‘মাসিমা, আমরা পুলিশের লোক। এলাকায় ছিনতাই খুব বেড়েছে ইদানীং। আপনারা হার-দুল পরে রাস্তায় থাকবেন না, প্লিজ খুলে নিন।’
ভরদুপুরের কলকাতায় সাদা পোশাকের ‘পুলিশের’ এই ‘সহৃদয়তা’য় থতমত খেয়ে যান পথচারী মহিলা। ‘তবে কী করব, বাবা’ বলতে না-বলতেই ‘মাসিমা’কে দু’জন তরুণ পুলিশকর্মী মিলে গয়নাগাঁটি ব্যাগে ভরে ফেলার পরামর্শ দিলেন। তার আগে ‘এক বার দেখি মাসিমা’ বলে তাঁর হাত থেকে গয়না-টয়না নিয়ে খাতায় ঝটপট ‘নোট’ করে নেন তৎপর ‘পুলিশ অফিসার’। কাগজে মুড়ে গয়না ফেরত দিয়ে বলেন, ‘আর কোনও চিন্তা নেই। কী কী আছে, সব লিখে নিয়েছি। হার-দুল ছিনতাই রুখতেই এখন আমাদের এলাকায় জোর পাহারা চলছে।’
শহরে ‘পুলিশের’ এই সজাগ ভূমিকায় কৃতার্থ মহিলা তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু পরে ব্যাগ খুলতেই তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। কাগজের মোড়ক খুলে মহিলা দেখেন, তাঁর কানের দামি পাথরের দুলের বদলে হাতে কয়েক টুকরো ভাঙা পেন্সিল। ‘পুলিশবেশী’ এই প্রতারকদের রমরমা চলছে এখন শহর জুড়েই। ঘটনাস্থল শুধু পাল্টে যাচ্ছে। কসবার বকুলতলা থেকে সল্টলেকের আইবি ব্লক বা উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর। সময়টা সাধারণত, দুপুর। ‘টার্গেট’, একটু ফাঁকা বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ একলা মহিলা বা পার্কের ধারে কোনও একাকিনী। কখনও স্থানীয় থানার পুলিশ কখনও বা সিবিআই-এর গোয়েন্দা-অফিসারের ভেক ধরে বিপদ থেকে ‘বাঁচানো’র নাম করেই হাতসাফাইয়ের নিপুণ কৌশলে গয়না সরিয়ে ফেলছে এই প্রতারকেরা। বাড়ি ফিরে ‘শিকারেরা’ দেখছেন, তাঁদের ব্যাগে কাগজের মোড়কে দামি গয়নার বদলে সস্তার কাচের চুড়ি, লোহার তার বা পেন্সিলের টুকরো। গত মাসখানেকে শহরের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এমন কেপমারির অন্তত ১০টি অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ। কিনারা হয়েছে শুধু সল্টলেকের একটি ঘটনার। যা সামগ্রিক ভাবে কলকাতা ও লাগোয়া এলাকায় পুলিশের ‘কার্যকারিতা’র করুণ ছবিই তুলে ধরছে।
পুলিশের পরিভাষায় কেপমারি বা ছলে-কৌশলে প্রতারণার এই ছক পুরো আনকোরা নয়। এই ধরনের প্রতারণার ছক ভাঙতে লালবাজারে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দফতরে ‘ওয়াচ’ শাখা বলে একটি আলাদা বিভাগও আছে। কিন্তু কাজের বেলায় দেখা যাচ্ছে, একই কায়দায় পরপর মহিলাদের বোকা বানিয়ে গয়না-লুঠের ঘটনা ঘটে চললেও পুলিশ কিছুই করতে পারছে না।
প্রশ্ন উঠেছে, কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে যারা এই ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের মধ্যে কোনও যোগসূত্র আছে কী? বা ক’টি গ্যাং এই অপারেশন চালায়? লালবাজারের কর্তাদের কাছে এখনও এর স্পষ্ট উত্তর নেই। শুধু বিধাননগর কমিশনারেটের অন্তর্ভুক্ত সল্টলেকে এই ধরনের কয়েকটি চক্রের পাণ্ডার হদিস পেয়েছে পুলিশ।
ঘটনা হল, দক্ষিণ শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকায় পুলিশি নজরদারি আঁটোসাঁটো করার কথা বলেই গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে বেশ কয়েকটি থানাকে কলকাতা পুলিশের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। কিন্তু তার পরেও নানা ধরনের ছোট-বড় অপরাধের ঘটনা বেড়েই চলেছে। পুলিশের একাংশই মানছেন, নতুন এলাকা লালবাজারের নিয়ন্ত্রণে এলেও গোয়েন্দা বিভাগের ‘সোর্স-নেটওয়ার্ক’ বাড়ানোর কাজে খামতি থেকেই গিয়েছে। |