রাজনীতি কাহাকে বলে? কাহাকে আবার কাহার দলে কত লোক, কাহার বাহুতে কত বল, তাহা দেখাইয়া দিবার নামই রাজনীতি। অন্তত এই দেশে। অন্তত এই রাজ্যে। রাজ্যের দুইটি প্রধান রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আচরণও তাহাই নির্দেশ করিতেছে। দুইটি বাহুবলি-শিবির, দুইটি হুঙ্কার-ব্যবস্থা, দুইটি মিছিলের রণক্ষেত্র। দুই-এর মরণপণ লড়াই, কাহার ভাগে কত লোক, তাহা প্রমাণ করিয়া রাজনীতি-খেলার ফলাফল নিশ্চিত করিবার ইঁদুর-দৌড়। নেতারাও রাজনীতি বলিতে ইহাই বুঝেন, নেতাদের অনুসারী মনুষ্যসাধারণও রাজনীতির নামে ইহারই আরাধনা করেন। সংখ্যার বিরুদ্ধে সংখ্যা দিয়া টক্কর, গণতন্ত্রের রাজনীতিতে তাহার অধিক আর কী চাই। পশ্চিমবঙ্গের সরকার পক্ষও জানে, বিরোধী পক্ষও জানে, গণতন্ত্রের অর্থই সংখ্যাতন্ত্র রাস্তায় সংখ্যা নামাইয়া গনিয়া লইবার তন্ত্র। যাহাতে ইহার পর আদর্শ, উদ্দেশ্য, পথ, পাথেয়, কোনও তর্কেরই আর অবকাশ না থাকে, সেই ব্যবস্থা করা। সুতরাং গত সপ্তাহ জুড়িয়া সেই এক ও অদ্বিতীয় সংখ্যাতন্ত্রের আরাধনা চলিল কলিকাতায়। প্রথমে যাদবপুরে, পরে রাজারহাটে, দেখা গেল পিঠোপিঠি মিছিলের অপর্যাপ্ত উচ্ছ্বাস, উতরোল প্রতিযোগিতা, ‘দেখাইয়া দিবার’ উত্তুঙ্গ প্রতিশ্রুতি। দুইটি স্থানেই দেখা গেল, বিরোধী পক্ষের একটি মিছিলের উত্তরে সরকার পক্ষের কোমর বাঁধিয়া দুই-দুইটি মিছিলের ব্যবস্থা। ফলো-আপ কিংবা ফলো-অন, যে নামেই তাহাকে ভূষিত করা হউক না কেন, যুক্তিটি প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত সহজ। সরকারি ক্ষমতার প্রদর্শন বলিয়া কথা! ক্ষমতার অর্থ কী, তাহা যদি মিছিল বানাইবার জন্যই সর্বশক্তিতে ব্যবহৃত না হয়?
নিন্দুক অবশ্য প্রশ্ন তুলিতেই পারেন, বিরোধীরা সরকারি অপশাসনের ধুয়া তুলিবেই, তাই তাহাদের মিছিলের যুক্তিটি যদি-বা তর্কের খাতিরে মানিয়া লওয়া যায়, সরকারি মিছিলের উদ্দেশ্য কিংবা বিধেয়টি ঠিক কী? সরকার তো নিজেই প্রশাসন, তাহা হইলে প্রশাসন স্তব্ধ করিয়া মানুষের ঢল নামাইয়া সরকার পক্ষ কী প্রমাণ করিতে চাহে? নিজের বিরুদ্ধে তো নিজের ক্ষোভ থাকিবার কথা নহে? আবার ‘বিরোধীরা করিয়াছে তাই আমরাও করিব’, এ হেন বালখিল্যপনাও শোভনীয় নহে। বাস্তব হইল, শোভনীয় না হইলেও লোভনীয় অবশ্যই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বৃহত্তর সংখ্যার ব্যবস্থা করিতে ছুটিয়াছেন, কোনও ফাঁক রাখেন নাই, অকাতরে মানুষ আমদানি হইয়াছে চতুর্দিক হইতে। তবে তৃণমূল সরকার তো একাই নহে, পূর্বতন বামফ্রণ্ট সরকারও কয়েক বৎসর আগে ঐতিহাসিক সিঙ্গুর মিছিলের পর দিনই নিজেদের পাল্টা মিছিল নামাইয়া টক্কর দিবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছিল। সুতরাং সংখ্যার এই কু-রাজনীতির নিন্দা যদি করিতেই হয়, তবে বলিতেই হইবে, ইহা ‘আমাদের’ ইহা ‘উহাদের’ পাপ! অর্থাৎ, এই পাপের আমরা-ওরা নাই।
স্বাধীনতার আগে উনিশশো ত্রিশের দশকে ব্রিটিশ ভারতে যখন প্রথম প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির চর্চা হইতেছিল, সেই সময় কেহ কেহ প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, এই ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ বা প্রতিনিধিত্বের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত ‘এনুমারেশন’ বা গণন-তান্ত্রিক রাজনীতিতে পর্যবসিত হইবে না তো? তাহার পর আট দশক অতিক্রান্ত। প্রশ্নের আর অবকাশ নাই। উত্তর মিলিয়াছে। গণতন্ত্র ছাড়িয়া গণন-তন্ত্র, লক্ষ্য ছাড়িয়া সংখ্যা, পথ ছাড়িয়া রাস্তাই আমরা বাছিয়া লইয়াছি। আর ২০১১-উত্তর ‘পরিবর্তন’-এর পশ্চিমবঙ্গ সেই ঐতিহ্য সসম্মানে বহিয়া চলিয়াছে। সরকার বিলক্ষণ জানে বই কী, কোথায় ‘পরিবর্তন’-এর ধুয়া ‘সংখ্যা’র পক্ষে যাইবে, কোথায় অপরিবর্তনের ধ্বজার মাধ্যমেই ‘সংখ্যা’কে নিশ্চিত করা সম্ভব হইবে। |