অর্থনীতি বনাম রাজনীতির
দ্বন্দ্বে প্রণব
দেশের অর্থনীতির হাল যে মোটেই ভাল নয়, তা দেখিয়ে দিল আর্থিক সমীক্ষা। সেই হাল শোধরাতে যে বেশ কিছু দাওয়াইয়ের প্রয়োজন, সে কথাও বলা হয়েছে আর্থিক সমীক্ষায়। যার মধ্যে রয়েছে ডিজেলের ভর্তুকিতে ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া, ধাপে ধাপে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ চালু করা, সরকারি ব্যয় সঙ্কোচের জন্য কাঠামোগত বদলের মতো কড়া নিদান। একই সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আজ সুদের হার অপরিবর্তিত রেখে অর্থ মন্ত্রকের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে, আগে রাজকোষ ঘাটতিতে লাগাম পড়ানো হোক।
এই আর্থিক সমীক্ষা এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অবস্থান প্রকাশের পরে শুক্রবার বেলা ১১টায় বাজেট পেশ করতে গিয়ে কী করবেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী? রাজকোষের ঘাটতি কমাতে গেলে হয় তাঁকে বাজেটে সরকারি ব্যয় কমানো বা ভর্তুকি কাটছাঁট করার মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অথবা করের হার বা করের পরিধি বাড়িয়ে আয় বাড়াতে হবে। শিল্পমহল চাইছে, শুধুই আয়-ব্যয়ের খতিয়ান হিসেবে বাজেটকে না দেখে একে লগ্নিকারীদের জন্য ‘ইতিবাচক বার্তা’ হিসেবে ব্যবহার করুন প্রণব। এই চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণববাবু কতখানি কী করতে পারেন, সেটাই প্রশ্ন। অর্থমন্ত্রী নিজে বলছেন, “সরকার কিছু পরামর্শ কার্যকর করতে পারে। কিন্তু আর্থিক সমীক্ষার সব কিছুই বাজেটে উঠে আসবে, তা আশা করা ঠিক নয়।”
চলতি অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৯%-এ আটকে থাকলেও অর্থমন্ত্রীর মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু আশা করছেন, ২০১২-’১৩ সালে বৃদ্ধির হার বেড়ে ৭.৬% হতে পারে।” তিনি বলেন, “এ বার আমরা এক ধাপ এগিয়ে ২০১৩-’১৪ সালের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৮.৬%-এ পৌঁছতে পারে বলেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছি। বিনিয়োগ ও সঞ্চয় বাড়লে যা অসম্ভব নয়।” শর্ত হল, ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানের অর্থনীতি-সহ আন্তর্জাতিক অর্থনীতির হাল শোধরাতে হবে এবং শিল্পের জন্য সুদের হার কমতে হবে। এ কথা বলে কেন্দ্র রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করলে কী হবে, গভর্নর ডি সুব্বারাও আরও অপেক্ষা করতে চান। তাই আজও সুদের হার ৮.৫%-এই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি (এনআইপিএফপি)-র অধ্যাপক পিনাকী চক্রবর্তীর যুক্তি, “বৃদ্ধির হার কমার প্রাথমিক কারণ কিন্তু শিল্পোৎপাদন কমে যাওয়া। কাজেই শিল্পমহলের দিকে সদর্থক বার্তা যাওয়া জরুরি। তাই সুদের হার কমানোও জরুরি।” কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর চাইছেন, আর্থিক শৃঙ্খলার পথে হেঁটে আগে রাজকোষ ঘাটতি কমানো হোক।
প্রশ্ন হল, এই পরিস্থিতিতে আগামিকালের বাজেটে কী করতে পারেন প্রণব মুখোপাধ্যায়?
নর্থ ব্লক সূত্রের খবর, এ বারও যে হেতু প্রত্যক্ষ কর বিধি (ডিটিসি) বা পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু করা সম্ভব হচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে নতুন ওই কর ব্যবস্থার অনেক কিছু আগামিকালের বাজেটেই ঘোষণা করা হতে পারে। যেমন ডিটিসি-র সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে আয়করে ছাড়ের সীমা আরও বাড়ানো হতে পারে। আর্থিক সমীক্ষায় পরিকাঠামোর উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষেত্রে লগ্নি টানতে বাজেটে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ড’-এ বিনিয়োগের সীমা ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হতে পারে। উল্টো দিকে, আরও বেশি পণ্যের উপর উৎপাদন শুল্ক বসানো হতে পারে। বাড়ানো হতে পারে পরিষেবা করের পরিধিও। ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার সময় উৎপাদন শুল্কের হার কমানো হয়েছিল। এখন আবার তা ১০% থেকে বাড়িয়ে ১২ বা ১৪%-এ নিয়ে যাওয়া হতে পারে। যাতে স্বাভাবিক ভাবেই শিল্পমহলের আপত্তি রয়েছে। সেই কারণে প্রণবের পক্ষে সরাসরি কর্পোরেট কর বাড়ানোও কঠিন।
আর্থিক সমীক্ষা
এক নজরে
• সার্বিক বৃদ্ধির পূর্বাভাস ৭ শতাংশেরও নীচে
• শিল্পোৎপাদন বাড়বে মাত্র ৪.৫%, কৃষি ২.৫%
• রাজকোষ ও রাজস্ব ঘাটতি বেঁধে রাখা যাবে না লক্ষ্যমাত্রায়
• ডিজেল, সারে ভর্তুকির বোঝা ছাড়িয়ে যাবে হিসেব বিশ্ব
আর্থিক সঙ্কটে বাড়ছে বৈদেশিক ঋণের খরচ
• শেয়ার, ঋণপত্রের বাজার থেকে শিল্প সংস্থার মূলধন সংগ্রহ তলানিতে
রাজকোষ ঘাটতিতে লাগাম পরাতে এ বার সামাজিক ক্ষেত্রের প্রকল্পগুলিতে বরাদ্দ মোট বাজেট সহায়তা (গ্রস বাজেটারি সাপোর্ট) খুব বেশি বাড়াতে চাইছিল না অর্থ মন্ত্রক। গত বছর বাজেট সহায়তা ১৮% বাড়িয়ে ৪.৪১ লক্ষ কোটি টাকা করা হয়েছিল। এ বার ১১%-র বেশি বাজেট সহায়তা বাড়াতে চাইছিলেন না অর্থমন্ত্রী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বারও বাজেট বহর ১৮% হারেই বাড়তে চলেছে বলে মন্ত্রক সূত্রের খবর। কারণ, সনিয়া গাঁধীর ‘রাজনৈতিক দর্শন’ মেনে একশো দিনের কাজ, বিভিন্ন গ্রামোন্নয়ন প্রকল্প এবং খাদ্য সুরক্ষা আইনের জন্যও অর্থ বরাদ্দ করতে হবে প্রণবকে। মূল্যবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং খাদ্য সুরক্ষা আইন কাযর্কর করতে হলে উৎপাদন বাড়াতে হবে কৃষিতে। তাই প্রণব পূর্বাঞ্চলে সবুজ বিপ্লবেও বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করতে চান। দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পিনাকীবাবুর মতে, “আমারও মনে হয় না, সরকার গ্রামোন্নয়নের মতো ক্ষেত্রে ব্যয় কমাতে পারবে। ফলে আয় বাড়ানোর চাপ থাকবে। অর্থমন্ত্রী বাজেটে কী করেন, সেটাই এখন দেখতে চাইছি।”
রাজকোষ ঘাটতি সামলানোর আর একটি উপায় হল, ভর্তুকিতে কাটছাঁট করা। গত বাজেটে পেট্রোপণ্য, সার ও খাদ্যে ভর্তুকির যে আনুমানিক হিসেব কষেছিলেন প্রণব, কার্যক্ষেত্রে তার থেকে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধিতার আশঙ্কায় ডিজেলের দাম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে পারেনি কেন্দ্র। আর্থিক সমীক্ষার নিদান হল, যে হেতু এখনই তা করা যাচ্ছে না, তাই আপাতত প্রতি লিটার ডিজেলে ভর্তুকির ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হোক। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও তেলের দাম বাড়বে। তবে আমজনতার কথা ভেবে তেলের দাম খুব বেড়ে গেলে ভর্তুকির পরিমাণও বাড়ানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির পুরো বোঝা সরকারকে বইতে হবে না। পেট্রোপণ্যের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করার কথাও বলা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্য খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েও মনমোহন-সরকারকে তা স্থগিত রাখতে হয়েছে। সেখানেও মধ্যপন্থা বাতলেছে আর্থিক সমীক্ষা। রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রথমে মেট্রো শহরগুলিতে এটা চালু করা যেতে পারে। কারণ, খাদ্যপণ্যে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে, কৃষকদের ফসলের জন্য বেশি দাম পাইয়ে দিতে এবং কৃষিক্ষেত্রে পরিকাঠামোর উন্নতির জন্যও বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন হলেও কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধি যোজনা কমিশনের লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়নি। তাই আজ আরও বেশি করে বিদেশি বিনিয়োগের পক্ষে সওয়াল করেছেন কৌশিকবাবু।
কিন্তু এই ধরনের আর্থিক সংস্কারের সামান্য কোনও আভাসও কি দেখা যাবে বাজেটে? প্রণব নিজে বলছেন, সব সম্ভব নয়। কৌশিক বসু বলছেন, “আর্থিক শৃঙ্খলার পথ থেকে সরকার সরবে না। কিন্তু খুব বেশি আর্থিক সংস্কার হবে বলে মনে হয় না।” প্রাক্তন অর্থসচিব এস নারায়ণ বলছেন, “আদর্শগত ভাবে কী করা উচিত, আর্থিক সমীক্ষা সে কথা বলে। কিন্তু বাজেট হয় রাজনৈতিক বাস্তব মেনে। দুইয়ের মধ্যে ফারাক তাই দিনদিন বাড়ছে।”
চলতি বছরে রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪.৬%। পরের দু’বছরে যা ৪.১% ও ৩.৫%-এ নামিয়ে আনার কথা। কিন্তু এ বছর আশানুরূপ রাজস্ব আয় হয়নি। শিল্পোৎপাদন কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেল ও অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সরকারি ব্যয় বেড়েছে। শেয়ার বাজারের টালমাটাল অবস্থার জন্য বিলগ্নিকরণও হয়নি। আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্টের ভাষায়, “এটা এমন এক ব্যতিক্রমী বছর, যেখানে কোনও কিছুই সরকারের হিসেব মতো চলেনি।” ঘাটতিতে রাশ টানতে তাই নতুন করে রূপরেখা তৈরির কথা বলা হয়েছে আর্থিক সমীক্ষায়।
অর্থনীতির যুক্তি মেনে বাজেটে কী করা উচিত, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তব মেনে নিয়ে অর্থমন্ত্রী কী করতে পারবেন, প্রশ্ন এখন সেইটাই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.