাঁদের থামান সরকার পক্ষের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, মদন মিত্ররা।
বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু পরে বলেন, “অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার কাজ রাজ্যপালকে দিয়ে করানো হয়েছে। গত বার অর্থমন্ত্রী মাত্র সাত পাতার বাজেট বক্তৃতা করেছিলেন। আর রাজ্যপালকে এক ঘন্টা ২০ মিনিট দাঁড় করিয়ে কার্যত বাজেট বক্তৃতার কাজই করানো হল। রাজ্যপালকে দিয়ে কিছু অসত্য, অর্ধসত্য কথা বলানো হয়েছে। রাজ্যের মৌলিক সমস্যার কথা রাজ্যপাল উল্লেখ করেননি।” বিরোধী দলনেতার অভিযোগ, “আমরি-কাণ্ড, বিষমদে মৃত্যু, হাসপাতালে শিশুমৃত্যু, বিভিন্ন কলেজে ছাত্র-সংঘর্ষ, ফসলের দাম না-পেয়ে কৃষকের আত্মহত্যা, পার্ক স্ট্রিট ও কাটোয়ায় ধর্ষণ-সহ রাজ্যে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতনের কথা রাজ্যপালের ভাষণে উল্লেখ করা হয়নি। পাশাপাশি এমন কিছু সরকারি পরিকল্পনার ব্যাপারে বলা করা হয়েছে, যা ইতিমধ্যেই বামফ্রন্টের আমলে হয়েছে।” সূর্যবাবু জানান, রাজ্যপালের ভাষণের উপর বিতর্কে বামেরা যখন সংশোধনী পেশ করবেন, তখন এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলবেন। |
যা আছে |
• পাহাড় চুক্তি, জিটিএ গঠন
• জমি-ব্যাঙ্ক গঠনের প্রস্তুতি
• জমি ফেরাতে সিঙ্গুর-বিল
• শিশুমৃত্যু বন্ধে ব্যবস্থা
• মাওবাদী কার্যকলাপে লাগাম
• ২০ মাওবাদীর আত্মসমর্পণ
• প্রেসিডেন্সিকে উৎকর্ষ কেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত
• ৪ কমিশনারেট, কলকাতা পুলিশের এলাকা বৃদ্ধি
• শোকপ্রস্তাবে সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তা-র নাম |
যা নেই |
• আমরিতে ৯৩ জনের মৃত্যু
• বিষমদে ১৭৩ জনের মৃত্যু
• কৃষক আত্মহত্যা
• কিষেণজির মৃত্যু
• মগরাহাটে, নদিয়ায় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু
• কলেজে লাগাতার অশান্তি
• পার্ক স্ট্রিটে গণধর্ষণের অভিযোগ
• কাটোয়ায় ধর্ষণের অভিযোগ |
|
সূর্যবাবুর সঙ্গে একমত না-হলেও কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা মহম্মদ সোহরাবও মনে করেন, আমরি-কাণ্ড বা ফসলের দাম না-পেয়ে কৃষকের আত্মহত্যার কথা রাজ্যপালের ভাষণে থাকা উচিত ছিল। সোহরাব জানান, বিতর্কে অংশ নেওয়ার সময়ে কংগ্রেস বিধায়করা এ ব্যাপারে বলবেন। কংগ্রেসের ভূমিকা হবে ‘গঠনমূলক’ পরামর্শ দেওয়ার। তিনি বলেন, “রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের নানা কর্মসূচির কথা বলেছেন। আমরা চাই, ঘোষিত কর্মসূচি রূপায়িত হোক।” ঘোষিত কর্মসূচি রূপায়িত না-হতে পারে বলে কি তাঁদের আশঙ্কা? সোহরাব বলেন, “তেমন আশঙ্কা করছি না। সরকারের শরিক হিসাবে আমাদের দাবি, ঘোষিত কর্মসূচি রূপায়িত করতে হবে।”
পাহাড় ও জঙ্গলমহলের সমস্যার সমাধান তাঁর আমলে দু’টি বড় সাফল্যের ঘটনা বলে দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যপালের ভাষণেও বলা হয়েছে, ‘নতুন সরকার মাত্র দু’মাসের মধ্যে পাহাড়ের সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ করেছে। দীর্ঘদিন পর শেষ পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি স্থাপন সম্ভব হয়েছে। একই ভাবে, জঙ্গলমহলের পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সাধারণ মানুষ নতুন সরকারের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন’। বিরোধী দলনেতার মতে অবশ্য, “রাজ্যপাল জঙ্গলমহল ও পাহাড় সমস্যার সমাধানের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে কোনও সমস্যারই সমাধান হয়নি। বরং পাহাড়ে নতুন করে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।”
একটি বিষয় অবশ্য ‘নেই’-এর তালিকা থেকে বেরিয়ে রাজ্যপালের ভাষণে শোকপ্রস্তাবে জায়গা পেয়েছে। রাজ্যপালের নির্দেশেই। বর্ধমানে গণপ্রহারে নিহত সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তা-র নাম। |