|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
‘নোবেল চোর’এর মতন সরল ছবি বানানোটাই সব থেকে শক্ত |
না-বলা কথা। জীবন। স্বপ্ন। জানালেন পরিচালক সুমন ঘোষ। মুখোমুখি সুদীপ ঘোষ |
|
পত্রিকা: তা হলে ‘নন্দনে জন্ম-নন্দনে মৃত্যু ছবির’ পরিচালকের তকমাটা ঝেড়ে ফেলা গেল?
সুমন: সেটা আমি কী করে বলব? তবে মনে হচ্ছে হ্যা। অবশ্য কোনও পরিচালকের যদি ওই তকমাটা ঝেড়ে ফেলাই কেরিয়ারের লক্ষ্য হয়, তা হলে আমার সমস্যা আছে। আমি অতটা মাথায় রেখে কাজ করি না।
পত্রিকা: কিন্তু সঠিক পথের সন্ধান পেতে প্রায় বছর পাঁচেক সময় লাগল আপনার। তার মধ্যে দু’টো ছবি খরচ হয়ে গেল। এত দিন লাগল কেন একটা সহজ-সরল ছবি বানাতে?
সুমন: একটা সহজ, সরল ছবি বানানোটাই কিন্তু সব থেকে শক্ত কাজ। হ্যাঁ, প্রথম ছবি করার সময় অনেক ইম্যাচিউরিটি থাকেআমি এই বলব, সেই বলব। কিন্তু সেগুলো পেরিয়ে এসে এই ছবিটা যে আমি করতে পেরেছি, তার জন্য আমি মিঠুনদা’র কাছে কৃতজ্ঞ। কমিউনিকেশনটা গুলে খেয়েছেন তো। বিনোদনের মোড়কে কী ভাবে গভীর কথা বলে দিতে হয়, তাতে অনেকটা গাইড করেছেন। হয়তো বেশির ভাগ মানুষই এন্টারটেইনড হয়ে হাততালি দিচ্ছেন। কিন্তু ‘নোবেল চোর’ আমার বানানো সবচেয়ে সিরিয়াস ফিল্ম।
পত্রিকা: টালিগঞ্জের সবার এত ভাল লাগল। সৃজিত মুখোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তীরা এত প্রোমোট করলেন। কিন্তু ছবিটা সে ভাবে বাজার ধরতে পারল না...
সুমন: ছবিটা পাঁচ সপ্তাহে পড়বে। সেটা বাজার না ধরতে পারলে হত? রাজ, সৃজিতরা প্রথমে যে পুশটা দিয়েছিল, সেটা তো সাহায্য করেছে বটেই। দেখুনপ্রথম সপ্তাহে সমস্যা ছিল। তবে অমন সমস্যার মুখোমুখি আরও অনেক ছবি হয়েছে। ‘কালবেলা’ অত বড় হিট। পিক-আপ করতে সময় লাগিয়েছিল। ‘অটোগ্রাফ’-ও তো সময় নিয়েছিল ধরতে। সেটাই আমায় রাজ, সৃজিত সমানে বলে গেছে যে একটু সময় লাগবে।
পত্রিকা: আর বিষয়টা? রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে তো তাঁর কোনও লেখা নিয়েও ছবি করা যেত...
সুমন: যেত। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই অন্য দিকে গেছি। সার্ধশতবর্ষে এত কিছু হল তো। এই সবের পর ‘নোবেল চোর’ এল। এবার এইটা দেখ। এমন সব ডায়ালগ আছে‘রবীন্দ্রনাথকে খাবে?’, ‘আবে রবীন্দ্রনাথ বে... ঠাকুর তো’। অনেকে রেগেও গেছেন এ সব শুনে। কিন্তু এই প্রত্যেকটা ডায়ালগের মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত মানেও আছে। এটা কিন্তু একভাবে অ্যান আল্টিমেট হোমেজ টু রবীন্দ্রনাথ।
পত্রিকা: কিন্তু মায়ামির সমুদ্রের ধারের অ্যাপার্টমেন্টে থেকে বোলপুরের গ্রামের গল্প ঠিকঠাক বলা যায়?
সুমন: হ্যাঁ, অনেকে এটা বলছেন। আমার উত্তর হল আমি মফস্সলের ছেলে। সেখান থেকে কলকাতা। তারপর দিল্লি। তারপর নিউ ইয়র্ক, মেক্সিকো সিটি, মায়ামি। এই হল আমার লাইফের জার্নি। আমি গ্রামে যাই এখনও। গ্রামটা কী, জানি। আসল হল পরিপ্রেক্ষিত। মায়ামি আর কলকাতার মধ্যে যে দূরত্ব, সেটা ছিল বলেই আমি বক্তব্যটা এই ভাবে রাখতে পেরেছি। |
|
‘নোবেল চোর’-এর শ্যুটিংয়ে |
পত্রিকা: ছবি মুক্তির পর মিঠুন চক্রবর্তী কী বললেন?
সুমন: মুম্বই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটা প্রথম দেখেছিলেন। তারপর তো আনন্দবাজারে বলেই দিলেন ওঁর সাতটা সেরা ছবির মধ্যে এটা একটা।
আর কাজটা করার পর তো আই অ্যাম ইন লাভ উইথ হিম। ছবিটা হতই না ওঁকে ছাড়া। প্রথমে ভেবেছিলাম কাজটা হয়তো একসঙ্গে করব, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা হবে না। ছবিটা শেষ হওয়ার পর এটুকুই বলব লোকটার বাইরের ক্যাওড়ামোটা একটা মোড়ক। তানিস্লাভস্কি, ডেভিড লিন, এঁদের কাজ নিয়ে আলোচনা হত আমাদের মধ্যে।
শু্যটিংয়ের শেষ দিন, লাস্ট শটের আগে আমি ওঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম। যে এই দিনগুলো আর ফিরে আসবে না। আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘সুমন, উই হ্যাভ আ লং ওয়ে টু গো। আমরা আবার একসঙ্গে হাঁটব’। তারপর শেষ দৃশ্যটা শু্যট করে সোজা বেরিয়ে গেলেন। সেদিন আর আমার সঙ্গে দেখা করেননি।
পত্রিকা: ‘নোবেল চোর’ দেখে গোটা টালিগঞ্জ স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিল। সে সময়ে প্রথম কী মনে পড়ছিল?
সুমন: মণি রত্নমের কথা মনে পড়ছিল ভীষণ ভাবে।
পত্রিকা: মানে?
সুমন: ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল গোয়ার ইন্ডিয়ান প্যানোরামায়। আমার ‘দ্বন্দ্ব’ ছবিটা নিয়ে গিয়েছিলাম। পরিচয় হওয়ার পর উনি জিজ্ঞেস করেন ‘দ্বন্দ্ব’ কলকাতায় কেমন চলছে। আমি বলি ভাল না। খুবই খারাপ সমালোচনা হচ্ছে। তখন উনি বলেন ‘খারাপ সমালোচনায় ভেঙে পড়বে না। সাফল্যতেও উৎফুল্ল হবে না। কাজে কনসেনট্রেট করো।’ সেই কথাটাই বারবার মনে পড়ছিল সেদিন। যাঁরা স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিলেন, বাহবা দিলেন, তাঁরাই কিন্তু পরের ছবিটা খারাপ হলে আমায় ছুঁড়ে ফেলতে পারেন।
পত্রিকা: যেমন ‘দ্বন্দ্ব’কে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন বিদেশি ছবি থেকে টোকা...
সুমন: প্রসঙ্গটা যখন উঠলই, তখন বলি, আমি অত বোকা না যে কিস্লভস্কি থেকে টুকব। টোকার হলে আমি এমন পরিচালকের থেকে টুকব যে এখানে কেউ বুঝতেও পারবে না। ‘দ্বন্দ্ব’-তে আমি টুকিনি সারমর্মটা নিয়ে গল্পটাকে অন্য দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। এন্ড ক্রেডিটস-এ আমি কিস্লভস্কির ঋণ স্বীকারও করেছিলাম। এখানে তো কেউ ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পর অপেক্ষা করেন না। হয়তো চোখে পড়েনি। আমার মনে হয়েছিল এটা কিছু লোকের ইমম্যাচিউরিটি।
পত্রিকা: কিন্তু তখন তো দুঃখ পেয়েছিলেন...
সুমন: তখন তো আমি নতুন। এখানে থাকি না। আমায় নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে ঠাট্টা ইয়ার্কি হচ্ছে। কাউকে চিনি না। তাই চুপ করে গিয়েছিলাম। সে সময়ে বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) এক দুপুরে আমায় ফোন করে বাড়িতে ডাকেন। সবাই যখন দূর-ছাই করছে, তখন ইন্ডাস্ট্রির মাথা যে লোকটা, তিনি আমায় ডেকে একটা পেপ-টক দেন। বলেন আমেরিকায় যা, নতুন করে ভাব।
ঠিক করেছিলাম এই ইন্ডাস্ট্রিকেই আমি একটা ছবি করে দেখাব যেটা দেখে এঁরা বাহবা দিতে বাধ্য হবেন।
পত্রিকা: সেই ছবিটা করলেন, আর ইন্ডাস্ট্রির তাবড় সেলিব্রিটিরা আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীও হয়ে উঠলেন...
সুমন: যাঁরা ‘নোবেল চোর’কে সাপোর্ট করছেনতাঁরা আমার ভাল বন্ধুও। রাজ, সৃজিত, টোনিদা (অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী)। কিন্তু এটাও মনে রেখেছি, পরের ছবিটাই কিন্তু আবার ধপাস করে ফেলে দিতে পারে। তবে হ্যা। এদের সাপোর্ট দেখে বুঝছি, আমি সঠিক পথে হাঁটছি।
পত্রিকা: কী রকম?
সুমন: টোনিদার সঙ্গে আমার বহুদিনের সম্পর্ক। কিন্তু রাজকে আমি সে ভাবে চিনতামই না। ‘অপরাজিতা তুমি’র মিউজিক লঞ্চ পার্টিতে হাল্কা আলাপ হয়েছিল। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। সৃজিত কলেজে আমার জুনিয়র ছিল, কিন্তু ওর সঙ্গেও আলাপ ছিল না তেমন। পরে আমায় সৃজিত বলল, রাজ সিনেমা দেখে বেরিয়ে এসে কেঁদে ফেলেছিল। এরা তো আমার থেকে ছবির জগতে অনেক বেশি সফল। অথচ ‘নোবেল চোর’-এর প্রোমোশনের জন্য রাজ শু্যটিং ক্যানসেল করে চলে এসেছে। সৃজিত ডাবিং বন্ধ করে চলে এসেছে। একটা সিনেমা দিয়েই তো এমন ভাল সব বন্ধু পেলাম।
পত্রিকা: এই সব হইচইয়ের মধ্যে আপনার স্ত্রী থাকেন না, না?
সুমন: না, না। ও সব কিছুই জানে। যথেষ্ট ইন্টারেস্টও আছে। কিন্তু ও ওর জগতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। মায়ামিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। লাইমলাইটে আসতে চায় না।
পত্রিকা: আর আপনি? প্রফেশন হিসেবে শেষ পর্যন্ত কোনটা নেবেন? পড়ানো, না ছবি তৈরি?
সুমন: কেবল ছবি বানাতে গেলে অনেক বেশি ছবি বানাতে হবে। অত তাড়াতাড়ি ছবি বানাতে পারি না। আর দূরত্বটাও জরুরি। না হলে আমার অন্তত প্যাশনটা আসবে না। প্রথম ছবিটা বানাবার সময় ইউনিভার্সিটিতে মিথ্যে বলে ছুটি নিয়েছিলাম। তখন ওখানেও আমি নতুন। এখন তো সে জায়াগায় আমি অনেক বেশি সেটেল্ড। ছবি বানাতে গিয়ে ক্লাস কামাই হয় বটে। কিন্তু ঝুঁকিটা নিতে ভাল লাগে। সব অনিশ্চয়তাকে বুকে জড়িয়ে জীবনটাকে তিলে-তিলে এনজয় করতে চাই। |
|
|
|
|
|