সর্বনাশের পথ প্রায়শই সদিচ্ছায় বাঁধানো থাকে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ কৃষকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিবার প্রসঙ্গে যে সিদ্ধান্ত করিলেন, তাহাতে তাঁহার সদিচ্ছাটি প্রকট হইয়াছে। কৃষকদের প্রতি তাঁহার ভালবাসা নাই, এই কথা অতি দুর্জনেও বলিবে না। নিন্দুকে বলিবে, পঞ্চায়েত নির্বাচন আসিতেছে, সদিচ্ছা পল্লবিত হওয়ার ইহাই সময়। নিন্দুকের কথা থাক, কিন্তু মুশকিল হইল, কৃষকদের উপকার করিতে গিয়া তিনি তাঁহাদের জন্য যে সর্বনাশের ব্যবস্থা পাকা করিলেন, তাহা হঠকারিতার রাজনীতি-গ্রাহ্য মাপকাঠিতেও বিরল। কৃষি-ঋণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে রাজনীতিকরা সচরাচর এককালীন মকুবের কথা বলিয়া থাকেন। তাহাই রীতিমত বিপজ্জনক একটি অভ্যাস। কিন্তু, ঋণ অপরিশোধিত থাকিলে যে আইনের বলে খাতকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যায়, সেই আইনটিই বদলাইয়া ফেলিবার প্রতিশ্রুতিটি গ্রামে ঋণের সংগঠিত বাজারকেই নষ্ট করিয়া ফেলিতে মোক্ষম। মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা তাঁহাকে সেই বিপদের পথে পরিচালনা করিয়াছে।
ভারতে কৃষি ঋণের সংগঠিত বাজারটি এখনও অপরিণত। পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নহে। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু ক্ষুদ্র চাষিই সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফলে এই রাজ্যে সংগঠিত কৃষি ঋণের বাজার আরও দুর্বল। একটি খসড়া হিসাব বলিতেছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৬৮ লক্ষ পরিবার কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাহাদের অর্ধেক কোনও না কোনও সমবায়ের সদস্য। তাহাদেরও অর্ধেকের কোনও সমবায় ব্যাঙ্ক হইতে ঋণগ্রহণের সুযোগ আছে। অর্থাৎ, রাজ্যে কৃষির উপর নির্ভরশীল পরিবারগুলির তিন-চতুর্থাংশই ব্যাঙ্কের ঋণের আওতার বাহিরে থাকিয়া যায়। যাঁহারা ব্যাঙ্কের ঋণ পান না, তাঁহাদের ভরসা মহাজন, অথবা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা। মহাজনের ঋণের বোঝা বাংলার কৃষি-ঐতিহ্যের অংশ। ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার সুদের হারও বেশ চড়া। যাঁহারা প্রান্তিক চাষি, ভাগ চাষি, যাঁহাদের জমির মালিকানার কাগজপত্র দস্তুরমত নহে, ব্যাঙ্কের ঋণ জোগাড় করা তাঁহাদের পক্ষে কঠিনতর হয়। ব্যাঙ্ক তাঁহাদের ঋণ দেয় না, কারণ তাঁহাদের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা বিষয়ে ব্যাঙ্কের সংশয় আছে। যে কোনও জনদরদি সরকারের কর্তব্য, এই শ্রেণির মানুষরা যাহাতে ব্যাঙ্কের ঋণ পান, তাহার ব্যবস্থা করা। ব্যাঙ্কের ওপর জোর ফলাইয়া নহে, ব্যাঙ্ককে নিশ্চিন্ত করিয়া।
মুখ্যমন্ত্রী সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটিলেন। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা সংক্রান্ত আইন পরিবর্তিত হইবে কি না, তাহা পরের প্রশ্ন। আপাতত মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট বার্তা দিয়া রাখিলেন কৃষি ঋণ পরিশোধ না করিলেও চিন্তার কোনও কারণ নাই। এই বার্তাটি যেমন কৃষকরা বুঝিবেন, তেমন ব্যাঙ্কগুলিও বুঝিবে। উভয় পক্ষের প্রতিক্রিয়া অবশ্য বিপরীত হওয়াই স্বাভাবিক। মুখ্যমন্ত্রীর বার্তা যে পরিস্থিতিটি তৈরি করিল, অসম্পূর্ণ তথ্যের অর্থনীতির জগতে তাহা সুপরিচিত তাহার নাম মরাল হ্যাজার্ড বা নৈতিক সঙ্কট। কৃষকের পক্ষে ঋণ লইয়া তাহা শোধ না করাই যুক্তিসঙ্গত, কারণ শোধ না করিলে তাহার কোনও শাস্তি হইবে না, শোধ করিলে কোনও পুরস্কারও জুটিবে না। কোনও কৃষকই ঋণ পরিশোধ করিবেন না, তাহা নহে, কিন্তু কোন কৃষক ঋণ শোধ করিবেন, তাহা বুঝিবার কোনও উপায় ব্যাঙ্কের থাকিবে না। ফলে, ব্যাঙ্ক ঋণ প্রদানের বিষয়ে আরও সাবধানী হইবে। আরও কম কৃষক ঋণ পাইবেন। সম্ভবত সুদের হারও বাড়িবে। ফলে, আরও বেশি কৃষক, বিশেষত অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কৃষক, এই সংগঠিত ঋণের আওতার বাহিরে, অতএব মহাজনের আওতায় চলিয়া যাইবেন। এই পরিস্থিতিই মুখ্যমন্ত্রীর কাম্য ছিল ভাবিলে তাঁহার প্রতি অন্যায় করা হইবে। কিন্তু, অর্থনীতির যুক্তি বিসর্জন দিয়া জনমোহনকেই ধ্রুব মানিলে তাহার পরিণতি কী হয়, বর্তমান ঘটনাটি তাহার দৃষ্টান্ত হইয়া থাকিল। |