প্রবন্ধ ২...
উত্তরপ্রদেশ দেখাল, আঞ্চলিক দলগুলিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না
মার্চ পাঁচ রাজ্যের ভোটের ফল ঘোষণার ঠিক আগের দিন বন্ধুর বার্তা পেলাম ‘উত্তরপ্রদেশের ফল ঘোষণার আগেই তো দিল্লি কাঁপছে’। বন্ধুটি দিল্লি-সহ উত্তর ভারতে মাঝারি ভূকম্পের কথা বলেছিল বটে। কিন্তু তার হেঁয়ালি যে পরের দিন অন্যতর বাস্তবের রূপ নিতে চলেছে, অর্থাৎ নয়াদিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে রাজনৈতিক কম্পন ধরাতে চলেছে, সত্যি কথা বলতে কী, সে দিনও তেমনটা মনে হয়নি।
মায়াবতীর ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ যে পাঁচ বছর পরে অচল, তা বোঝাই যাচ্ছিল। জাতভ বা চামার এবং মোটের উপরে দলিত সমর্থন পুরোপুরি না-হারালেও তথাকথিত উচ্চবর্ণ এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের যে ভোট বহুজন সমাজ পার্টি ২০০৭ সালের বিধানসভা ভোটে পেয়েছিল, তা ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন হতে চলেছে, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খুব কম মানুষই ভাবতে পেরেছিলেন যে, ‘বহেনজি’র এই ভরাডুবি শেষ অবধি কোনও একটি রাজনৈতিক দলকেই লখনউয়ের ক্ষমতার মসনদে বসাতে চলেছে। সমাজবাদী পার্টিও নিজেদের এতটা ভাল ফল আশা করেনি। মনমোহন সিংহ সরকারের মুখ্য কুশীলবেরাও তো আশায় ছিলেন, সমাজবাদী পার্টি বৃহত্তম দল হলেও তাদের ‘হাত’ ধরতে বাধ্য হবে। আর সেটা হলে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় তৃণমূল কংগ্রেসের উপর নির্ভরশীলতাও কমিয়ে ফেলা যাবে। আপাতত সে গুড়ে বালি।

ইদানীং কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচন (বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব) লক্ষ করলে এটা স্পষ্ট যে, কংগ্রেস বা ভারতীয় জনতা পার্টির মতো জাতীয় দল কোনও কোনও ক্ষেত্রে আগের তুলনায় নিজেদের ভোটের হার বাড়াতে পারলেও, এমনকী রাজ্য সরকার গঠনে উল্লেখযোগ্য সহযোগীর ভূমিকা নিতে পারলেও নিজেদের কোমরের জোরে ক্ষমতায় আসার সামর্থ্য জোগাড় করতে পারেনি। বামপন্থী দলগুলির অবস্থাও তথৈবচ।
গত শতকে আশির দশকের শেষ থেকে, প্রধানত হিন্দি বলয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে-ওঠা বিজেপি নিজেকে আর ভিন্নতর দল হিসেবে ধরে রাখতে পারেনি। বরং ভোট বৈতরণী পার হতে গিয়ে সপা-র দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদেরও দলে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। হিন্দুত্বের পুরোনো ম্যাজিক এই মুহূর্তে বহুলাংশে অকেজো। দলে বাজপেয়ী-আডবাণীর পরের প্রজন্মের নেতা-নেত্রীর অনেক, কিন্তু ক্যারিশমার জোরে দলকে জিতিয়ে আনবেন এমন জোর তাঁদের নেই। ভাজপা তাই আজ নতুন কোনও মতাদর্শ এবং নতুন কোনও নেতার খোঁজে।
উত্তরাধিকার। উত্তরপ্রদেশে প্রচারে সনিয়া ও রাহুল। (ডান দিকে) অখিলেশ যাদব।
অন্য দিকে, কংগ্রেস রাহুল গাঁধীকেই সামনে রেখে বাজিমাত করতে আগ্রহী। কিন্তু বিহার বা উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটে রাহুল রাজ্যগুলি চষে বেড়ালেও কাজ কিছুই হয়নি। ‘রাহুল ম্যাজিক’ উত্তরপ্রদেশে সামান্য কয়েকটি আসন বাড়িয়েছে। কিছুটা বাড়িয়েছে কংগ্রেসের ভোটের হারও। কিন্তু তা কি নিতান্ত সান্ত্বনা পুরস্কারের বেশি কিছু?
আসলে ‘রাহুল ম্যাজিক’-এর কথা যাঁরা বলে আসছেন, কয়েকটি বিষয় বোধহয় তাঁদের নজর এড়িয়েই থেকেছে। প্রথমত, ষাট, সত্তর বা আশির দশকের রাজনীতিতে কোনও জাতীয় দলের নেতা/নেত্রী যে ভাবে নিজেদের ক্যারিশমাতে ভোটদাতাদের নানা সময়ে আচ্ছন্ন রাখতে পেরেছেন, আজ তা কতটা সম্ভব, তা ভেবে দেখা দরকার।
দ্বিতীয়ত, রাহুল যেখানে প্রচারে গেছেন, সংবাদ মাধ্যমে তা ফলাও করে জানানো হয়েছে ঠিক, কিন্তু তাঁর সফরের পরে দলের প্রদেশ নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত সেই জনসংযোগ ধরে রাখতে পেরেছেন কি? ভোট বিপর্যয়ের পরে রাহুল স্বয়ং এই সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন। উত্তরপ্রদেশে যে রাহুল মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নন, তা অজানা ছিল না। কিন্তু, কংগ্রেসের কোনও গ্রহণযোগ্য কোনও মুখ কি সামনে আনা হয়েছিল? হাই কম্যান্ড-কেন্দ্রিক দলে নেতৃত্বের রাজ্য স্তরের বিরোধের নিষ্পত্তি করতে হবে হাই কম্যান্ডকেই। কিন্তু তা করতে হবে রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই।
তৃতীয়ত, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচিত সাংসদ হয়েও রাহুল সেখানে অনেকটা বহিরাগতই থেকে গেছেন। ভাট্টা-পারসলে জমির আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ বা অমেঠির ‘ঘরের ছেলে’র ভাবমূর্তি, কোনওটাই আখেরে কাজ দেয়নি। অথচ, ক্যারিশমা যে এখনও এই দেশের রাজ্য রাজনীতিতে কাজ করে, তার প্রমাণ অখিলেশ যাদব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা নীতীশ কুমার।

আশির দশক থেকেই এ দেশে আঞ্চলিক দলগুলির উত্থান শুরু হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে এই দলগুলির চরিত্র ও ভূমিকা বদলাতে শুরু করেছে। তাই রাহুল যেখানে আপাতত ব্যর্থ সেখানে রাজনীতিতে প্রায় আনকোরা মুলায়ম-তনয় অখিলেশের জয়জয়কার। মায়াবতী সরকারের অপশাসনে বীতশ্রদ্ধ উত্তরপ্রদেশের মানুষ আগের মুলায়ম সরকারের কাণ্ডকারখানা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছেন, এমন নয়। কিন্তু অখিলেশ সেখানে এনেছেন নতুন হাওয়ার ঝলক। তাঁর ‘জনচেতনা যাত্রা’ মানুষের মনে যতটা দাগ কাটতে পেরেছে, রাহুল সে ভাবে জনগণের মনের মানুষ হয়ে উঠতে পারেননি।
কাজেই জাতীয় দলগুলির আদর্শহীনতা এবং আংশিক দিশাহীনতার প্রেক্ষিতে আঞ্চলিক দলগুলির নতুন নতুন কান্ডারি বা জাতীয় দলের স্থানীয় নেতাদের উপরে বিধানসভা ভোটে মানুষ আস্থা রাখছেন। মতাদর্শের চাইতে সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে পারা স্থানীয় নেতাদের ক্যারিশমা অনেক ক্ষেত্রেই ফলদায়ী হয়েছে। উল্লেখ্য, মণিপুরে কংগ্রেস যে অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় সবচেয়ে ভাল ফল করে ফের ক্ষমতায় এল, তার পিছনে কিন্তু দলের কোনও জাতীয় নেতার অবদান নেই। ইক্রাম ইবোবি সিংহের উপরেই মণিপুরবাসী আস্থা রেখেছেন। বিরোধী ঐক্য নিম্নমুখী হওয়ায় কংগ্রেস বাড়তি সুবিধা পেয়েছে ঠিকই। আর, মমতার ঝোড়ো প্রচার তাঁর দলকে এনে দিয়েছে সাত-সাতটি আসন।
এই পরিস্থিতিতে জাতীয় দলগুলিকে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক থাকতে গেলে আত্মানুসন্ধান করতেই হবে। লোকসভা ভোটের এখনও দু’বছরেরও বেশি বাকি। সেই ভোটে কংগ্রেস বা ভাজপা-কে ছপিয়ে কোনও আঞ্চলিক দলের পক্ষে সামনের সারিতে আসা কঠিন। কিন্তু যেহেতু আঞ্চলিক দল এবং আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দের প্রাসঙ্গিকতা আপাতত রাজ্যগুলিতে থাকছেই, এই দলগুলির সঙ্গে জাতীয় দলগুলি নতুনতর বোঝাপড়ায় যেতে অস্বীকার করলে বিপদ তাদেরই। নিজ নিজ মতাদর্শের সীমাবদ্ধতার নিরিখে বিচক্ষণ ও বাস্তবসম্মত সমীকরণই কংগ্রেস, বিজেপি বা বামপন্থী দলগুলিকে জাতীয় স্তরে দলের রাজনৈতিক দর কষাকষিতে চালকের আসনে রাখতে পারবে। দেশের বৃহত্তম রাজ্যে হাতি সাইকেল চাপা পড়ার মধ্য দিয়েই এই সত্য কিন্তু ফের উদ্ঘাটিত।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.