উত্তর কলকাতা
শ্রীরামকৃষ্ণ-স্মৃতি
অগ্রগতির ভিটে
পিছিয়ে পড়া অথচ সম্ভাবনাময় কয়েক জন ছাত্রীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। সেখানেই এখন প্রায় হাজারখানেক ছাত্রী। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মনির্ভর করে তোলার পাশাপাশি ছাত্রীদের ব্যক্তিত্ববিকাশেও সচেষ্ট শ্রীসারদা মঠের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকেন্দ্র ‘রসিক ভিটা’।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পিছনের দিকে ২৪/১ আর এন টেগোর রোডে পথ চলা শুরু হয়েছিল দশ বছর আগে, ২০০২-এর ১৬ জানুয়ারি। যদিও সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়েছিল তারও কয়েক বছর আগে। শ্রীসারদা মঠ-সূত্রে জানা গিয়েছে, আজকের ‘রসিক ভিটা’ যেখানে অবস্থিত সেখানেই কয়েক বছর আগে ছিল ‘রামকৃষ্ণ বাণপ্রস্থ আশ্রম’। ১৯৯৯-এ সেই আশ্রমের অছি পরিষদের সম্পাদক যুগল মাইতি জায়গাটি শ্রীসারদা মঠের হাতে তুলে দেন। তখন থেকেই শ্রীসারদা মঠ এবং রামকৃষ্ণ সারদা মিশন পরিকল্পনা করে, ওই জায়গায় মেয়েদের, বিশেষ করে সমাজে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র মেধাবী মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য একটি আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।
সেই লক্ষ্যে ভগ্নপ্রায় দোতলা বাড়ি ও জঙ্গল সংস্কার করে প্রায় সাড়ে ৩ কাঠা জমিতে ১৯৯৯-এর ২৩ শে নভেম্বর ‘রসিক ভিটা’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শ্রীসারদা মঠ ও রামকৃষ্ণ সারদা মিশনের তৃতীয় অধ্যক্ষ প্রব্রাজিকা শ্রদ্ধাপ্রাণা। পরে ২০০১-এর শেষের দিকে সেখানে একটি চারতলা বাড়ি তৈরি হয়। নাম দেওয়া হয় ‘রসিক ভিটা’।
এই নামের পিছনেও রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কিত একটি কাহিনি। শ্রীসারদা মঠ-সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের বাগানের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে কিছুটা গেলেই ছিল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ঝাড়ুদার, মেথর রসিকের বাড়ি (বর্তমানে যা ‘রসিক ভিটা’)। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ বেশ কয়েক বার গিয়েছেন। কথিত আছে, সাধনকালে শ্রীরামকৃষ্ণ জাতি, অভিমান, লজ্জা, ঘৃণা, ভয় ইত্যাদি অষ্টপাশ ছিন্ন করে মাতৃদর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন। সে সময় সত্যিই তিনি অষ্টপাশ থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন কি না তা জানার জন্য নিজেই নিজের পরীক্ষা নিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। এক দিন গভীর রাতে তিনি সকলের চোখ এড়িয়ে পৌঁছে গেলেন রসিকের বাড়ি। সেখানে গিয়ে নিজের লম্বা চুল দিয়ে পরিষ্কার করলেন মেথর রসিকের বাড়ি।
এক দিন পঞ্চবটীতে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে রসিক কৃপা ভিক্ষা করে বলেছিলেন, ‘বাবা আমার কী হবে?’ তখন শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুক্ষণ সমাধিস্থ থাকার পরে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর সময় আমার দেখা পাবি।’ ঘটেছিলও তাই। মৃত্যুর আগে রসিককে তাঁর বাড়ির তুলসীমঞ্চের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। মৃত্যুর কিছু আগে তিনি বলে ওঠেন, ‘এই যে এসেছে, বাবা এসেছে’। শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলিধন্য বাড়িটির নাম তাই ‘রসিক ভিটা’ রাখা হয়েছে।
রসিক ভিটার সেন্টার ইনচার্জ প্রব্রাজিকা অশেষপ্রাণা জানান, এখানে কম্পিউটার, স্পোকেন ইংলিশ, চাকরির ক্যাম্পাসিং এর জন্য প্রস্তুতি এই তিনটি বিষয়ের উপরই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কম্পিউটারের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আড়াই মাস থেকে এক বছরের কোর্স রয়েছে। এই মুহূর্তে প্রায় ৫০০ জন ছাত্রী কম্পিউটারের বিভিন্ন কোর্সে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। পাশাপাশি স্পোকেন ইংলিশেও রয়েছে বিভিন্ন স্তরের কোর্স। যেখানে ছাত্রী রয়েছে প্রায় ৪৫০।
কম্পিউটার ও ইংরেজি বিষয়ে মাধ্যমিক থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ছাত্রীরা প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। তবে চাকরির ক্যাম্পাসিং এর জন্য প্রস্তুতি বিষয়ে ৪৮ ঘণ্টা ও ৬০ ঘণ্টার কোর্সে মূলত ইঞ্জিনিয়ারিং, এমবিএ, বিবিএ ও এমসিএ-এর ছাত্রীরাই প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। প্রব্রাজিকা অশেষপ্রাণা বলেন, “এখানে প্রতিটি প্রশিক্ষণই খুব কম খরচে দেওয়া হয়। তবে দরিদ্র মেধাবী ছাত্রী ও মেয়েদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মেধাবী ছাত্রীদের জন্য রয়েছে স্কলারশিপের ব্যবস্থাও। এখন রসিক ভিটা থেকে ভিডিও কনফারেন্স ব্যবস্থায় প্রত্যন্ত গ্রামে শিক্ষাদান করার বিষয়েও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।”
শুধু প্রশিক্ষণই নয়। তা বাস্তবে প্রয়োগের বিষয়েও চিন্তাভাবনা করেন রসিক ভিটা কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি প্রশিক্ষণশেষে চাকরি পাওয়ার বিষয়েও ছাত্রীদের সহযোগিতা করা হয়। প্রব্রাজিকা অশেষপ্রাণা জানান, প্রতিটি কোর্সের সঙ্গে ছাত্রীদের আবশ্যিক ভাবে ‘সংস্কৃতি ঐতিহ্য’-এর উপরও ক্লাস করানো হয়। এ ছাড়াও ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের জন্য বিভিন্ন আলোচনাসভা, কর্মশালারও আয়োজন করা হয় রসিক ভিটাতেই। বিভিন্ন সামাজিক কাজেও অংশগ্রহণ করেন রসিক ভিটার ছাত্রীরা। এক ছাত্রী অদ্রিজা চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শুধু প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরি পাওয়াই নয়।
এখান থেকে মানসিক ব্যক্তিত্ববিকাশের দিকটাও খুলে যায়।”




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.