‘প্রণব মুখার্জিকো গুস্সা কিঁউ আতা হ্যায়?’
আজকাল বিভিন্ন দলের নেতা, এমনকী বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও এই প্রশ্ন করছেন।
আগামিকাল প্রণববাবুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সপ্তম পূর্ণাঙ্গ বাজেট। তার আগে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর মেজাজটা মোটেই নিয়ন্ত্রণে নেই।
কেন? গত বছর বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, সরকার খুব শীঘ্রই পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি) চালু করবে। প্রত্যক্ষ কর বিধি (ডিটিসি) চালু করবে। এই দু’টি সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়াও সাধারণ ভাবে ব্যাঙ্ক, বিমা ও পেনশন ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের চেষ্টায় ব্রতী হবে সরকার। এক বছর পর দেখা যাচ্ছে, প্রণববাবু এর কোনওটিই বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হননি। বছরের অনেকটা সময়ই কেটে গিয়েছে ইউপিএ শরিকদের মানভঞ্জন করতে। তার উপর গোটা দুনিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিকূল। যার প্রভাব পড়ছে এ দেশের অর্থনীতিতেও। এই পরিস্থিতিতে রাজনীতি আর সংস্কারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার কাজটা মোটেই সুখের নয়।
ভারতে প্রথম বাজেট হয়েছিল ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মানদণ্ড ব্রিটিশ রাজদণ্ডে পরিণত হওয়ার মাত্র দু’বছর পর। আর স্বাধীন ভারতে প্রথম বাজেট পেশ হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২৬ নভেম্বর। সে দিন বাজেট পেশ করেছিলেন আর কে ষণ্মুখম চেট্টি। তার পর ৬৪ বছর কেটে গিয়েছে। যে সময়কালের একটা দীর্ঘ অংশ ধরে প্রণববাবু কখনও ইন্দিরা গাঁধীর ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের অর্থনীতির প্রধান প্রবক্তা। আবার কখনও নরসিংহ রাওয়ের আর্থিক উদারীকরণের অগ্রদূত। এহেন পোড় খাওয়া প্রণববাবুর কাছেও এটা মোটেই সুখের সময় নয়।
কারণ, সরকারের খরচ যত, রোজগার তত নয়। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর এই সমস্যা যখন সংসারে হয়, তখন গৃহস্থ বিলাসিতা ত্যাগ করে ব্যয় সঙ্কোচের পথে হাঁটে। কিন্তু দলের একাংশ আর জোট রাজনীতির চাপে সেই কঠোরতা কি আগামিকাল দেখানোর সাহস পাবেন প্রণববাবু?
বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি আজ বলেন, “দীনেশ ত্রিবেদীর বাজেটে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আঙুলের ছাপ রয়েছে, ফলে প্রণববাবু নিজেও আগামিকাল কঠোর পথনির্দেশ দেবেন, এমনটা মনে করা যেতে পারে।’’ অন্য দিকে, সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি আর্থিক সমীক্ষা দেখে বলছেন, “যে সমস্ত দাওয়াই এই রিপোর্টে দেওয়া হয়েছে, তা যদি আগামিকাল সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত করতে চাওয়া হয়, তা হলে বুঝতে হবে নব্য উদারবাদীরাই কংগ্রেসের বাজেটকে কব্জা করছে।” |
কঠোর না-হলে যে প্রণবের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন, সেটা স্বীকার করছেন কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরাই। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “তা না-হলে তো সব খাতে বরাদ্দ জোগাতে প্রণববাবুকে ম্যাজিক দেখাতে হবে!” কঠিন পরিস্থিতির মূল কারণ, আর্থিক ঘাটতির করুণ চিত্র। আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও বাজেট ম্যানেজমেন্ট আইন (এফআরবিএম) অনুসারে ২০১৪ সালে আর্থিক ঘাটতি মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা ৫.৫%-এ গিয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা করছেন অনেক অর্থনীতিবিদই। বিবেক দেবরায়ের কথায়, “আর্থিক ঘাটতি ৪.৫% হওয়াটাও অঙ্ক অনুযায়ী অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।”
এর বিপরীতে খরচের বহর কিন্তু কমছে না। শুধু খাদ্য সুরক্ষ্য বিলের জন্যই প্রায় ১ লক্ষ ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করার কথা। প্রণববাবু চান বা না-চান, দলীয় ইস্তাহারের মর্যাদা রেখে কিছুটা বরাদ্দ তাঁকে করতেই হবে। ইতিমধ্যে একশো দিনের কাজের জন্য ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজকোষ থেকে গিয়েছে। সেটাও সুষ্ঠু ভাবে ব্যবহার হচ্ছে না বলে বিভিন্ন রাজ্য থেকে অভিযোগ এসেছে। পেট্রোপণ্যে ভর্তুকি দিতে এখন বছরে খরচ হচ্ছে ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সারে ভর্তুকি দিতে ৭১ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো প্রকল্পে বাধ্যতামূলক খরচ তো রয়েছেই।
এই পরিস্থিতিতে রোজগার বাড়ানোর একটা রাস্তা ছিল, প্রণববাবু যদি বিলগ্নিকরণ করতে পারতেন। কিন্তু সেটাও করা যায়নি মূলত দু’টি কারণে। একটা রাজনৈতিক, অন্যটি অর্থনৈতিক। রাজনীতির ময়দানে শরিক দলের বাধা তো রয়েছেই, কংগ্রেসের এক দল নেতানেত্রীও মার্ক্সবাদী কায়দায় বিলগ্নিকরণের বিরোধিতায় সরব। তার উপর আছে সংসদে বিজেপি এবং সিপিএমের আপত্তি। এর পরেও চলতি আর্থিক বছরে বিলগ্নিকরণ করে ৪০ হাজার কোটি টাকা রোজগারের যে পরিকল্পনা প্রণববাবু করেছিলেন, তা পূরণ করা যায়নি শেয়ার বাজারের বেহাল দশার কারণে। একেবারে শেষ বেলায় ওএনজিসি-র বিলগ্নিকরণ করে ১২ হাজার কোটি টাকা তোলার চেষ্টাও শেয়ার বাজারে উৎসাহের অভাবে ভেস্তে যেতে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত এলআইসি শেয়ার কিনে অবস্থা সামাল দেয়। যার সমালোচনা করে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা যশবন্ত সিন্হার বলেছেন, “বাঁ হাতকে দিয়ে ডান হাতকে টাকা দেওয়ানোর মতো অবস্থা।” এর ফলে এলআইসি-ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিজেপির অভিযোগ।
আয় বৃদ্ধির আর একটা পথ ছিল প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থার সংস্কার এবং জিএসটি চালু করা। চলতি অর্থবর্ষেই এই দুই সংস্কার বাস্তবায়িত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের এমপাওয়ার্ড কমিটির প্রধান হিসেবে অসীম দাশগুপ্ত যে দ্রুততায় জিএসটি চালুর কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, বিহারের অর্থমন্ত্রী সুশীল কুমার মোদী দায়িত্বে আসার পরে তা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। উল্টে তাঁর দল বিজেপি এবং অন্য আঞ্চলিক দলগুলির আপত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে জিএসটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
প্রত্যক্ষ কর বিধি আবার আটকে রয়েছে লোকসভায়। সংসদে রাজনৈতিক অস্থিরতায় যে ৯৭টি বিল পাশ করানো সম্ভব হচ্ছে না, তার অন্যতম ডিটিসি। আটকে রয়েছে জমি অধিগ্রহণ আইনও। যার জেরে দেশে শিল্পায়নের গতি কার্যত রুদ্ধ। সড়ক নির্মাণ ব্যহত হচ্ছে। পরিকাঠামো গড়ে উঠছে না। এমনকী কয়লার সঙ্কটও তৈরি হয়েছে। শিল্পের পরিবেশ যদি তৈরি না হয়, তা হলে আর্থিক বৃদ্ধি হবে কী ভাবে?
তা হলে কী করবেন প্রণববাবু? বিবেক দেবরায় বলেন, “১৯৯১ সালের পর মনমোহন সিংহ নিজে আমদানি শুল্কের ক্ষেত্রে সংস্কার করেছিলেন। যশবন্ত সিন্হা দেশীয় পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে সংস্কার করেছিলেন। আমি প্রণববাবুর বাজেটে দেখব, তিনি খরচের প্রত্যাশিত বৃদ্ধিকে কতটা কমাতে পারেন? আশা করব, কর সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্তত একটা পথরেখা দেখাবেন।” রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর বিমল জালান আবার আগামিকালের বাজেট থেকে কোনও আশাই করছেন না। তাঁর কথায়, “নীতি রূপায়ণের ব্যাপারে এই সরকার পঙ্গু হয়ে পড়েছে। একের পর এক নীতি বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হচ্ছে তারা। ফলে এই বাজেট থেকে খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা করার সাহস হচ্ছে না।”
আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে শিল্পায়নে উৎসাহ জোগানোর পথ খুঁজতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে সুদের হার কমানো যায় কি না, তা ভেবে দেখতে বলেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু আরবিআই-এর পাল্টা বক্তব্য, সরকার খরচ কমাচ্ছে না। ফলে মূল্যবৃদ্ধির হার প্রত্যাশা মতো কমছে না। এখন সুদের হার কমালে তো জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়ে যাবে!
এই সহজ-সরল সত্যটা প্রণববাবুও বোঝেন। কিন্তু তিনি যে ভাবে চান সেই ভাবে দেশের অর্থনীতির পথনির্দেশিকা দিতে পারছেন কই! খরচের উপর নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি তো শুধু তাঁর হাতে নেই। জোট রাজনীতির অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, জনমোহিনী নীতি নেওয়ার জন্য দলীয় চাপ অর্থনীতিকে কোথায় নিয়ে যাবে এ নিয়ে প্রণববাবুর মনে যত প্রশ্নই থাক, তাঁর হাত-পা কিন্তু বাঁধা। তাই পোড়খাওয়া রাজনীতিকও আজ কথায় কথায় রেগে ওঠেন।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা হয়ে কৌশিক বসু যে দিন বিদেশের অধ্যাপনা ছেড়ে নর্থ ব্লকে পা রেখেছিলেন, সে দিন তাঁকে অবাক করে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল এক জন। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে তিন-চার জন এগিয়ে এসে অ্যাটাচি-ল্যাপটপ নিয়ে নিয়েছিল তাঁর হাত থেকে। তাঁকে এসকর্ট করে নিয়ে গিয়েছিল নর্থ ব্লকের একতলায় তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে। কৌশিকবাবু সে দিনই বুঝেছিলেন, সরকারি নিয়মতন্ত্র কী জিনিস!
সেই নিয়মতন্ত্রের মধ্যেই প্রণববাবুর পাশে থেকে ‘জনপ্রিয়তা’ নামক ভয়াবহ রাজনীতির সঙ্গে লড়াই করার চেষ্টা চালাচ্ছেন কৌশিকবাবু। চেষ্টা চালাচ্ছেন, শত বাধার মধ্যে কিছুটা সংস্কারের অভিমুখ বের করার। ভর্তুকিরাজ কমিয়ে সংস্কারের একটা নতুন অধ্যায় শুরু করার। শেষ রক্ষা হবে কিনা, জানা যাবে আজ মধ্যাহ্নে, লোকসভায়।
|
চলতি অর্থবর্ষে পিএফে সুদ কমে ৮.২৫% |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বাজেট পেশের এক দিন আগেই কর্মচারী ভবিষ্যনিধি তহবিলে (পিএফ) সুদের হার এক ধাক্কায় ১২৫ বেসিস পয়েন্ট কমাল কেন্দ্র। চলতি ২০১১-’১২ আর্থিক বছরের জন্য ৮.২৫% সুদ ধার্য হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রক। এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে ৪ কোটি ৭০ লক্ষ কর্মচারীর উপর। ২০১০-’১১ সালে পিএফে সুদ ছিল ৯.৫০%। এ বছর তা ৮.৬% করার প্রস্তাব দেয় শ্রম মন্ত্রক। কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, ৮.৫% হারে সুদ দিতে হলেও ৫২৬ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি হত। শ্রমসচিব এম ষড়ঙ্গি বলেন, “পিএফ তহবিলের পক্ষে যা দেওয়া সম্ভব, সেই সুদ দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রক।” রাজকোষ ঘাটতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্তকে সাহসী বলে আখ্যা দিয়েছেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। তবে পিএফ অছি পরিষদের সদস্য, শ্রমিক নেতা শঙ্কর সাহা বলেন, “চড়া মূল্যবৃদ্ধির জমানায় এই সুদের হার দুঃখজনক। এখন ব্যাঙ্কের স্থায়ী আমানতেও এর থেকে বেশি সুদ পাওয়া যায়।” |