|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
রং বেরঙের গল্প |
পরিমল সেনগুপ্ত |
বাঁদিকের জানালা |
ঘুম থেকে উঠেই বিরক্ত লাগল সুবিমলের। আজ দোল। এই দিনটা কেন যেন খুব খারাপ লাগে। অথচ এমনিতে কোনও কারণ নেই খারাপ লাগার। কেউ তাকে রং দিতে আসে না। কেউ জ্বালায় না। এমন কী দুপুরের পর থেকে মোটামুটি নর্মাল হয়ে যায় সব কিছু। নীচে যেখানে ফুচকাওয়ালাটা দাঁড়ায় সেখানে ট্যাক্সিগুলোও জুটে যায় ঠিক। বিকেলে ছেলেমেয়েরা আবার বাইকে করে আসে ফুচকা খেতে। তাদের কারও কারও চুলে গালে কপালে তখনও লেগে থাকে সকালের আহ্লাদ। এরাই কি সকালে পরস্পরকে রং দিয়েছে? গালে মাথায় চুলে? জানালা থেকে সরে আসে সুবিমল। কী দরকার তার এই সব প্রশ্নে? নিজের ওপরেই বিরক্ত লাগে।
সুবিমলের ঘরটা সাধারণ। উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ার ভেতরে একটা লুকোনো মাঠের ধারে। এই মাঠটা আর দখল হবে না বলে এখনও এক চিলতে আকাশ দেখা যায়। আর এই শহরটা খুব অপূর্ব ভাবে মান্ধাতার আমলে পড়ে আছে বলেই বোধ হয় ওই আকাশে এখনও ঘুড়িও দেখা যায়। একটা ঘুড়ি একবার কী করে যেন টাল খেতে খেতে মাতালের মত ঘুমন্ত সুবিমলের নাকে এসে পড়েছিল। ঘুড়িটা ঘয়লা। আড়াআড়ি সবুজ আর গোলাপি রং। তার লেজটা আবার খবরের কাগজের। কী ভেবে আলনার পাশের দেওয়ালে ঘুড়িটাকে টাঙিয়ে রেখেছে সুবিমল। ঘরটার মধ্যে সেটাই একমাত্র রং। |
|
জামা কাপড় সুবিমলের বেশি নেই। ছাই ছাই প্যান্ট আর সাদা সাদা জামা ছাড়া বিশেষ কিছু পরেও না সে। দরকারও হয় না। যে বইয়ের দোকানে সেলস ম্যান হয়ে বসে, সেই দোকানটাতেও তো একটাই কী রকম ঘোলাটে রং। চেয়ারগুলোর বার্নিশ ঘামে আর নানান শরীরের তেলে কালো হয়ে গেছে। আলমারিগুলোতে কাচের চেয়ে তাপ্পি বেশি, সেগুলোও পুরোনো হয়ে কী রকম খয়েরি। দু’পাশের বিয়ের কার্ডের দোকানের পসরা আস্তে আস্তে সরস্বতী বুক স্টোর্সের সামনে হানা দিচ্ছে। টের পায় সুবিমল। কিন্তু মালিকের ছেলে নতুন ছোকরা মালিক যখন কিছু বলে না তখন সে কর্মচারী হয়ে কী বলবে? কেনই বা বলবে? তাই কিছু রঙিন প্রজাপতি ইদানিং দুলছে তার নাকের ডগায়।ঘরের টেলিভিশনটাও সাদা কালো। দূরদর্শন ছাড়া কিছু আসে না। কেবল-ফেবল নেয়নি সুবিমল। তার ও সবের নেশা নেই। মাঝে মাঝে নিউজ দেখে। টেলিভিশনটা চালালো। ছবিটা আবার কাঁপছে। নিজেই আবার একটু গরম হলে ঠিক হয়ে যায়। অনেক বছর চলছে। ফ্যান ঠিক করতে এসে মনা বলেছিল, দাদা এই মালটা এবার পাল্টান, এটা তো রেডিও হয়ে গেছে। বলেন তো সুপ্রিম ইলেকটনিকের শ্যামদাকে বলে দিই, এখন সাড়ে তিনে কালার পেয়ে যাবেন, এক বছরে দিন না, বাজার ঢিলে দিয়ে দেবে, আপনি চেনা লোক। আর মাসে কেবল ১৬০-এ করে দেব। সুবিমল ভেবেও ছিল একবার কিন্তু আর হয়ে ওঠেনি।
টেলিভিশনে দোলের ছবি দেখাচ্ছে। কী রকম আশ্চর্য দেখাচ্ছে। বাজার ভরা সাদা সাদা, ছাই ছাই, কালো কালো বালির স্তূপের মত। আসলে তো আবির। হঠাৎ আবার সেই ফালতু ভাবনার নেশাটায় ঢুকে গেল সুবিমল, তার জীবনের একমাত্র নেশা। এই তো টিভিতে দেখাচ্ছে সাদা কালো গুঁড়ো। কিন্তু যারা এই টিভি দেখছে তারা সবাই জানে ওগুলো আসলে গোলাপি, লাল, নীল, সবুজ। কিন্তু রঙগুলো এখানে দেখা যাচ্ছে না।
তা হলে আমরা আগে থেকে যা জানি তাই কি নিয়ে আসি আমাদের দেখায়?
তা হলে না জানা জিনিসের প্রথম দেখায় মানে করি কী করে? পারি কি?
তা হলে নতুন কিছু জানা কী সম্ভব?
|
ডান দিকের জানালা |
জানালায় দাঁড়িয়ে শাশ্বতী। দোলের দিন ইস্কুলের ছুটি। শাওনীটা সকাল থেকে দোল খেলতে বেরিয়েছে, পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে, আটকায়নি ও। কী হবে আটকে? কেউ বুকে হাত দেবে? কী জানি, আজকাল শাশ্বতীর মনে হয় ওইটুকু ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়ে মেয়েকে আটকে রেখে লাভ কী। বাসে করে স্কুলে যায়, অচেনা হাত সামলাতে নিশ্চয় শিখতে হয় ওকে রোজ। ঘ্যানঘ্যান করে ১০০টা টাকাও নিয়েছে শাওনী। রং কিনবে, জিলিপিও নাকি খাবে। রাস্তা দিয়ে একটা ছেলে মেয়ের দল যাচ্ছে। শাওনীটাও আছে নাকি ওদের মধ্যে? মনে হল না। তবে দেখে বোঝার খুব একটা জো নেই। বাঁদুরে রং মেখে যা চেহারা হয়েছে এক এক জনের। হঠাৎ শরীরটা কী রকম শিরশির করে উঠল শাশ্বতীর। অমিতের সঙ্গে এক দোলেই প্রথম আলাপ হয়েছিল তার। তুমি রনির বোন? এসো তোমায় আদর দিয়ে বাঁদর করি। বলে কী অনায়াস সাবল্যে শাশ্বতীর ষোল বছরের মুখটা দু’হাতের মধ্যে নিয়ে বাঁদুরে রং মাখিয়ে দিয়েছিল অমিত। অমিতের হাত দু’টো গরম, আর বাঁদুরে রংটার পেলব প্রলেপের মধ্যে দু একটা দানা দানা ভাব ছিল। তখনই বোধ হয় ছোটদের কেউ পেছন থেকে পিচকিরি দিয়ে রং ছেটাচ্ছিল। সালোয়ার ভেদ করে, সেই জল তখন পেছন বেয়ে, দু’পায়ের ভেতর দিক ধরে বয়ে যাচ্ছিল নীচের দিকে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল শাশ্বতী। অমিত বোধ হয় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। বলেছিল, চোখে চলে গেল নাকি? শাশ্বতী বলেছিল না। তারপর নিজের ভেতর থেকে অনেক জোর কুড়িয়ে এনে অমিতের দুই গালে আবির মাখিয়েছিল সে। গুঁড়ো আবির, অমিতের গালের হালকা দাড়ি, সে এক নেশার মত।
হঠাৎ হাসি পেল শাশ্বতীর। কোথায় অমিত আর কোথায় সে আজকে। কী হবে এই সব মনে করে। অমিত এখন কোন শহরে সে জানেও না। অমিতও খোঁজ নেয় না বহু দিন। শাওনীকে চায়নি অমিত। বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল শাশ্বতীর। ভাগ্যিস, অমিতের কথা সে শোনেনি। একা মায়ের মেয়ে মানুষ করা সহজ নয়। তবু বড় হয়ে গেল তো মেয়েটা। আর কী দারুণই না হল। যদি না থাকত শাওনী, কাকে নিয়ে থাকত শাশ্বতী! মেয়েটা যদিও মাঝে মাঝে বলে মা আমি হয়েই তোমার প্রেমের সব চান্স নষ্ট করে দিলাম। নইলে তোমার এখনও যা চেহারা আমার বন্ধুরাই দৌড়ে আসবে। একটা প্রেম করো না মা।
প্রেম? নাঃ। প্রেমের আর কোনও দরকার নেই শাশ্বতীর। যদিও শরীরটা মাঝে মাঝেই জ্বালায়, তবু এই বেশ আছে সে। আবার এক জন পুরুষকে জীবনে ঢোকানো, সে বড় অশান্তি। কিন্তু শাওনী কি প্রেম করে? জানে না। এমনিতে মেয়েটা সব বলে ওকে। কিন্তু সব বলে কি?
আবার একটা দল যাচ্ছে, এরা ওই পাশের বেঢপ ভাবে মাথা তোলা নীহারিকা আবাসনের দল। বয়সে একটু বড় তাই জল রঙের চেয়ে আবির বেশি। গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে, ও তুই রস খাবি তুই রস খাবি তুই রস খাবি। রস বোধ হয় ইতিমধ্যেই খাওয়া হয়ে গেছে, তাই সুর বেসুরের তোয়াক্কা না রেখেই চেঁচানো চলছে। কোমরও দুলছে। এক জন টাক মাথা লোক তো একটু বেসামাল মনে হচ্ছে। তাকে কয়েক জন সামলাচ্ছে। দু’জন মহিলা, বোঝা যায় নিয়মিত সালোয়ার কামিজ পরেন না, আজকে নাচতে নাচতে যাচ্ছেন, রস হবে মিশ্রির দানা গো, রস হবে মিশ্রির দানা।
|
বাঁদিকের জানালা |
মুলায়ম সিং যাদব জিতে গেল। ছেলেটা, অখিলেশ্বর বেশ স্মার্ট। রাহুল বেচারা খেটেছিল অনেক, কিন্তু তেমন কিছু তো হল না। রায় বেরিলি অমেঠি সবেতেই খারাপ রেজাল্ট। প্রিয়ঙ্কাকে ভোটের প্রচারে আরও বেশি করে নামায় না কেন কংগ্রেস কে জানে। ওকে বেশ ঠাকুমার মতো দেখতে। হয়তো লোকে আরও বেশি ভোট দিত ওদের। আচ্ছা, কংগ্রেস ভাল না করায় আমার কী? আসলে কী দেখতে ভালো লোকেরা হেরে গেলে একটা কষ্ট হয়? সেই যে কী বিশ্রী একটা গল্প ছিল না যে কংগ্রেসের কুচকুচে কালো এক প্রেসিডেন্ট তার ধপধপে সাদা গোঁফ নিয়ে রাশিয়া গিয়েছিল। সেখানে কাগজে ছবি ছাপার পর, ফোনের পর ফোন, লোকের তো সাদা মুখে কালো গোঁফ হবে, নেগেটিভটা ছাপিয়ে দিলে কেন? আবার সেই রঙের গল্প।
রাস্তায় কারা যেন গান গাইছে, কী বেসুরো রে বাবা। দেখি কারা? ও ওই ফ্ল্যাট বাড়ির পাব্লিক। ওরা এ পাড়ায় আসার পর কালুদার দোকানে মার্জারিন না কী বলে সে সব রাখছে। মাখনের মত, কম মোটা হয় নাকি। সকালে পাড়ার রাস্তায় হাফ প্যান্ট পরে হাঁটেও ক’জন। বাঙালির ঠ্যাঙে হাফ প্যান্ট! সেও এক দেখার জিনিস। সেগুলোই নাচছে। দোকানে দোকানে ঢুকে আবির দিচ্ছে। এটা বোধ হয় ফ্ল্যাটের সঙ্গে বাকিদের জন সংযোগ। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ওদের খুচখাচ ঝামেলা লেগেই থাকে। প্রায়ই ওদের গাড়িগুলোর জন্যে রাস্তা আটকে যায়। প্রোমোটারটাও বোধ হয় তখনকার পার্টির কোন দাদা ধরে পাড়ার ছেলেদের থেকে বালি সিমেন্ট নেয়নি। এখন বোঝো। তা ছেলেগুলো নিয়মিত ওদের ওপর রং নেয় বলে আজকে ওরা রং দিতে এসেছে। ও বাবা একটা টাক মাথা লোক তো রতনকে জড়িয়ে ধরেছে। রতন বুঝতে পারছে না কী করবে।
|
কমন প্যাসেজের বাঁ দিকের দরজা |
দরজায় ধাক্কা? এ আবার কে এল রে বাবা। আজকে তো কারওর আসার কথা না। কাজের মাসি তো বলেছে দোলের দিন শ্যালদার ট্রেনে বড় ঢিল পাটকেল ছোঁড়ে বাবা, কাল আমি আসবো না। আর কেউ তো। আজকে। কে এল? ও তুমি? শাওনী। এসো। কী ব্যাপার। তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না।
-আপনি ঘরে বসে কেন বলুন তো?
-মানে, কোথায় যাবো। আজ তো দোকান বন্ধ।
-আহ। আপনি কী করছেন?
-আমি? টিভি দেখছিলাম।
-চলুন তো।
-আরে কোথায় যাবো? দেখছ না রাস্তায় কী রকম রং খেলছে।
-রং তো খেলবেই। আপনার এত ভয় কীসের? চলুন আমার সঙ্গে। রাস্তায় যেতে হবে না।
|
যার মুখ তাকে আর মনে পড়ে না। |
ডান দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে শাশ্বতী। শাওনীর পাগলামির আর শেষ নেই। নিজে বাঁদুরে রং মেখে আবার কোথায় চলে গেছে। মাঝখানে বোধ হয় মনে পড়ল, মাকে একটু রং দিয়ে যাই। তা নিজে এলে তো শুধু হয় না, আবার পাশের ঘরের সুবিমলবাবুকে নিয়ে এল। বেচারা কী রকম অপ্রস্তুত। জীবনে বোধ হয় এই রকম পাগলামির মধ্যে পড়েননি। কী রকম ভয়ে ভয়ে কপালে আর চুলে আবির দিলেন। লোকটার মুখটা আগে কখনও ভালো করে দেখেনি শাশ্বতী। চোখ দু’টো কিন্তু ইন্টারেস্টিং। খুব ভিতু মনে হয়। কী রকম মুখ ঘুরিয়ে থাকলেন। শাওনী আবার জিলিপিও নিয়ে এসেছিল। খবরের কাগজ, আবির আর রসে মাখামাখি। দোলের দিন নাকি এই রকমই হয়। জোর করে কিন্তু খাওয়ালোও লোকটাকে।
বাঁদিকের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে সুবিমল। জামাটা ঝাড়তে গিয়ে মেঝেতে পড়ল খানিকটা আবির। গোলাপি গুঁড়ো আর ভোঁ কাট্টা হয়ে যাওয়া ঘুড়িটা, ঘরে এখন দু’টো রং। শাওনীর মা ওর মুখে আবির দিলেন। মহিলা কী ওর চেয়ে বড় না ছোট? ও দিল মাথায়। চুলে কী রকম ছড়িয়ে যায় আবির। মহিলার চুলটা শক্ত, একটু মোটা মতো। আঙুলে এখনও সেই বোধটা আছে। টিভিতে এখনও দোল দেখাচ্ছে। ছাই ছাই রঙের আবির, কালো রঙের বাঁদুরে রং। কিন্তু আসলে তো রং আছে। হঠাৎ মনে হল সুবিমলের, ওর আর শাওনীর মায়ের ছবি যদি এই সাদা কালো টিভিতে দেখায় তবে তো মনে হবে দু’জনের মুখেই চুনকালি। রং যে আছে, সেটা জানতে হয়।
জানা যায় কিন্তু ঠিক।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|