প্রত্যাশিত ভাবেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভায় বামফ্রন্টের প্রার্থী হলেন সিটুর সাধারণ সম্পাদক তপন সেন। রাজ্য বিধানসভায় শক্তির বিন্যাসে এক জন প্রার্থীকেই জেতাতে পারবে বামেরা। তপনবাবুকে সেই আসনের জন্য প্রার্থী করেও শেষ বেলায় অন্য একটি ‘সম্ভাবনা’র দরজা খুলে রাখা হল বামেদের তরফে।
নিজেদের প্রার্থীকে জেতানোর পরেও বামেদের হাতে ১২টি বাড়তি ভোট থাকবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার পঞ্চম আসনটিতে কংগ্রেসের তরফে কোনও ‘সর্বসম্মত’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ প্রার্থী থাকলে বামেরা বাড়তি ভোট দিয়ে তাদের সাহায্য করতে পারে কি না, এই সম্ভাবনার দরজা পুরোপুরি বন্ধ করে দিচ্ছেন না সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব। অতীতে যেমন ঘটনা ঘটেছিল শঙ্কর রায়চৌধুরী বা অর্জুন সেনগুপ্তের ক্ষেত্রে।
|
তপন সেন |
নিজেদের শক্তিতে তৃণমূল এ বার তিনটি আসন জিততে পারবে। এর পরে বাকি আসনটির জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সমঝোতা হয়ে গেলে বামেদের ‘সম্ভাবনার অঙ্ক’ অবশ্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করার নিশ্চয়তা দেননি। এমতাবস্থায় রাজ্যের শাসক জোট এবং ইউপিএ-র মধ্যে ‘বিভাজন’ উস্কে দিতে কংগ্রেসের ‘সর্বসম্মত’ প্রার্থীকে বামেরা শেষ পর্যন্ত ভোট দেয় কি না, তা-ই এখন দেখার। তবে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের একাংশ মনে করে, ইউপিএ-২ সরকারের এখন যা অবস্থা, তাতে কংগ্রেসের প্রার্থীকে সমর্থন করতে যাওয়ার মধ্যে ‘ঝুঁকি’ও আছে যথেষ্ট।
কলকাতায় মঙ্গলবার বামফ্রন্টের বৈঠকে তপনবাবুকেই রাজ্যসভায় পুনর্মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকের পরে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, “বামফ্রন্টের ৬১ জন বিধায়কই তপনবাবুকে ভোট দেবেন।” কিন্তু একই সঙ্গে সম্ভাবনার একটি দরজাও খোলা রেখেছেন বিমানবাবু। অতীতে অর্জুন সেনগুপ্ত বা এস এম মালিহাবাদির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, বামফ্রন্টের অতিরিক্ত ভোট কংগ্রেসের ‘গ্রহণযোগ্য’ প্রার্থীকে দেওয়ায় তিনি জিতে রাজ্যসভায় গিয়েছেন। এ বারও কি তেমন কোনও সম্ভাবনা রয়েছে? কারণ, রাজ্যসভায় সদস্য পাঠাতে কংগ্রেসের ৪২ জন বিধায়কের পরেও অতিরিক্ত ভোট দরকার। জবাবে বিমানবাবু বলেন, “কংগ্রেসের কোনও প্রার্থী, যিনি বামেদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবেন, তাঁকে ভোট দেওয়া নিয়ে বামফ্রন্টের বৈঠকে কোনও আলোচনা হয়নি। সিদ্ধান্তও হয়নি। তবে তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তখন আমাদের আলোচনা করতে হবে।” অর্থাৎ কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে ‘বিভাজন’ করতে এমন সম্ভাবনার পথ বিমানবাবুরা খুলে রাখছেন।
একই ভাবে দিল্লিতে এমন সম্ভাবনা মাথায় রাখার কথাই বলেছেন সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্য। ওই নেতার কথায়, “অতীতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রথম ইউপিএ সরকারের জমানায় বামেরা যখন কংগ্রেসকে বাইরে থেকে সমর্থন করছিল, তখন কংগ্রেস অর্জুন সেনগুপ্তকে প্রার্থী করলে তাঁকে জিতিয়ে আনতে সিপিএম সাহায্য করেছিল।” একই সঙ্গে সিপিএমের ওই নেতার দাবি, ইউপিএ-জমানার আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯৯ সালে কংগ্রেস অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরীকে প্রার্থী করে। সে সময়ও বামেরা তাদের অতিরিক্ত ভোট শঙ্করবাবুকে দিয়েছিল।
সিপিএম সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, এ বারে কংগ্রেসের দিক থেকে তেমন কোনও ‘প্রস্তাব’ এখনও আসেনি বা কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনাও হয়নি। কিন্তু কংগ্রেস তেমন কাউকে বাছাই করতে পারলে তাঁকে সাহায্য করার কথা ‘ভেবে দেখতে’ পারে সিপিএম। এমনিতেই জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের সঙ্গে শরিক দল তৃণমূলের যে রকম টানাপোড়েন চলছে, সেই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে ‘দূরত্ব’ আরও বাড়ানোরও একটা সুযোগ মিলবে বলে সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছেন। সেই জায়গা থেকেই আসছে কংগ্রেসের প্রার্থীকে সমর্থন করে তৃণমূলকে টেক্কা দেওয়ার সম্ভাবনা।
কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে ফাটল বাড়ানোর চেষ্টাই এ দিন করেছেন সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি বলেন, “ইউপিএ-সরকারের যে সব শরিকদের কংগ্রেসের নীতি পছন্দ হচ্ছে না, তাদের জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসা উচিত।” এই বার্তা কি তৃণমূলের জন্য? ইয়েচুরির উত্তর, “বিচক্ষণদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট!” শুধু তৃণমূল নয়, ডিএমকে-র মতো শরিকেরাও যে ভাবে সংসদে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সেটাও ‘বিরক্তিকর’ বলে মন্তব্য করেন ইয়েচুরি। তবে তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করলে তাঁরা সমর্থন দেবেন কি না, সেই প্রশ্ন খারিজ করে দিয়েছেন সিপিএম নেতা। ইয়েচুরির যুক্তি, যত ক্ষণ সমাজবাদী পার্টি এবং বিএসপি মনমোহন-সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করছে, তত ক্ষণ সরকারের পতন বা অন্তর্বর্তী নির্বাচনের কোনও প্রশ্ন নেই।
প্রসঙ্গত, তপনবাবুর নাম চূড়ান্ত হয়ে গেলেও সিপিএম এবং ফ্রন্ট শরিকদের একাংশের মধ্যে তাঁকে নিয়ে ‘আপত্তি’ ছিল। যদিও প্রকাশ্যে মন্তব্য করে কেউ বিতর্কে জড়াতে চাননি। ওই নেতাদের মত, রাজ্যসভায় পরপর এমন দু’জনকে (ইয়েচুরির পরে তপনবাবু) প্রার্থী করা হল, যাঁদের সঙ্গে রাজ্য-রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। এতে নিচু তলার কর্মী এবং বাম সমর্থকদের মধ্যেও ‘ভুল বার্তা’ যাচ্ছে। ফ্রন্টের বৈঠকে অবশ্য বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা তোলেননি। কেন কিছু বলেননি? প্রশ্নের জবাবে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আরএসপি-র ক্ষিতি গোস্বামী, সিপিআইয়ের মঞ্জুকুমার মজুমদার বা ফরওয়ার্ড ব্লকের নরেন চট্টোপাধ্যায়েরা বলেন, ‘সিপিএম কাকে প্রার্থী করবে, তা নিয়ে তো তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেই ছিলেন! আপত্তি করে লাভ কী হত?’
কিন্তু একাধিক শরিক নেতা মনে করেন, রাজ্যের কাউকে প্রার্থী করলে ভাল হত। একই কথা সিপিএমের একাধিক রাজ্য কমিটির সদস্যেরও। তাঁদের বক্তব্য, “এর আগে তপনবাবুকে যখন সিটুর নেতা হিসাবে রাজ্যসভার প্রার্থী করা হয়েছিল, তখন শ্যামল চক্রবর্তী রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন না। বর্ষীয়ান সিটু নেতা হিসাবে শ্যামলবাবু এখন রাজ্যসভায় আছেন। এই পরিস্থিতিতে সিটু থেকে আরও এক জনকে, যিনি আবার মূলত দিল্লিতেই রাজনীতি করেন, এ রাজ্য থেকে রাজ্যসভায় পাঠানোর কী যুক্তি?” রাজ্যসভায় তপনবাবু ছাড়াও শূন্য হল সিপিএমের মইনুল হাসান ও সমন পাঠকের স্থান। দলের একাংশ মনে করছে, বিধানসভার ভোটের ফলাফলের প্রেক্ষিতে কোনও সংখ্যালঘু বা তফসিলি প্রার্থী দিলে সিপিএম এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে ‘ভাল বার্তা’ দিতে পারত। কারণ, বিধানসভা ভোটে এই দুই সম্প্রদায়ের ভোটই বামেদের হাতছাড়া হয়েছে। |