তাঁবুতে ঢুকে যে-কাঠের বেঞ্চিতে এসে আড্ডা দিতে বসতেন অজাতশত্রু মানুষটি, সেখান থেকেই উঠল প্রতিবাদের ঝড়টা!
প্রয়াত শৈলেন মান্নার দু’বছরের ছোট ভাই ধীরেন মান্না দাদার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বলছিলেন, “খুব দুঃখের কথা, দাদাকে এখানে আনা হয়নি। অন্যায়, খুব অন্যায় হয়েছে। আমি ওখানে উপস্থিত থাকলে এখানে নিয়ে আসতামই। মোহনবাগান আর দাদা তো ছিলেন সমার্থক।”
কিংবদন্তি ফুটবলারের শেষ ইচ্ছা হিসাবে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাওড়ার বাড়িতে। যেখানে ছোট থেকে মহীরুহ হয়েছিলেন শৈলেন মান্না। ভূমিপুত্রের ভূমি থেকেই যখন ‘ক্ষোভ’টা উথলে উঠেছে, প্রতিবাদের হাততালির ঝড়টাও তখনই উঠল। স্মরণসভায় হাততালি! পিছন দিকে তাকিয়ে দেখা গেল, ওই বেঞ্চিতে বসে আছেন যাঁরা, তাঁদের বয়স ‘মান্নাবাবুর’ আশেপাশেই। সেই পাকা চুলের ভিড়ে অনেকেই ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে বহু দিন ও সন্ধ্যা কেটেছে সাড়ে সাতাশি বছরে প্রয়াত মানুষটির।
আজীবন অবিতর্কিত মানুষটির মৃত্যুর চার দিন পরেও তাঁর ভাইয়ের করা মন্তব্য নতুন এক বিতর্কের জন্ম দিল নিঃসন্দেহে। শৈলেন মান্নার মৃতদেহ ক্লাবে আসা নিয়ে স্ত্রী-মেয়ে বনাম হাওড়ায় বেড়ে-ওঠা ভিটের লোকজনদের মতের ফারাক তৈরি করে দিল নতুন কিছু প্রশ্নেরও। রবীন্দ্রগান আর স্মৃতিচারণে সাজানো, মনে রাখার মতো স্মরণসভা থেকে মোহনবাগান কর্তারা এই প্রশ্নই কি তুলে দিতে চাইছিলেন? ঘণ্টা তিনেকের সভার শেষের অনুরণন সেটা নিশ্চিত করলেও, কর্তারা কিন্তু মুখ খোলেননি। একেবারে শেষ বক্তা হিসাবে মঞ্চে এসে ক্লাব সচিব অঞ্জন মিত্রই শুধু বলে দিলেন, “মান্নাদার মরদেহ মোহনবাগানে আসেনি। আমরা খুবই দুঃখ পেয়েছি।” |
গত সোমবার প্রয়াত শৈলেন মান্নার মরদেহটা যেখানে এনে রাখার কথা ছিল, শুরু হয়েছিল ম্যারাপ বাঁধাসেখানেই সাজিয়ে রাখা হয়েছিল মোহনবাগান-অন্ত-প্রাণ মানুষটির প্রতিকৃতি। দু’টি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল স্মরণের জন্য। একটিতে বাছাই করা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছিলেন পুবালী দেবনাথ। অন্যটায় চলছিল স্মৃতিচারণ। আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও শৈলেন মান্নার স্ত্রী বা মেয়ে কেউই আসেননি। আসবেন না, এটা আঁচ করেই স্মরণসভাকে অন্য মাত্রা দিতে চেয়েছিলেন টুটু বসু-দেবাশিস দত্তরা। হাওড়া থেকে তাঁর ভাইকে হাজির করানোর পাশাপাশি বেঁচে থাকা সব প্রজন্মের ফুটবলারদের হাজির করেছিলেন তাঁরা। শৈলেন মান্নার মতোই ক্লাবের নামের সঙ্গে সমার্থক হয়ে যাওয়া চার ফুটবলার চুনী গোস্বামী, সুব্রত ভট্টাচার্য, সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং হোসে রামিরেজ ব্যারেটো এসেছিলেন। বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, জহর দাস, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ও এসেছিলেন। সেই অর্থে ময়দানে বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এক সময়ের তারকা সনৎ শেঠ, কেষ্ট দত্ত, পদ্ম মিত্র, নিমাই গোস্বামী, বলাই দে, প্রশান্ত সরখেল, মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক চট্টোপাধ্যায়, পুঙ্গব কান্ননও যোগ দিয়েছিলেন স্মৃতিচারণায়। একেবারে পিছন দিকে এসে বসেছিলেন লাল-হলুদের ‘ঘরের ছেলে’ মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তরুণ বসু, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়রাও। এসেছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র এবং আই এফ এ সচিব উৎপল গঙ্গোপাধ্যায়।
পুবালী গান শুরু করেছিলেন, ‘আলোকেরই ঝরনাধারায়’ দিয়েস্মৃতিচারণে সেই মান্না-আলোই ছড়িয়ে পড়ল ‘ঝরনা’ হয়ে। উন্মোচিত হল কত দিক। কত অকথিত কাহিনি যে স্মৃতিমেদুরতা থেকে বেরিয়ে এল! ‘মোহনবাগানের মান্নাদা’ পশু শিকার করতেন! সিঙ্গাপুরে স্বামীজিদের অনুরোধে ফুলপ্যান্ট গুটিয়ে খালিপায়ে মাঝমাঠ থেকে ফ্রি-কিকে গোল করেছিলেন! নিজের বাড়িতে রেখে ক্লাবের জন্য ফুটবলার তৈরি করতেন! হেরে যাওয়ার পর সদস্য-সমর্থকদের ইটের সামনে তাঁকেই এগিয়ে দিতেন সুব্রত-প্রসূনরাও! জাতীয় ক্লাবে মোহনবাগানে প্রথম বিদেশি হিসাবে চিমাকে নেওয়ার সময় তীব্র বিতর্কের মধ্যেও সমর্থন করেছিলেন তখনকার কর্তাদের! মোহনবাগান টিডি সুব্রত এবং অধিনায়ক ব্যারেটো যা শুনে দাবি জানালেন, একটা বই প্রকাশ করা হোক কিংবদন্তিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। যাতে ধরে রাখা যাবে মানুষ ও ফুটবলার শৈলেন মান্নাকে। ক্লাব সচিব অঞ্জন মিত্র জানিয়ে দিলেন, দুর্গাপুরে তাঁদের অ্যাকাডেমির জিমন্যাসিয়ামের নাম রাখা হবে মান্নাদার নামে। গ্যালারির একটি ব্লকও হবে শৈলেন মান্নার নামাঙ্কিত। অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত প্রস্তাব দিলেন, “শৈলেন মান্নাকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়ার দাবি জানিয়ে ফেডারেশনকে চিঠি দিক মোহনবাগান।”
দুপুরের রোদে শুরু হয়েছিল স্মরণ। বিকেল গড়িয়ে মেঘে-ঢাকা সন্ধ্যাতেও ক্লাব তাঁবুর লনে থিকথিকে ভিড়। চমকপ্রদ স্মৃতিচারণ আর নতুন বিতর্কে প্রয়াত শৈলেন মান্না শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রিয়তম ক্লাবের প্রেক্ষিতে কোথায় গিয়ে দাঁড়ালেন? দেবব্রত বিশ্বাসের ঢঙে সনৎ শেঠের গাওয়া গানটাই মনে হয় তাঁর একমাত্র উত্তর হতে পারে‘গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা’! |