মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখেও মুলায়ম সিংহ যাদবের সঙ্গে সমঝোতার প্রয়াস আজ আরও বাড়িয়ে দিলেন সনিয়া গাঁধী।
ক্ষুব্ধ মমতার ফ্যাক্সবার্তা পেয়ে রেল মন্ত্রক থেকে দীনেশ ত্রিবেদীকে অপসারণের ব্যাপারে গত রাতেই তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সেই জায়গায় মুকুল রায়ের অভিষেকে সম্মতির বার্তাও আজ দূরভাষে মমতাকে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। তবে প্রণব-মনমোহনের অনুরোধ ছিল, মন্ত্রিসভায় রদবদলের জন্য সংসদে সাধারণ বাজেট পেশ না হওয়া পর্যন্ত যেন ধৈর্য ধরেন মমতা। তৃণমূলের থেকে সেটুকু সময় কিনেই মুলায়ম সিংহের সঙ্গে দৌত্যের দরজা এ বার হাট করে খুলে দিল কংগ্রেস।
কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকে সনিয়া-মনমোহনের উপস্থিতিতে গত কালই এ বিষয়ে আলোচনা করেন দলের শীর্ষ নেতারা। মন্ত্রিসভা ও কংগ্রেসের গরিষ্ঠ অংশের বক্তব্য, মন্ত্রিসভায় রদবদল করে বা রেলের ভাড়া বাড়া নিয়ে মমতার উদ্বেগ নিরসনের চেষ্টা করে এ যাত্রা হয়তো বা উতরে যাওয়া যাবে। কিন্তু কে বলতে পারে, কাল-পরশুই আবার নতুন কোনও গোল বাধাবেন না মমতা! তাই রোজকারের ঝঞ্ঝাট ঝেড়ে ফেলে কংগ্রেস বরং মুলায়মের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করুক। সপা-কে সামিল করুক ইউপিএ-র মধ্যে। মমতার চেয়ে মুলায়ম অনেক মতিস্থির বলেই মনে করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
উত্তরপ্রদেশে ফল প্রকাশের পর থেকেই সপার সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা
শুরু করেছে কংগ্রেস। গত কাল রাত থেকে তা আরও গতি পেয়েছে। তার প্রতিফলনও আজ দেখা গিয়েছে লখনউয়ে লা-মার্টিনিয়ার কলেজের মাঠে অখিলেশ সিংহ যাদবের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। কংগ্রেস ও সরকারের তরফে দুই প্রবীণ নেতা মতিলাল ভোরা ও পবন কুমার বনশলকেই শুধু সেখানে পাঠিয়ে ক্ষান্ত থাকেননি সনিয়া। তাঁদের মাধ্যমে অখিলেশকে একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকতে পেরে দুঃখপ্রকাশ করে সনিয়া তাঁর শুভেচ্ছা বার্তা জানিয়েছেন সেই চিঠিতে। শপথ অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধি সুলতান আহমেদের সঙ্গে দেখা হয় ভোরা ও বনশলের। তাঁরা একই বিমানে দিল্লি ফেরার জন্য সুলতানকে আমন্ত্রণও জানান। কিন্তু অনুষ্ঠানের ভিড়ে শেষ পর্যন্ত আর দু’পক্ষে দেখা হয়নি বলে দিল্লি ফিরে জানান বনশল।
লখনউয়ের এই ছবির পাশে সংসদের অলিন্দে কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্যকে আজ একই বন্ধনীতে রাখা যেতে পারে। কংগ্রেস পরিবারে মমতার অতি বড় বন্ধু তথা কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অম্বিকা সোনিও আজ প্রকাশ্যেই বলেন, “যে ঘটনা ঘটেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। যদিও জোট রাজনীতিতে এমন ওঠাপড়া অসম্ভব নয়। কিন্তু গত কাল থেকে যে ঘটনাক্রম চলছে, তা সামগ্রিক ভাবে রাজনীতিকদের সম্পর্কে জনমানসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।” কপিল সিব্বল, জয়রাম রমেশ, সলমন খুরশিদের মতো কংগ্রেস মন্ত্রীদের যুক্তি, রেলভাড়া বাড়ানো নিয়ে জনমানসে বিশেষ অসন্তোষ নেই। তৃণমূল ছাড়া বাকি দলগুলি স্রেফ নাম কা ওয়াস্তে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সুতরাং এক দশক পর রেল যা-ও বা সংস্কারের পথে এগোল, তাকে ফের পিছন থেকে টেনে না ধরলেই ভাল! দল ও মন্ত্রিসভার আর এক শীর্ষ নেতার কথায়, মমতা দু’দিন ধৈর্য ধরতে রাজি হয়েছেন ঠিকই। মুকুল রায়কে রেলমন্ত্রী করে এবং ভাড়াবৃদ্ধি আংশিক প্রত্যাহার করে হয়তো তাঁকে এ যাত্রা তুষ্ট করাও যাবে। কিন্তু দু’দিনের মধ্যেই আবার কোনও বিষয়ে বিরোধ বাধতে পারে! কংগ্রেস একটি সূত্রের কথায়, “মমতার সমর্থন না থাকলে এখন সরকার পড়ে যাবে বলেই তিনি এই চাপের রাজনীতি করতে পারছেন! সপা-র সমর্থন সঙ্গে থাকলে তেমনটা চলবে না!”
তৃণমূলের পাল্টা যুক্তি, সপা-র সমর্থন নিলেও কেন্দ্রে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরু সুতোয় ঝুলবে। কারণ লোকসভায় তৃণমূলের তুলনায় সপা-র আসন মাত্র তিনটি বেশি। রাজ্যসভায় সরকার এমনিতেই সংখ্যালঘু। তার উপর মণিপুরে সাফল্যের পরে তৃণমূলের প্রতিনিধিত্ব এ বার আরও বাড়বে। সুতরাং কংগ্রেসকে শুধু সপা-র সমর্থন নিলে চলবে না, বহুজন সমাজ পার্টির সমর্থনও প্রয়োজন। উত্তরপ্রদেশের প্রবল দুই প্রতিপক্ষকে একই সঙ্গে দু’পাশে পাবে কংগ্রেস? কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, “মুলায়ম শরিক হলে হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠতা টায়-টায় হবে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে পতনেরও বিশেষ আশঙ্কা থাকবে না। গত আড়াই বছর ধরেই তো সপা ও বিএসপি ইউপিএ-র সমর্থক দল। তাতে কী অসুবিধা হয়েছে?” উপরন্তু মায়াবতী এখন যে রকম বিপাকে রয়েছেন, তাতে তাঁর পক্ষে খুব বেশি ‘বিপ্লবী’ হওয়া সম্ভব নয় বলেই আশা করছে কংগ্রেস। |
সে দিক থেকে দিল্লির দিগন্তে এক নয়া রাজনৈতিক সম্ভাবনা আজ উঁকি দিয়েছে। মুলায়ম যদি সবুজ-সঙ্কেত দেন, সরকার সে ক্ষেত্রে ভাড়াবৃদ্ধি আংশিক প্রত্যাহারের পথ থেকে পিছিয়ে আসার কথাও ভাবতে পারে। তখন মমতার পক্ষে সমর্থন প্রত্যাহার করা ছাড়া উপায়ান্তর থাকবে না। কংগ্রেস যে তলায় তলায় এই চেষ্টায় নেমেছে, তা তৃণমূল শিবিরও অনুধাবন করতে পারছে। তৃণমূল নেতারা মনে করছেন, যত শীঘ্র সম্ভব রেলমন্ত্রী পদে মুকুল রায়ের শপথ হয়ে যাওয়াই মঙ্গল। না হলে কে বলতে পারে রাজনীতির পাশা কখন বদলে যায়! সামগ্রিক এই পরিস্থিতিতে মুলায়মের সঙ্গে কংগ্রেসের দৌত্যের গতিপ্রকৃতি নিয়ে দিল্লির অলিন্দে বাড়ছে কৌতূহল। লখনউ থেকে দিল্লি ফেরার পরেই পবন বনশল আজ বলেন, “সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।”
কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করলে মুলায়ম সিংহ যাদবকে রেলমন্ত্রী করা যেতে পারে। পাশাপাশি মুলায়মের ঘনিষ্ঠ রামগোপাল যাদবকে রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান করার প্রস্তাবও দিচ্ছে কংগ্রেস। যদিও মুলায়ম ঘনিষ্ঠ সপা নেতাদের মতে, অতীতে কেন্দ্রে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন এই প্রবীণ সমাজবাদী। সেই সময়ে উত্তরপ্রদেশে তাঁর যা শক্তি ছিল, এখন তুলনায় অনেক বেড়েছে। সুতরাং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের থেকে কম মর্যাদার মন্ত্রক নিলে তাঁর মর্যাদার সমতুল হবে না। তবে কংগ্রেস পরিবারে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। অতীতে এনডিএ জমানায় অটলবিহারী বাজপেয়ী শরিক দলকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ছাড়লেও মনমোহন কিন্তু তা করেননি। স্বরাষ্ট্র, বিদেশ ও প্রতিরক্ষা কংগ্রেসের হাতেই রেখেছেন। মুলায়ম প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দাবিতে অটল থাকলে এ বার কংগ্রেসের ধর্মসঙ্কট হবে বই কি! তবে কংগ্রেসের অনেক নেতার বক্তব্য এখন পুরনো গোঁ ধরে রাখার জো দলের নেই।
ও দিকে সপা পরিবারের সবাই যে কেন্দ্রে সরকারে যোগ দিতে আগ্রহী তাও নয়। মুলায়মের ভাই শিবপাল যাদব ও আজম খানদের আপত্তি রয়েছে। সেই সঙ্গে এ-ও অভিযোগ উঠেছে, সব সাফল্যই কি বাবা ছেলে ভাগ করে নেবেন। বাকিদের কী হবে? সরকারে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী সপা নেতাদের অবশ্য যুক্তি, ইউপিএ-র শরিক হলে মুলায়ম ছাড়াও মন্ত্রিসভায় অন্তত আরও দুটি ক্যাবিনেট মন্ত্রক পাওয়ার ন্যায্য দাবি থাকবে সমাজবাদী পার্টির। সেই সঙ্গে আরও চার জন প্রতিমন্ত্রী হতে পারেন। এই সব সাত-সতেরো অঙ্ক নিয়েই সপা-কংগ্রেস দর কষাকষি এখন সপ্তমে। তাতে সামিল রয়েছেন আহমেদ পটেল, রাজীব শুক্ল, সলমন খুরশিদের মতো কংগ্রেসের রাজনৈতিক ম্যানেজারেরা। সেই সঙ্গে শিল্প মহলের একটা বড় ভূমিকাও রয়েছে বলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মত।
এর মধ্যে কংগ্রেস পরিবারে অবশ্য একটাই বাধা। তিনি হলেন রাহুল গাঁধী। সূত্রের খবর, মুলায়মকে মন্ত্রিসভায় সামিল করা নিয়ে এখনও কিন্তু-কিন্তু করছেন রাহুল। যদিও কংগ্রেসের প্রবীণদের বক্তব্য, দলের গরিষ্ঠ অংশের নেতাদের মনোভাবকেও রাহুলকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টাও চলছে। |