মশা মারিতে কামান? পুরানো প্রবচনের আর প্রয়োজন নাই। অতঃপর বলিতে হইবে, টোকাটুকি রুখিতে আধাসেনা। পরীক্ষার সময় আসিয়াছে, এবং পাল্লা দিয়া বঙ্গীয় নকল-শিল্প ঊর্ধ্বগামী। নব নব উন্মেষশালিনী প্রতিভার দ্বারা এই শিল্প এবং তাহার শিল্পী-গণ ক্রমে উন্নততর হইবার পথে। পরীক্ষার্থী-গণ উন্মার্গগামী, তাঁহেদের ‘মিত্র’কুলও তথৈবচ। গাছের মাথা বা দীপস্তম্ভের চূড়া হইতে শৌচাগার, সর্বত্র তাঁহারা বিরাজমান। সেই উপস্থিতি রাজদ্বার বা শ্মশানে সঙ্গদানের তুলনায় কোনও অংশে খাটো নহে। যদি পরিস্থিতি একান্তই আয়ত্তের বাহিরে যায়, অর্থাৎ প্রশাসন কঠোর হয়, টোকাটুকিতে বাধাদান করে, তখন গোলমাল পাকাইবার আয়োজনও মজুত। গণ-দাবি বলিয়া কি কিছুই নাই? (পরীক্ষায়) বাঁচিবার অধিকার সকলের ছলে, বলে কিংবা কৌশলে। সম্প্রতি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি মুক্তিনাথ চট্টোপাধ্যায় কিছু স্পর্শকাতর পরীক্ষাকেন্দ্রে আধাসেনা মোতায়েনের দাবি তুলিয়াছেন। নিতান্ত অকারণে তুলিয়াছেন বলিলে অন্যায় হইবে। সাম্প্রতিক অতীতে কিছু পরীক্ষাকেন্দ্রে উচ্ছৃঙ্খল পরীক্ষার্থী এবং তাঁহাদের সহচরদের অভব্যতা এমন পর্যায়ে গিয়াছিল যে, পরিস্থিতি গুরুতর হইয়া উঠে। সেই ঘটনা স্মরণে রাখিয়াই তাঁহার শলা, এমন কিছু পরীক্ষাকেন্দ্রে আধাসেনার বন্দোবস্ত করা হউক। সেই পরামর্শের প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু মহোদয় জানাইয়াছেন, আধাসেনা মোতায়েন করিবার দাবি নিতান্তই ব্যক্তিগত মন্তব্যের তুল্য, কারণ টোকাটুকি রুখিবার কাজ আধাসেনা দিয়া চলিতে পারে না।
পশ্চিমবঙ্গে টোকাটুকির মাত্রা গত কয়েক বৎসর ধরিয়াই যথেষ্ট বাড়িয়া গিয়াছে। এই বৎসর মাধ্যমিক পরীক্ষায় টোকাটুকির হার বিগত বৎসরের তুলনায় অন্তত চতুর্গুণ বেশি ছিল। পরীক্ষায় অসাধু উপায় অবলম্বন ঠেকাইতে পুলিশের পাশাপাশি আধাসেনা মোতায়েন এই দেশে নজিরবিহীন নহে। উত্তরপ্রদেশে টোকাটুকি এমন ব্যাপক আকার ধারণ করিয়াছে, অসাধু ব্যক্তিগণ এমনই সংগঠিত এবং শক্তিশালী যে, মাত্র কিছু পুলিশের উপস্থিতি তাঁহাদের নিরস্ত করিতে পারে না। যে পরীক্ষার্থীরা মেধার জোরে উত্তরদানে আগ্রহী, তাঁহাদের প্রস্তুতি এবং মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটে। সুতরাং, অতিরিক্ত সশস্ত্র সেনার আয়োজন।
প্রশ্ন হইল, টোকাটুকি থামাইবার জন্য ইহাই কি কার্যকর পথ? সশস্ত্র আধাসেনার উপস্থিতি কোনও পরিস্থিতি সামলাইবার কার্যত অন্তিম উপায়। আধাসেনার উপস্থিতি এক বার যদি নির্বিঘ্ন পরীক্ষার আবশ্যিক শর্ত হইয়া উঠে, তাহা হইলে বর্তমানে যে প্রশাসনটি কার্যকর, তাহা অচল হইয়া পড়িবার সম্ভাবনা প্রবল। বরং, কী রূপে এই প্রশাসন-যন্ত্রটিকেই আরও সচল করা যায়, তাহার নিরাপত্তা বিধান করা যায়, তাহা ভাবিয়া দেখা দরকার। ইহার জন্য প্রশাসনের একটি দায়িত্ব থাকিয়া যায়। একই সঙ্গে, টোকাটুকি নিছকই একটি ক্রিয়াকর্মমাত্র নহে। ইহা একটি বিশেষ মানসিকতার ফসল। সেই মানসিকতাটিকে বিশেষ কয়েকটি দিন পরীক্ষাকেন্দ্রে আধাসেনা মোতায়েন করিয়া নিয়ন্ত্রণ করা যাইবে না। এই মনোভঙ্গিটি যে অনৈতিক, সেই চারুপাঠটি শিক্ষার্থীর শৈশবকাল হইতে জাগ্রত থাকা দরকার। এবং, শুধু পরীক্ষায় টোকা নহে, জীবনের নানা ক্ষেত্রে কোনও কাজ করিবার জন্য যে অসাধু উপায় অবলম্বন করা অনুচিত, সেই বোধটি জাগরূক থাকা দরকার। তাহা থাকে না। নাগরিকগণ প্রত্যহ ছল ও বলের আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিশেষ কিছু সময়, যেমন পরীক্ষা, তাঁহাদের নীতিবোধ প্রখর হইয়া উঠে। আধাসেনা গাছ হইতে অসাধু ব্যক্তিকে নামাইয়া আনিতে পারে। মনের গভীরে ডুব দিতে পারে না। পারিবেও না। সুতরাং, নাগরিক সমাজের একটি আত্মবীক্ষণ জরুরি। |