বিরোধিতা করলে যা নিয়ে আন্দোলন, ক্ষমতায় থাকলে তা-ই ‘চক্রান্ত’!
দলমতনির্বিশেষে রাজনীতির
ধারাই এই। পুলিশ কখনও ‘অনুভূতিহীন’,
কখনও ‘অনুভূতিশীল’, তবে সর্বদাই বংশবদ। লিখছেন
তাপস সিংহ |
কারা অপরাধী, নিরপরাধ কে জানি না
আমরা কজন পোড়াকপালের সঙ্গী
পৃথিবী কত না বদলে গিয়েছে শুনছি
বদল হয়নি শেকলের মনোভঙ্গি
মল্লিকা সেনগুপ্ত
জবানবন্দি |
টেবিলের নীচের অংশ ফাঁকা। এ পার থেকে দেখা যাচ্ছে ও পারটা। কালো চামড়ার চকচকে ভারী বুট। হাফ হাতা বুশ শার্টের মালিকের চেহারাটা রীতিমতো বলশালী। টেবিলের ঠিক পাশে, মেঝেয় উবু হয়ে হাতজোড় করে বসে ক্ষীণকায় এক যুবক। টেরিলিনের জামার প্রায় সব ক’টি বোতাম খোলা। ধুলো মাখা ছেঁড়া প্যান্ট। উস্কোখুস্কো চুল। চোখ টকটকে লাল। লাল চোখ অবশ্য টেবিলের অধিকারীরও!
খবরের সন্ধানে যাওয়া সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সপাটে লাথি! ‘বল, কোথায় রেখেছিস?’ সঙ্গে গালিগালাজ। গড়িয়ে পড়ল টেবিলের পাশে রোগাটে চেহারা! ‘জানি না স্যার।’ ‘জানি না?’ আবার লাথি! তার পরেই পরিচিত সাংবাদিকের দিকে মুখ ফিরিয়ে চেক বুশ শার্ট: ‘চা খাবে? বল, কী খবর?’ গলার স্বর এক্কেবারে স্বাভাবিক! যেন এতক্ষণ কিছুই হয়নি! লালবাজারে গোয়েন্দা পুলিশের একটি শাখার ঘর। সবুজ পর্দা ঝোলানো কোণের অ্যান্টি চেম্বারে মেঝেয় বসে আর্তনাদ করতে থাকা আরও গোটা তিনেক চেহারা। চারটি টেবিলে চার জন অফিসার বসে। বাকি তিন অফিসার নিজেদের কাজে ব্যস্ত।
ছেলের মোবাইল ফোন হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা জানাতে অগ্রজ এক সাংবাদিক শহরের একটি থানায় গিয়েছিলেন। নিজের পরিচয় দেননি। দেখেন, ডিউটি অফিসারের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে একটি কিশোর। তাঁকে কয়েক জন পুলিশকর্মী মারধর করছেন। কোন অভিযোগে তাকে থানায় এনে মারধর করা হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ হল, ওই কিশোরকে মারধরের সময় সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্মীদের চোখে-মুখে অদ্ভুত এক আমোদ। ডিউটি অফিসারও চেয়ার থেকে মাঝেমধ্যে উঠে ওই কিশোরকে মেরে আবার বসে পড়ছেন। তার পরেই উল্টো দিকে বসে থাকা আগন্তুককে অত্যন্ত ভদ্র স্বরে বলছেন, ‘একটু বসুন প্লিজ।’ এক বার আগন্তুকের দিকে মজার চোখে তাকালেন অফিসার। ভাবটা, পড়ে পাওয়া মজাটা আপনিও উপভোগ করুন!
সম্প্রতি পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডে অভিযোগকারিণীর সঙ্গে পুলিশ অফিসারদের অভব্য আচরণের অভিযোগ প্রসঙ্গে পুরনো এই কথাগুলো মনে পড়ে গেল। ধর্ষিতার অভিযোগ, তিনি ও তাঁর আত্মীয়া ডাক্তারি পরীক্ষার পরে থানায় গেলে দুই পুলিশ অফিসার নিজেদের মধ্যে তাঁদের নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকেন। এক অফিসার আর এক অফিসারকে বলেন, ‘চলো, নাইট ক্লাবে গিয়ে ঠান্ডা বিয়ার খাই।’ ওই অফিসার তাতে রাজি না হওয়ায় দুই মহিলাকে শুনিয়ে প্রথম অফিসার তাঁকে বলতে থাকেন, ‘ওই জন্যই তোমার কোনও গার্লফ্রেন্ড নেই।’
আসলে, এ-ও এক ধরনের আমোদ! গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশের অনুভূতিহীন ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, পুলিশের আরও মানবিক হওয়া প্রয়োজন। এই ধরনের যে কোনও ঘটনা ঘটলেই অবশ্য এ রকমটা বলা হয়! মুশকিলটা হল, পুলিশ একই সঙ্গে প্রবল অনুভূতিসম্পন্ন আবার অনুভূতিহীন! একের মধ্যে বহু! সমাজের উঁচুতলার কেউ থানায় গেলে ব্যবহার এক রকমের (একটু বসুন প্লিজ।), আবার চেহারায়, হাবেভাবে সমাজের প্রান্তিক বা পিছিয়ে থাকা মানুষজন থানায় গেলে তাঁর সঙ্গে ব্যবহারটা অন্য রকম! আবার ‘মেয়েমানুষ’ কাছে গেলে কোনও কোনও পুলিশকর্মীর ব্যবহার আর এক রকমের হয়ে যায় বইকী!
আসলে এই যে পুলিশের ‘হৃদয়হীনতা’র কথা বলা হচ্ছে, সমাজের নানা স্তরে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, এ সব কিন্তু আজকের বিষয় নয়। আচমকাই পুলিশের একাংশ অনুভূতিহীন হয়ে পড়ল, সে নিজেকে সমাজবহির্ভূত বলে ভাবতে শিখল, ব্যাপারটা সে রকমও নয়! বস্তুত, সরকারের পরিবর্তন মানেই যে পুলিশেরও পরিবর্তন, তা-ও তো নয়! পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে বলেছেন, ‘সব আস্তে আস্তে বেরোবে। রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে ঘটনাটি সাজানো হয়েছে।’
তদন্ত শুরু হতে না হতেই খোদ মুখ্যমন্ত্রীর এই ‘বার্তা’ শোনার পরেও কি শুধু পুলিশের হৃদয়হীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়? বামপন্থীরা স্বভাবতই শোরগোল তুলেছেন। স্বাভাবিক। বিরোধী আসনে বসলে এ সব সুযোগ ছাড়লে চলে না! কিন্তু স্মৃতি কি এতই ক্ষণস্থায়ী? সকলেই সব কিছু ভুলে যান? ১৯৯০-এর ৩০ মে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বানতলায় রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ও ইউনিসেফের তিন মহিলা অফিসারের উপর এক দল দুষ্কৃতীর নির্মম হামলা ও শ্লীলতাহানির ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল অনিতা দেওয়ানের। মারা যান গাড়ির চালক অবনী নাইয়া। গুরুতর আহত হন আরও দুই অফিসার উমা ঘোষ ও রেণু ঘোষ। সেই ঘটনায় তীব্র আলোড়ন ওঠে দেশ জুড়ে। প্রবল চাপে বিচারপতি মুরারীমোহন দত্তের নেতৃত্বে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। সেই কমিশনে পেশ করা লিখিত বিবৃতিতে সিপিএমের তৎকালীন রাজ্যসভা সদস্য বিপ্লব দাশগুপ্ত ঘটনার নিন্দা করার পাশাপাশি বলেছিলেন, ‘রাজ্য সরকারকে হেয় করতে চক্রান্ত করে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে কি না, আমি আশা করি পুলিশ তা-ও তদন্ত করে দেখবে।’
আরও অনেকটা পিছিয়ে যাওয়া যাক। একটি ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৮০-র ২৪ জুলাই উত্তাল হয়ে উঠেছিল সংসদ। ইন্দিরা গাঁধী তখন প্রধানমন্ত্রী। তৎকালীন কংগ্রেস সাংসদ এ জি কুলকার্নি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুনির্দিষ্ট ভাবে জানতে চান, তাঁর মন্ত্রীরা যেখানে এই ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে চলেছেন, সেখানে পুলিশ কী করে গুরুত্ব সহকারে এই অভিযোগের তদন্ত করবে? যেমন, তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বসন্ত সাঠে রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে এই ঘটনাকে ‘নন ইস্যু’ বলেছেন। ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে হইচই করার জন্য সাঠে সংবাদমাধ্যমকেই কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। সংসদে প্রধানমন্ত্রী তখন বলেন, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে বিরোধীরা এই ঘটনা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তুলছেন।
অর্থাৎ, সরকারের ‘ভাবমূর্তি নষ্ট করতে’ চক্রান্তের অভিযোগ রাজনৈতিক পালাবদলের উপরে নির্ভর করে না! বর্ষে বর্ষে দলে দলে নেতা-নেত্রীরা তাঁদের সুবিধা অনুযায়ী পরিস্থিতিকে তাঁদের মতো করে সাজিয়ে নেন। সুবিধা অনুযায়ী পুলিশকে হিরো বানান, অথবা ভিলেন! বিরোধী পক্ষে থাকার সময়ে যে ঘটনায় উত্তাল বিক্ষোভ-প্রতিবাদ, সরকারে আসার পরে সেই সব ঘটনাকেই তাঁদের মনে হয় ‘চক্রান্ত’! সিঙ্গুরে তাপসী মালিককে ধর্ষণ করে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তোলপাড় তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! অথচ, পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় সেই মমতারই অন্য মুখ দেখতে হয় রাজ্যবাসীকে!
আসলে, মমতাকে আলাদা করে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অন্যায়! ডান-বাম কেউ এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম নন। তেমনই, পুলিশকেও আলাদা করে ‘অনুভূতিহীন’ বলার অর্থ নেই! রাজনৈতিক প্রভুদের স্পষ্ট ‘বার্তা’ পান বলেই না কলকাতা পুলিশের কর্তা সাংবাদিক সম্মেলন করে বলতে পারেন, ‘এই ঘটনা নিয়ে পুলিশ-রাজ্য সরকারকে সমালোচনা করা অনুচিত।’
প্রশ্নটা হল, রাজনীতির কারবারিদের কথা বশংবদ পুলিশ বাহিনীকে না হয় শুনতেই হবে, কিন্তু ইতিহাসের সে দায় কীসের? |