|
|
|
|
দাবি, বুড়িশোলের পর গ্রামেই ছিলেন |
মহাকরণে মমতার পাশে হাজির মাওবাদী সুচিত্রা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বিনপুরের বুড়িশোল জঙ্গলে কিষেণজির মৃত্যুর পরে যৌথবাহিনীর নজর এড়িয়ে সুচিত্রা মাহাতো পালালেন কী করে, এ নিয়ে জল্পনা ছিলই। প্রশ্ন উঠেছিল, তা হলে কি ওই মাওবাদী নেত্রী দলের স্কোয়াড সদস্যদের সঙ্গে ‘গোপন শিবিরে’ না-থেকে অন্য কোনও ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ আছেন?
ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন মাস পরে, শুক্রবার দুপুরে রাজ্যের একাধিক পুলিশকর্তার ঘেরাটোপে মহাকরণে এলেন সুচিত্রা। তাঁকে পাশে রেখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “আজ আমার ভাল লাগছে। সুচিত্রা আত্মসমর্পণ করতে এসেছে। ও বহু দিন মাওবাদী আন্দোলনে ছিল। নেতৃত্ব দিয়েছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
দু’দিন আগেই জিটিএ বিলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরকে ‘দোলের আগে মিষ্টিমুখ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর এ দিন সুচিত্রার আত্মসমর্পণকে বলেছেন ‘বসন্ত উৎসবের উপহার।’ প্রশাসনের একাংশের ধারণা, এ ভাবে পাহাড়-জঙ্গলকে পাশাপাশি রেখে দু’টিরই সমস্যা সমাধানে তাঁর অগ্রগতির বার্তা দিতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাহাড় প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “জিটিএ বিল পাশ হয়ে গিয়েছে। এ বার সেখানে নির্বাচন হবে।” আর জঙ্গল নিয়ে বলেন, “এখন তো সবে দোল হল। এটা (সুচিত্রার আত্মসমর্পণ) বলতে পারেন দোলের সবচেয়ে বড় উপহার। বসন্ত উৎসবের উপহার।” মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে ১৩টি মানবাধিকার কোর্ট হয়েছে। কিছু বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ইস্তেহারে যা যা বলা হয়েছে, তা-ই হবে। যেগুলো বাকি আছে, হয়ে যাবে। তিন মাস বাদে দেখতে পাবেন।” |
|
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মহাকরণে সাংবাদিক বৈঠকে সুচিত্রা।
রয়েছেন স্বামী প্রবীরও (মাঝখানে)। ছবি: সুদীপ আচার্য |
গত বছরের ২৪ নভেম্বর বুড়িশোলের জঙ্গলে যৌথবাহিনীর গুলিতে কিষেণজির মৃত্যু হয়। পুলিশ তখন জানিয়েছিল, ওই মাওবাদী শীর্ষ নেতার সঙ্গে তাঁর দুই বিশ্বস্ত দেহরক্ষী ছাড়াও ছিলেন দীর্ঘ দিনের সঙ্গী সুচিত্রা। লড়াইয়ে পেটে গুলি লাগলেও তিনি পালিয়ে গিয়েছেন বলে পুলিশ তখন দাবি করলেও ‘সংঘর্ষে’ তাঁর আহত হওয়ার পক্ষে কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি। তন্নতন্ন করে খুঁজে বুড়িশোলের জঙ্গলে মাত্র এক জায়গাতেই রক্তের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। সেটি নিহত কিষেণজির থুতনি থেকে বেরোনো রক্ত। রাজ্যের একাধিক পুলিশকর্তারও বক্তব্য, “এক জন মহিলার পেটে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি লাগলে সেই অবস্থায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া নিতান্ত কঠিন। তা ছাড়া সে ক্ষেত্রে মাটিতে বা গাছের গায়ে রক্তের দাগ থাকবেই।”
পুলিশি তথ্য ধরে জানা গিয়েছিল, সে দিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ যৌথবাহিনীর সঙ্গে গুলির ‘লড়াই’ শেষ হয়ে গিয়েছিল কিষেণজিদের। তখনও জঙ্গল ঘিরে ছিল শ’য়ে শ’য়ে পুলিশ। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছিল, তাদের নজর এড়িয়ে দিনের আলোয় অগভীর বুড়িশোলের জঙ্গল ছেড়ে সুচিত্রা পালালেন কী ভাবে? সুচিত্রাকে মহাকরণে পেয়ে এ দিনও তাঁর কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চান, “এত দিন কোথায় ছিলেন? বুড়িশোলের জঙ্গল থেকে পালালেন কী ভাবে? চিকিৎসাই বা কোথায় হয়েছিল?”
লাগাতার প্রশ্নের মুখে দৃশ্যত হতচকিত সুচিত্রাকে পাশে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আপনারা পুলিশের মতো জেরা করছেন! এটা ঠিক নয়। ওঁদের দীর্ঘ দিন অনেক কষ্ট করে অনেক জায়গায় থাকতে হয়েছে। এটা ওঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
সুচিত্রাকে প্রশ্ন করা হয়, “ঘটনার দিন তো আপনি বুড়িশোলের জঙ্গলে কিষেণজির সঙ্গে ছিলেন। সত্যিই কি পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল?”
আবার এগিয়ে আসেন মুখ্যমন্ত্রী। সুচিত্রাকে আড়াল করে এ বার বলেন, “ওঁরা এখন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। এখন এ সব প্রশ্ন কেন করছেন? বিষয়গুলো মানবিক ভাবে দেখতে হবে।” মমতার বক্তব্য, “কিষেণজির মৃত্যু জোর করে ঘটিয়েছি, এমনটা নয়। ঘটনাচক্রে ঘটে গিয়েছে। পুলিশও জানত না। আমিও জানতাম না। সে দিন দিল্লিতে ছিলাম। আমরা কারও মৃত্যু চাই না।”
এ বার মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রশ্ন, “২৪ নভেম্বর বুড়িশোলে কী হয়েছিল, এ নিয়ে সুচিত্রার সঙ্গে কি কোনও কথা হয়েছে?”
মমতা বলেন, “কেন এই প্রশ্ন করছেন? আপনারা সব গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ ভাবে খবর বিকৃত করেন আপনারা!” মুখ্যমন্ত্রী জানান, “তখন সুচিত্রার কোমরে গুলি লেগেছিল। গ্রামে গ্রামের মতো চিকিৎসা হয়েছে। এখন প্রকৃত চিকিৎসা করাতে হবে।” নিজের বক্তব্য জানাতে গিয়ে সুচিত্রা বলেন, “পুলিশ আমাকে ধরেনি। আমি গ্রামেই ছিলাম।”
|
কে এই সুচিত্রা
|
বয়স: ৩৪।
বাড়ি: লালগড় থানার বড়-ধানশোলা গ্রামে।
শিক্ষা: সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত
(রামগড় মোক্ষদা সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়)।
কী ভাবে মাওবাদী: প্রথম জীবনে জনযুদ্ধ। পরে সিপিআই (মাওবাদী)-এ।
অন্য নাম: মাওবাদী স্কোয়াডে সুলেখা ওরফে ঝর্না নামে পরিচিত।
প্রথম স্বামী: যৌথ বাহিনীর গুলিতে নিহত মাওবাদী স্কোয়াড
নেতা শশধর মাহাতো।
দ্বিতীয় স্বামী: প্রবীর গড়াই।
শেষ পদ: বিনপুর স্কোয়াডের কম্যান্ডার।
দক্ষতা: দু’হাতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক চালানোয় পারদর্শী। দক্ষ ছদ্মবেশেও।
অভ্যাস: ঘনঘন চা পান।
মামলা: সাঁকরাইল থানায় হামলা ও ওসি অপহরণ, শিলদা কাণ্ড-সহ খুন ও নাশকতার অন্তত ৩০টি। |
|
কিন্তু আত্মসমর্পণ করলেন কোথায়?
এ বার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এডিজি (আইবি) বাণীব্রত বসু মুখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলেন, ‘‘আইবি অফিসে।’’ মুখ্যমন্ত্রীও সে কথাই বলেন। তাঁর শান্তি ও উন্নয়নের আহ্বানে সাড়া দিয়েই যে মূলস্রোতে ফেরা, তা জানিয়ে সুচিত্রার মন্তব্য, “আমি অনেক দিন মাওবাদী জীবন কাটিয়েছি। জঙ্গলে থেকেছি। এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই।”
এ দিন মহাকরণে সুচিত্রার পাশে ছিলেন তার স্বামী প্রবীর গড়াইও। একদা লালগড় আন্দোলনে যুক্ত প্রবীরের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগও আছে পুলিশের খাতায়। আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে এ দিন প্রবীরবাবু বলেন, “শুধু রাজ্যের উন্নয়নের জন্যই নয়, আরও কারণ আছে এর পিছনে। এক কথায় বলা যাবে না।” প্রবীরের দাবি: ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বিয়ে হয়েছে। সুচিত্রার নিজের গ্রাম লালগড়ের ধানশোলে ছিল তাঁর আগের শ্বশুরবাড়ি। ছ’মাস আগে তাঁর প্রথম স্ত্রী মারা গেলে তিনি সুচিত্রাকে বিয়ে করেন বলে জানিয়েছেন প্রবীর।
সুচিত্রা যে ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ ছিলেন না, তা বোঝাতেই দু’জনের ‘সদ্যবিবাহের’ বিষয়টি প্রকাশ্যে আনা হল কি না, কিছু মহল থেকে অবশ্য সেই প্রশ্নও উঠেছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মতে, পুরো ব্যাপারটাই ‘গড়াপেটা।’ প্রবীর-সুচিত্রার মূলস্রোতে ফেরাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে এ দিন রাতে পুরুলিয়া সার্কিট হাউসে সূর্যবাবু বলেন, “আত্মসমর্পণ সাজানো নাটক! প্রবীর বাঁকুড়ার কোতুলপুরে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ। এই আত্মসমর্পণ অবিশ্বাস্য। স্পষ্ট গড়াপেটা খেলা।” তাঁর প্রশ্ন, “এঁরা (রাজ্য প্রশাসন) জানতেন না সুচিত্রা কোথায় ছিলেন? আজ হঠাৎ করে উপস্থিত হলেন?” সূর্যবাবুর দাবি, “প্রবীর বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার পর থেকে প্রকাশ্যে তৃণমূল করেন। কোতুলপুরে যাঁরা বালি তোলেন, তিনি তাঁদের নেতৃত্বে। এমনকী, থানায় বসে মিটিংও করেছেন।” বিরোধী দলনেতার অভিযোগ, “মাওবাদীদের হাতে দু’শোরও বেশি বামপন্থী নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। সেখান থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই আত্মসমর্পণের নাটক।”
দিল্লিতে পলিটব্যুরোর বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার আগে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও এ দিন সন্ধ্যায় বিমানবন্দরে অভিযোগ করেন, “সুচিত্রাকে আগেই আটক করা হয়েছিল। পুলিশি হেফাজতে ছিলেন। উনি আত্মসমর্পণ করেছেন, এটা আগেই দেখানো উচিত ছিল। কিন্তু এখন সরকারি ভাবে ওঁর আত্মসমর্পণ দেখানো হল।” সুচিত্রার নাম না-করে বিমানবাবুর মন্তব্য, “দলেরই কেউ কিষেণজিকে ধরিয়ে দিয়েছিল বলে মাওবাদীদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।”
অন্য দিকে মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতোর আত্মসমর্পণকে ‘কেন্দ্র-রাজ্যের যৌথ ‘সাফল্য’ হিসেবে দেখছেন জোট-শরিক কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। তাঁর বক্তব্য, “কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহ্বানেই সুচিত্রা অস্ত্র সংবরণ করে আত্মসমর্পণ করেছেন। এখনও যাঁরা জঙ্গলমহলে অস্ত্র হাতে জঙ্গি কার্যকলাপে যুক্ত, আশা করি তাঁরাও সুচিত্রার মতো অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করবেন।” প্রদীপবাবু বলেন, “এ রাজ্যের অনুন্নত জেলাগুলির উন্নতির জন্য কেন্দ্র অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। সেই উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে মাওবাদীরা সাহায্য করবেন, সেটাই চাই।” |
|
|
|
|
|