জেলার চাষিদের ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা যেখানে বাড়ছে, সেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণায় চাপে পড়ে গিয়েছেন সমবায় ব্যাঙ্কের কর্তারা। বস্তুত, এতে ব্যাঙ্ক ও ঋণগ্রহীতা উভয়েই বিপদে পড়তে চলেছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
গত বছরের ১৮৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে এ বছরে ২২২ কোটি টাকা ঋণ দেবার লক্ষমাত্রা নিয়েছিল বর্ধমান কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২০১ কোটি টাকা দেওয়াও হয়েছে। কিন্তু অনাদায়ী ঋণ আদায় করতে গেলে তাঁদের বিরুদ্ধেই পুলিশে অভিযোগ দায়ের হতে পারে ভেবে শঙ্কিত জেলার সমবায় কর্তারা। কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান জওহরলাল মুখোপাধ্যায় বলেন, “গত বছর প্রায় সমস্ত টাকাই শোধ হয়েছে। কিন্তু এ বার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় আমরা বিপাকে পড়ে গেলাম।” ঋণ শোধ না হলেও বন্ধকী জমি নিলাম করা যাবে না বলে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করায় তাঁদের পক্ষেও ঋণগ্রহীতার উপরে ‘আস্থা’ রাখা আগের চেয়ে শক্ত হবে বলে সমবায় কর্তারা অনেকেই মনে করছেন।
বামেদের ক্ষমতাচ্যুত করার পরে তৃণমূল নেত্রীর সরকার গত ৬ ফেব্রুয়ারি সমবায় আইনে যে পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তাতেও কিন্তু বন্ধকী ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগের ব্যবস্থার কোনও বদল ঘটানো হয়নি। বর্ধমান কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের অন্যতম ডিরেক্টর চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “২০০৬ সালে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নেতৃত্বে একটি কমিটি গড়া হয়েছিল। ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি তারা সিদ্ধান্ত জানায়। তাতেও কোথাও বলা হয়নি, চাষিদের জমি বন্ধক রেখে ঋণ দেবার মধ্যে কোনও গলদ রয়েছে। ওই কমিটিতে কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া এবং তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সমবায় আইনের ‘অ্যামেন্ডমেন্ট’-এ ও ১৯৬০ সাল থেকে চলে আসা জমি বন্ধকী পদ্ধতি বদলের কথা বলা হয়নি।”
চিত্তরঞ্জনবাবুর ব্যাখ্যা, ১৯৫৪ সালে চাষিদের দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দিতে সমবায় ব্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছিল। এই ব্যাঙ্কগুলিকে আজও অনেকে ‘ল্যান্ড মর্টগেজ’ (জমি বন্ধকী) ব্যাঙ্ক বলে ডাকেন। নয়ের দশকের গোড়ায় নাম পাল্টে করা হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ সমবায় কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন ব্যাঙ্ক’। তমলুকের ওই ব্যাঙ্ক তো বটেই, রাজ্যের সর্বত্র সমবায় ক্ষেত্রে যে কৃষিঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জমি বন্ধক রাখতে হয়।” এক সময় নিয়ম ছিল, যে সমবায়ের সদস্যেরা ঋণের শতকরা ৪০ ভাগ শোধ করতে পারবেন না, তাঁরা আর নতুন করে ঋণ পাবেন না। পরে ঠিক হয়, যদি এক জন চাষি বা সদস্যও ঋণ শোধ করেন, তাঁকে ফের নতুন করে ঋণ দেওয়া হবে।
চিত্তরঞ্জনবাবুর দাবি, “ঋণশোধ করলে তবেই নতুন ঋণ দেওয়ার এই নীতি নেওয়ার পরে জেলায় সমবায়গুলিতে পুরনো ঋণের শতকরা ৯০ ভাগ জমা পড়ছে। বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কার্যত প্রায় প্রতি বছরই চাষিদের আবেদন করতেন, পুরনো ঋণ শোধ দিয়ে নতুন করে ঋণ নিন। এতে মানুষ সাড়া দিয়েছেন। বিগত বছরগুলিতে সমবায় ক্ষেত্র যথেষ্ট বলিষ্ঠ হয়েছে।” কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর, গত সেপ্টেম্বরে জেলার সচল থাকা ৫১৭টি সমবায় ব্যাঙ্কের ভেতর ৩০৯টি বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করে পুরস্কৃত হয়েছিল। এর মধ্যে ১৫৫টি সমবায় সমিতি ১০০ শতাংশ, ৯২টি ৮৫ থেকে ৯৯ শতাংশ, ৬২টি সমবায় সমিতি ৭৫ থেকে ৮৪ শতাংশ পুরনো ঋণ সুদ-সমেত শোধ করেছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ এই প্রক্রিয়াকে অনেকটাই পিছিয়ে দিতে পারে বলে সমবায় কর্তারা আশঙ্কা করছেন। |