স্বল্পমেয়াদি সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ বনাম রেলের সংস্কারমুখী দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যপূরণ। এই দুইয়ের দড়ি টানাটানির মধ্যেই কাল তাঁর প্রথম রেল বাজেট পেশ করতে চলেছেন দীনেশ ত্রিবেদী।
এক দিকে মনমোহন সিংহ, মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া, স্যাম পিত্রোদাদের সংস্কারমুখী দিশানির্দেশ, অন্য দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূলের জনদরদি ভাবমূর্তি।
শেষ পর্যন্ত কী করবেন দীনেশ?
রেল মন্ত্রক জানাচ্ছে, দুই ভিন্ন মেরুর টানের মধ্যে দাঁড়িয়ে দীনেশ সম্ভবত মধ্যপন্থা নেওয়ারই পক্ষপাতী। যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। দীনেশের প্রধান লক্ষ্য দু’টি। এক, পশ্চিমবঙ্গের মেট্রো-সহ যে চালু রেলপ্রকল্পগুলি রয়েছে, সেগুলির জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে রাজ্যে তৃণমূলের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রাখা। দুই, ষষ্ঠ বেতন কমিশনের চাপ ও দশ বছর ধরে ভাড়া না বাড়ানোর কারণে কোষাগারের যে রকম বেহাল দশা, তার খানিকটা অন্তত সুরাহা করা। ঘুরপথে হলেও কিছুটা অর্থ জোগানো। শেষ সময়ে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন দীনেশ। বাজেটের ঠিক এক সপ্তাহ আগে সুকৌশলে পণ্য পরিবহণের মাসুল বাড়িয়েছেন তিনি। যা থেকে আগামী এক বছরে প্রায় পনেরো হাজার কোটি টাকা রেলের ঘরে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু যাত্রী ভাড়া?
বাজেটের ঠিক মুখে ভাড়া প্রসঙ্গে দীনেশ মুখ না খুললেও মন্ত্রকের একাধিক সূত্র বলেছে, পরিস্থিতি এমনই যে অবিলম্বে ভাড়া বাড়াতেই হবে। এক রেল-কর্তার বক্তব্য, “এই ভাবে কত দিন চলতে পারে! কোনও রেলমন্ত্রীকে তো অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।” কিন্তু মমতা তথা তৃণমূলের নীতিই হল, সাধারণ মানুষের উপর বাড়তি বোঝা চাপে, এমন সিদ্ধান্ত না নেওয়া। দীনেশের পক্ষে তাই এই মুহূর্তে সরাসরি ভাড়া বাড়ানো বা ডিজেলের দামের ওঠাপড়ার সঙ্গে ভাড়াকে যুক্ত করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। |
এই অবস্থায় দলনেত্রীর আপত্তির মুখে দাঁড়িয়ে দীনেশ, সরাসরি ভাড়া না বাড়িয়ে নিরাপত্তা বা আধুনিকীকরণ খাতে সারচার্জ বসিয়ে বছরে চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা আয়ের সংস্থান করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রকের সম্ভাব্য সাফাই, ওই টাকা তো আসলে যাত্রীস্বার্থেই ব্যবহার করা হবে। রেলের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি-সহ সরকারের সব মহল থেকেই ভাড়া বৃদ্ধির চাপ রয়েছে রেলমন্ত্রীর উপর। কিন্তু দলের চাপে একান্তই তা করতে না পারলে দীনেশ একটি ‘ট্রাফিক রেগুলারিটি অথরিটি’ গড়ে এ যাত্রায় মুখরক্ষার চেষ্টা করতে পারেন বলে জানাচ্ছে রেলের সূত্র।
রেলের জমি ও স্টেশনের আরও সফল বাণিজ্যিক ব্যবহার, পিপিপি মডেলের সময়োপযোগী প্রয়োগের উপরে জোর দিতে চান দীনেশ। তবে বিশেষ জোর দিচ্ছেন পণ্য পরিবহণের পরিমাণ বৃদ্ধির উপরে। বর্তমানে দেশের পণ্য পরিবহণের মাত্র ৩০ শতাংশ রেলের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আগামী তিন বছরের মধ্যে তা ৪৫-৫০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগ্রাসী রণকৌশল নিতে চাইছে মন্ত্রক।
গত রেল বাজেটে মমতাকে কুড়ি হাজার কোটি টাকা সাহায্য দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রক। এ বার সেটা পাঁচ হাজার কোটি বাড়বে বলে মনে করছে মন্ত্রক। এই টাকার বড় অংশ খরচ হবে নিরাপত্তা ও সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের কাজে। নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ হওয়ার কথা রয়েছে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা। খোলনলচে সম্পূর্ণ বদলে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে ১৯ হাজার কিলোমিটার লাইনের। দিল্লি-মুম্বই ও দিল্লি-কলকাতা রুটে উন্নত মানের অধিক ক্ষমতাশালী লাইন পাতার পাশাপাশি সিগন্যালিং ও যোগাযোগ ব্যবস্থা আমূল বদলে ফেলার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিশা থাকতে পারে রেল বাজেটে। মন্ত্রকের একটি সূত্রের কথায়, দীনেশ ব্যক্তিগত ভাবে চান, জাপানের বুলেট ট্রেনের ধাঁচে এ দেশেও দ্রুতগামী ট্রেন চলুক। পরিকাঠামোগত ওই সংস্কার সাধন হলেই ঘণ্টায় প্রায় ১৮০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে। এর জন্য বাজেটে লেভেল ক্রসিংয়ে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বসানোর প্রস্তাব রাখতে পারেন দীনেশ। কারণ, দ্রুত গতির ট্রেন চললে যাত্রার সময় কমবে, বাড়বে যাত্রী ট্রেনের সংখ্যা। ফলে ভাড়া থেকে আয় বাড়বে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া ট্রেনের গতি বাড়লে পণ্যও পৌঁছানো যাবে কম সময়ে। রেলে পণ্য পাঠাতে আগ্রহ বাড়বে ব্যবসায়ীদের। বাড়বে পণ্য পরিবহণ এবং তা থেকে আয়।
যাত্রী পরিষেবার মান বাড়াতে ট্রেনে ‘গ্রিন টয়লেট’ বসানো, পরীক্ষামূলক ভাবে বিদেশি সংস্থাকে খাবার জোগানোর বরাত দেওয়ার মতো চমক থাকতে পারে দীনেশের বাজেট বক্তৃতায়। পাশাপাশি রাজ্যের জন্য একাধিক দুরন্ত ও দূরপাল্লার ট্রেন, ব্যারাকপুর-কল্যাণীর মধ্যে মেট্রো রেল চালানোর মতো ঘোষণাও থাকতে পারে বাজেটে। কলকাতা ও তার শহরতলিতে যে ভাবে মেট্রো রেল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে, তাতে আগামী দিনে মেট্রো কোচের ঘাটতি মেটাতে রাজ্যে একটি মেট্রো কোচ কারখানা গড়ার ঘোষণাও হতে পারে।
গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ক্ষতিতে চলা রেল সম্প্রতি কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ায় একেবারে শেষ পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১০০০ থেকে ১৫০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় দেখানো যাবে বলেই ইঙ্গিত মিলেছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা নগণ্য হওয়ায় চলতি বাজেটে বড় কোনও প্রকল্প ঘোষণা করার পথে হাঁটতে চাইছে না মন্ত্রক। তবে দীনেশ ব্যক্তিগত ভাবে যে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সেই রাজ্যগুলি (যেমন কর্নাটক, নাগাল্যান্ড, মধ্যপ্রদেশ বা গুজরাত) বাজেটে বাড়তি গুরুত্ব পেতে চলেছে বলে খবর। তবে অর্থের অভাবে কোপ পড়তে পারে গেজ পরিবর্তন, ডাবলিং-এর মতো কাজের ক্ষেত্রে। ওই ক্ষেত্রগুলিতে কমতে পারে লক্ষ্যমাত্রা।
পরিস্থিতি যা, তাতে নিজের প্রথম বাজেট পেশ হওয়ার আগে কার্যত দড়ির উপর হাঁটছেন দীনেশ। ক’দিন আগেই দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে রেলের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। এতে শিল্প মহলের কাছে ইতিবাচক বার্তা যায়। দীনেশের সেই বক্তব্যকে স্বাগত জানায় শিল্প মহল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ভাড়া বা সারচার্জ বাড়ানোর মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন তিনি? পারবেন কী, নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদ, বা মমতার জনমুখী বাজেটের চেনা ছক উল্টে দিতে?
অপেক্ষা আর কয়েক ঘণ্টার। |