|
|
|
|
ছদ্মবেশী সুচিত্রাকেই প্রশ্ন, ‘সুচিত্রা কোথায়?’ |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
দু’হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল চালানোয় অসম্ভব দক্ষ। ছদ্মবেশ ধরতেও জুড়ি মেলা ভার। প্রথম স্বামীর সঙ্গে তাঁকে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে কখনও কখনও দোকানে চা খেতেও দেখা যেত। কিন্তু গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ পৌঁছনোর আগেই হাওয়া হয়ে যেতেন মাওবাদী দম্পতি শশধর ও সুচিত্রা মাহাতো।
শুক্রবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে সুচিত্রার আত্মসমর্পণের পরে একান্ত আলাপচারিতায় এ সবই জানাচ্ছিলেন রাজ্য পুলিশের এক কর্তা। বস্তুত, লালগড় অঞ্চলে মাওবাদী স্কোয়াডের অন্যতম জঙ্গি নেত্রী সুচিত্রাকে ঘিরে ছড়িয়ে আছে এমনই নানা তথ্য। ওই পুলিশ-কর্তার কথায়, “লালগড় তখন মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল। কিষেণজির নেতৃত্বে ওরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শুধুই কি চায়ের দোকান? একটা সময়ে তো শশধর-সুচিত্রা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, রাত-বিরেতে গ্রামীণ ঝুমুর গানের আসরে শ্রোতা হিসেবেও দেখা যেত স্বামী-স্ত্রীকে। কিন্তু পুলিশ বা যৌথ বাহিনী পৌঁছনোর আগেই ওরা ধাঁ! অসম্ভব ক্ষিপ্র ছিল জঙ্গলের মধ্যে ওদের চলাফেরা। অনেকটা কিষেণজির মতোই।”
পুলিশের তথ্য বলছে, ন’য়ের দশকের গোড়ার দিকে লালগড়ের আমলিয়া গ্রামের বাসিন্দা শশধরের সঙ্গে আলাপ হয় রামগড়ের বড়-ধানশোলা গ্রামের তরুণী সুচিত্রার। গড়বেতা কলেজের ছাত্র শশধরের সঙ্গে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। গরিব কৃষিজীবী পরিবারের মেয়ে সুচিত্রা তাঁর প্রেমিকের হাত ধরেই নকশালপন্থী জনযুদ্ধ (পিডব্লিউজি) গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন। ২০০১ সালে শালবনির পালইবনির জঙ্গলে সুচিত্রার সঙ্গে শশধরের বিয়ে হয়। তবে, কোতুলপুরের রানারহাট গ্রামের বাসিন্দা প্রবীর গড়াইয়ের সঙ্গে সুচিত্রার বিয়ের কথা জানেন না ওই মাওবাদী নেত্রীর বাড়ির লোকজন। শুক্রবার সন্ধ্যায় বড়-ধানশোলা গ্রামে সুচিত্রার বাড়িতে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা পৌঁছলে সুচিত্রার বৌদি আরতি মাহাতো বলেন, “আমার বিয়ের আগেই সুচিত্রা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তবে ও মূলস্রোতে ফিরে আসায় আমরা খুশি। এ বার তাড়াতাড়ি ওকে দেখতে চাই।” আদরের ফেতি (সুচিত্রার ডাক নাম) আত্মসমর্পণ করায় খুশি লুলকিদেবীও। তাঁর বক্তব্য, “মেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসুক।”
পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, অকুতোভয় সুচিত্রা গোপনে বেলপাহাড়ি, লালগড়, শালবনি ও গোয়ালতোড়ে পার্টির সাংগঠনিক কাজকর্ম শুরু করেন। জনযুদ্ধের একাধিক ‘অ্যাকশনে’ স্বামী শশধরের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেলপাহাড়ির দলদলির জঙ্গল রাস্তায় ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৮ পুলিশকর্মীকে মারার ঘটনায় শশধর-সুচিত্রা সক্রিয় ভাবে জড়িত বলে পুলিশের দাবি। ২০০৪-এর সেপ্টেম্বরে জনযুদ্ধ এবং এমসিসি (মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার) মিশে সিপিআই (মাওবাদী) গঠিত হওয়ার পরে ওই বছর অক্টোবরে লালগড়ের বাঁকিশোলে মাইন বিস্ফোরণে পাঁচ ইএফআর জওয়ানকে হত্যার ঘটনাতেও সুচিত্রা অভিযুক্ত। জঙ্গলমহলে মাওবাদী সংগঠনের প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন সুচিত্রা।
২০০৮ সালের নভেম্বরে লালগড় কেন্দ্রিক আন্দোলন ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গলমহলে। ওই আন্দোলন পরিচালনার নেপথ্যে কিষেণজি, বিকাশ, শশধরের পাশাপাশি সুচিত্রাও ছিলেন। সুচিত্রার ভাসুর ছত্রধর মাহাতোকে সামনে রেখে জনগণের কমিটির আন্দোলন পরিচালনা করত মাওবাদীরা। রাজ্য পুলিশের ওই কর্তা বলেন, “অসম্ভব মিষ্টি করে সাঁওতালি ভাষা বলতে পারে সুচিত্রা। ফলে আদিবাসী-মূলবাসী সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীদের স্কোয়াডে নিয়োগ করতে ওর বড় দায়িত্ব ছিল সংগঠনে। তা ছাড়া গ্রামের লোকেদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারত। ছদ্মবেশ ধরতে তো ‘মাস্টার’! এমনও হয়েছে, পুলিশ গ্রামে গিয়ে ছদ্মবেশী সুচিত্রার কাছেই জানতে চাইছে, সে গ্রামে এসেছিল কি না। কখনও দিনমজুর, কখনও খেতমজুরের রূপে কতবার যে পুলিশের চোখে ধোঁকা দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। খাস মেদিনীপুর শহরে এসে চিকিৎসা করিয়েও গেলেও পুলিশ ওকে ধরতে পারেনি।”
পুলিশ জানিয়েছে, ২০০৯ সালের জুনে জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হলে শশধর মাহাতো বিনপুর স্কোয়াড কমান্ডারের দায়িত্ব পান। আগে সুচিত্রা গোয়ালতোড়-লালগড়-শালবনি স্কোয়াডের সদস্য হলেও পরে বিনপুর স্কোয়াডে যোগ দেন। ২০০৯-এর ২০ অক্টোবর ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইল থানায় দুই পুলিশ কর্মীকে খুন করে ওসি অতীন্দ্রনাথ দত্তকে অপহরণের ঘটনার পুরোভাগে ছিলেন সুচিত্রা। ওই বছরই ২৭ অক্টোবর ভুবনেশ্বর-দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেসকে ঝাড়গ্রামের বাঁশতলায় পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখে। তাতেও সুচিত্রা ছিলেন বলে পুলিশের দাবি। ২০১০ সালের জুন মাসে ঝাড়গ্রামের সোনামুখী গ্রামে যৌথ বাহিনীর হাতে স্থানীয় মহিলাদের ‘ধর্ষিত’ হওয়ার অভিযোগকে সামনে রেখে জনগণের কমিটির মহিলা শাখা ‘নারী ইজ্জত বাঁচাও কমিটি’ গড়ে তোলার পিছনেও সুচিত্রার সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
গত বছর ১০ মার্চ জামবনির চনসরো গ্রামে যৌথ বাহিনীর গুলিতে নিহত হন শশধর। এর পরেই বিনপুর স্কোয়াডের কমান্ডার হন সুচিত্রা। গত বছর ২৪ নভেম্বর জামবনির বুড়িশোলের জঙ্গলে কিষেণজি নিহত হওয়ার রাতে সুচিত্রা গুলিবিদ্ধ হয়ে পালিয়ে যান বলে পুলিশ দাবি করে। তাঁকে চিকিৎসা করার অভিযোগে এক হাতুড়ে ভূদেব মাহাতো এবং পরে মাওবাদী নেত্রীকে সাইকেলে চাপিয়ে পালাতে সাহায্য করার অভিযোগে জামবনিরই সরাকাটা গ্রামের তরুণ পিন্টু টুডুকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তিন মাস জেল খাটার পরে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দু’জনেই জামিনে মুক্তি পান।
এই ক’মাস সুচিত্রা কোথায় ছিলেন, তা নিয়ে রহস্য যথেষ্টই। শুক্রবার মহাকরণে জানা গেল, ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। এক সময়ের দুর্ধর্ষ জঙ্গি নেত্রী ফিরেছেন সমাজের মূলস্রোতে। |
|
|
|
|
|