শিশু কাহাকে বলে? সহসা প্রশ্নটি শুনিলে অপত্যস্নেহ উথলাইবে, অনুষঙ্গে জাগিবে একটি বোধ। শিশু হইল এক ধরনের সম্পত্তি, নানা ভাবে যাহার সংরক্ষণ এবং বিকাশ সাধন করিতে হয় তেমন একটি বোধ। অভিভাবক, একটি গভীর অর্থে, শিশু নামক সেই সম্পত্তির রক্ষক। তিনি যেমন চাহেন, যে রূপে চাহেন, শিশুটির রক্ষণাবেক্ষণ করিবেন। চাহিলে তাহাকে সানন্দে রাখিবেন। চাহিলে কয়েক ঘা চড়-থাপ্পড় ইত্যাদি কষাইবেন। দোষ নাই। শাসন করা তাঁহারই সাজে সোহাগ করেন যিনি। এই পর্যন্ত আসিয়া আপাত ভাবে আপত্তিকর কিছু খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন। এই মাত্র বলা প্রয়োজন যে শাসন এবং সোহাগ-সংক্রান্ত উপরোক্ত প্রস্তাবনাটির ভিতর একটি খটকা নিহিত আছে। সেই খটকাটি সাধারণ ভাবে চক্ষু এড়াইয়া যায়। কিন্তু, অগোচরে থাকে বলিয়াই যে তাহার কোনও তাৎপর্য থাকিবে না, এমন নহে। শাসন এবং সোহাগ, যাহাই বলা হউক না কেন, তাহা সবর্দাই অভিভাবক-সাপেক্ষ। শিশুটির কথা কেহ জানিতে চাহেন কি? চাহেন না। কারণ, শিশুর যে কোনও বক্তব্য থাকিতে পারে, তাহা ধর্তব্যের ভিতরেই আসে না। কেন আসে না?
প্রথম কারণ, সে অপ্রাপ্তবয়স্ক (সুতরাং, তাহার বক্তব্য রাখিবার ন্যায় বোধবুদ্ধিই বা হইল কোথায়?);
দ্বিতীয় কারণ, সে সম্পত্তির তুল্য (সুতরাং, তাহার কথা বলিবার হক-ই বা কী?) এই দুইটি কু(যুক্তি) যুগপৎ আসিয়া শিশুর স্বরকে রুদ্ধ করিয়া দেয়। তখন তাহাকে বাড়িতে বন্ধ রাখিয়া দিনের পর দিন শারীরিক নিগ্রহ করিলেও কিছু বলার থাকে না। নিগ্রহের বাড়াবাড়ি হইলে কিছু আলোড়ন উঠে, যেমন উত্তর কলিকাতার একটি শিশুর ক্ষেত্রে হইয়াছে। সেই সকল আলোড়নের পরেও একটি প্রশ্নচিহ্ন থাকিয়া যায়। অন্য কেহ নহে, স্বয়ং মা তাঁহার শিশুকে মারিতেছেন, ইহা অন্যায়?
আসলে, ইহা অন্যায়। কোনও নারী কোনও শিশুকে জন্মদান করিতে পারেন। কোনও পিতার বীজ হইতে কোনও সন্তান জন্ম লইতেই পারে। সেই শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলি অতীব মূল্যবান, কিন্তু তাহা যে কোনও মতেই সংশ্লিষ্ট পিতা বা মাতাকে, বৃহত্তর অর্থে তাঁহাদের পরিবারকেও সমাগত শিশুটির সমূহ সত্তার মালিকানা প্রদান করে না, সেই বিষয়ে সচেতন থাকা দরকার। অথচ, উল্টাটিই হয়। পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব, কিংবা বংশানুক্রম শিশুটিকে সম্পত্তির ন্যায় জ্ঞান করিতে থাকে। ভারতে এই ধারণাটিই চালু। ইহার বিরোধিতা ‘পরিবার’ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানেরই বিরুদ্ধাচারণ বলিয়া গণ্য হয়। বিভিন্ন পশ্চিমি দেশে শিশুর মানবাধিকারের যে ধারণা আছে, ভারত অতীব নিশ্চিন্তে সে বিষয়ে উদাসীন। সনাতন ভারতীয় ঐতিহ্য শিশুকে শুধুই নত হইতে শিখায়। চির উন্নত শিরের ধারণা, অন্তত শৈশবকালে, বিষবৎ পরিত্যজ্য। সুতরাং, শিশুর অধিকারের প্রশ্নটিও ভাবনার ভিতরেই আসে না। যেন, শিশুর অধিকার ততটুকুই, যতখানি তাহার অভিভাবক তাহার জন্য মঞ্জুর করিবেন। সেই পরিস্থিতিতেও আবার শাসনের প্রসঙ্গ আসিয়া পড়ে। ‘মানুষ’ করিতে হইলে শাসন অপরিহার্য, সুতরাং তাহার অছিলায় শিশুর মানবাধিকারের প্রশ্নটিকে ভুলিয়া থাকিলেও কোনও ক্ষতি নাই। শিশুকে অবাধ প্রশ্রয়দান যেমন তাহার বিকাশলাভের যথাযথ পথ হইতে পারে না, তেমনই তাহার নিজস্ব স্বরকে রুদ্ধ করিবার চেষ্টাও অর্থহীন। উত্তর কলিকাতার একটি ঘটনা শিশুর অধিকার এবং তাহার সহিত তাহার অভিভাবকদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে কিছু জরুরি প্রশ্ন তুলিয়া দিয়াছে। প্রশ্নগুলি বিবেচনা করা জরুরি। |