দু’-তিন মাস নয়। এক-দু’বছরও নয়। পাঁচ-পাঁচটা বছর পেরিয়ে গেল, অফিসে আসছেন না দীপু হেলা। শেষ এসেছেন ২০০৭-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি!
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের পাকা চাকরি! তাই টানা পাঁচ বছর কাজে অনুপস্থিত থাকলেও কলকাতা বিমানবন্দরের সাফাইকর্মীদের তালিকায় তাঁর নাম এখনও রয়েছে। নিয়মিত চাকরি করলে তিনি এখন মাসে বেতন পেতেন প্রায় ৪৫ হাজার টাকা! গরহাজিরার জন্য বেতন মেলে না ঠিকই। তবে ফি মাসে তাঁর নামে স্বাস্থ্য-ভাতা জমা পড়ছে। সেখান থেকে কাটা যাচ্ছে পিএফের টাকাও।
বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক (ইন্টারন্যাশনাল) ও অভ্যন্তরীণ (ডোমেস্টিক) বিল্ডিংয়ে যাত্রীর চাপ দিন দিন বাড়ছে। তুলনায় শৌচালয়ের সংখ্যা কম। ফলে প্রতিটি শৌচাগারের সামনে লম্বা লাইন পরিচিত দৃশ্য। উপরন্তু শৌচালয়ের অপরিচ্ছন্নতার অভিযোগ নিত্যদিন মিলছে যাত্রীদের কাছ থেকে। শৌচালয় পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব দীপুবাবুর মতো সাফাইকর্মীদের। এ দিকে বেশ ক’বছর নিয়োগ বন্ধ থাকায় যত জন সাফাইকর্মী থাকার কথা, এমনিতেই আছেন তার তুলনায় কম। কত কম?
বিমানবন্দর-সূত্রের খবর: আন্তর্জাতিক বিল্ডিং সাফসুতরো রাখতে প্রতি শিফ্টে পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে ৩২ জন সাফাইকর্মী দরকার। ডোমেস্টিকে ৩৬ জন। কিন্তু অধিকাংশ শিফ্টে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে ১৪-১৮ জনের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। তার উপরে দীপু হেলার মতো কিছু লোক ‘থেকেও’ নেই।
ফলে যাঁরা কাজে আসছেন, তাঁদের উপরে চাপ বাড়ছে। সাফাই ঠিকঠাক না-হওয়ায় দুর্ভোগ বাড়ছে যাত্রীদের। কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, বাইরের সংস্থাকে দিয়ে সাফাইয়ের কাজ করাতে চাইলে ইউনিয়ন বেঁকে বসছে, অথচ ছুটি নিয়ে ‘বসে থাকা’ কর্মীদেরও কাজে ফেরানোরও ক্ষমতা ইউনিয়নের নেই।
দীপু হেলার মতো কালকুট্টি নায়েকও ‘বসে থাকা’ এক জন। বাবার মৃত্যুর পরে ১৯৯৬-এ সাফাইকর্মীর চাকরি পেয়েছিলেন। । বিমানবন্দরের লাগোয়া কেন্দ্রীয় সরকারের কোয়ার্টার্সে থাকেন মা, স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে। বাড়িতেই বসে থাকেন। কাজে আসেন না। দীর্ঘ দিন এ ভাবে চলার পরে খাতা থেকে তাঁর নাম কাটা যায়। ইউনিয়ন কর্তাদের অনুরোধে তাঁকে পুনর্বহালও করেন কর্তৃপক্ষ। কালকুট্টি তখন কথা দিয়েছিলেন, নিয়মিত কাজে আসবেন। ক’মাস ‘নিয়ম’ মানার পরে গত বছরের ৭ অগস্ট থেকে আবার ডুব মেরেছেন। ডিউটিতে যান না কেন?
নিজের কোয়ার্টার্সে বসে বছর পঁয়ত্রিশের যুবকটি বললেন, “পায়ে ব্যথা। তাই যাই না।” কিন্তু পা তো দেখছি দিব্যি রয়েছে!
পরের ব্যাখ্যা, “ভাল লাগে না। মায়ের শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। বাড়িতে থাকতে হয়।” কাজে না-গেলে তো টাকাও পান না! চলে কী ভাবে?
কালকুট্টি বলেন, “জানি তো! টাকার তো খুব দরকার!”
তা-ও তাঁর চাকরিতে অনীহা। যেমন অনীহা বুধিদেবীর। গত বছরের ৪ অগস্ট থেকে কাজে আসেন না। নিজের কোয়ার্টার্সের গায়ে দরমার ঝুপড়ি বানিয়ে থাকেন, আর সরকারের দেওয়া কোয়ার্টার্স ভাড়া দিয়ে মাসে তিন হাজার টাকা পান। তাঁর যুক্তি, “পায়ে ব্যথা! তাই চাকরি করতে চাই না। নেপালে আত্মীয়দের কাছে চলে যাব।”
নিয়মিত ডিউটি, ওভারটাইম করলে করলে যে চাকরিতে মাসে গড়ে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা রোজগার, যে চাকরির জন্য এখন স্নাতকোত্তর ছেলেমেয়েরাও হন্যে, সেই কাজ এঁরা হেলায় ছেড়ে যেতে চান কেন?
কর্মী ইউনিয়নের সম্পাদক দীপঙ্কর ঘোষ বলেন, “কিছু লোক এমনই। আমরা তো বোঝাই। নিজের ভাল কেউ বুঝতে না-পারলে কার কী করার আছে?”
কর্তৃপক্ষ বাইরের লোক দিয়ে টয়লেট সাফ করাতে চাইলে বাধা দেন কেন?
দীপঙ্করবাবুর মন্তব্য, “তা হলে সমস্ত দফতরের কাজই বাইরের লোক দিয়ে করানো হোক! বিমানবন্দরের অধিকর্তার কাজও বাইরের লোক করুক না!” শৌচালয়ে জলের আয়রন দূর করতে জন্য এখন দু’জন ‘বাইরের লোক’ আছেন। তাঁরা রাতে এসে কাজ সেরে চলে যান। দীপঙ্করবাবুদের অবশ্য তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা বিমানবন্দর সাফাইয়ের দায়িত্ব বাইরের সংস্থাকে দেওয়ার পক্ষপাতী নন তাঁরা।
দীপু-কালকুট্টি-বুধিদের মতো কর্মীর বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না?
বিমানবন্দরের অধিকর্তা বি পি শর্মা বলেন, “রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। পেলেই ব্যবস্থা হবে।” দীপঙ্করবাবুও জানিয়ে রাখছেন, ওঁদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিলে ইউনিয়ন আর প্রতিবাদ করবে না। |