প্রশ্ন: ধীরেন মান্না নিজের ছোট ভাই আজ মোহনবাগান তাঁবুতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তিনি খুব হতাশ। মরদেহ যে মোহনবাগান তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হয়নি, সেটা খুব অন্যায় হয়েছে।
নীলাঞ্জনা মান্না (মেয়ে): এটা ওঁর ব্যক্তিগত মত। কাকা বাবাকে মৃত্যুশয্যায় দেখতেও এসেছিলেন। কিন্তু উনি তো আলাদা থাকেন। শেষ চার মাস বাবার দুঃখ কষ্টে শরিক ছিলেন না। বাবার মানসিক যন্ত্রণা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল সেটা উনি জানেন না।
আভা মান্না (স্ত্রী): দেবতুল্য লোকটা চলে গিয়েছে। ভাগ্যিস দেখে যাচ্ছে না সারা জীবন সে বিতর্ক থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিল। আর মারা যাওয়ার পর তাকে নিয়ে না কী পরিমাণ বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। তার পরিবার নিয়ে এই শোকের মধ্যেও কাটাছেঁড়া চলছে। এই সব দেখে আমি তো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। বন্ধ হোক এই বিতর্ক।
মেয়ে: মোহনবাগান সমর্থকদের কাছে আবার দুঃখপ্রকাশ করছি। মোহনবাগান মাঠ হল পুণ্যভূমি। বাবার বরাবরের তীর্থক্ষেত্র। কিন্তু লক্ষ লক্ষ সভ্য-সমর্থক তো ভিতরের সব ঘটনা জানেন না। জানলে বুঝতেন বাবার সেন্টিমেন্ট আমরা রক্ষা করারই চেষ্টা করেছি মাত্র।
স্ত্রী: ওর প্রথম সংসার তো মোহনবাগানই ছিল। দ্বিতীয় সংসার ওর বাড়ি। সেই লোকটার পরিবার নিয়ে কী সব কথা বলা হচ্ছে। কেউ ভাবছেও না আমাদের এখন শোকের সময়। কান্নার সুযোগ পাচ্ছি না। এমন অন্যায় আক্রমণ সব ধেয়ে আসছে। বন্ধ হোক এ সব। সকলের কাছে আবেদন করি।
প্র: আপামর মান্না অনুরাগীরা একটা প্রশ্ন করছেন। ধরে নেওয়া যাক মোহনবাগানের দু’ বা তিন জন লোক অসহ্য। তাতে মোহনবাগান প্রতিষ্ঠানটা খারাপ হয়ে গেল কী করে? লক্ষ লক্ষ সমর্থকের সেন্টিমেন্ট অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল কী করে? তাঁদের সেন্টিমেন্টের কি কোনও দাম নেই?
মেয়ে: আমি একটা কথা বলি। ওদের সেন্টিমেন্ট বুঝে তো আমি আর মা দুঃখ প্রকাশ করেছি। কিন্তু আমাদের সম্মান আর ফিলিংসটাও মানুষ বুঝুক। বুঝুক শেষের দিকে শৈলেন মান্নার মানসিক যন্ত্রণাটা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
প্র: আনন্দবাজারে তুলসীদাস বলরাম প্রশ্ন তুলেছেন মারা যাওয়ার আগে মান্নাই কি বলে গিয়েছিলেন আমার শবদেহ মোহনবাগান ক্লাবে নিয়ে যেও না?
মেয়ে: বাবা ওই রকম মানুষই ছিলেন না যে ক্যাটক্যাট করে একটা বিতর্কিত কথা বলে দেবেন। বাবা কথা বলতেন খুব অল্প। তা থেকে বুঝে নিতে হত। উনি বলেছিলেন আমার সংস্কার করানোর আগে আমাকে হাওড়ার ভিটেতে নিয়ে যাস। তার মানেটা কী? কেউ যদি বলে আমায় ভাত খেতে দেবেন, তার মানে নিশ্চয়ই তিনি রুটি খেতে চাইছেন না।
স্ত্রী: আমি মরদেহ টানা একটা জায়গা থেকে আর একটা জায়গা হপিং করাতে চাইনি। জীবনের শেষ দিকে অনেক ছোট ক্লাব। ভেটারেন্স ক্লাব। বেহালার কিছু ছেলে। জিওলজিক্যাল সার্ভেও তো ওঁর পাশে ছিল। তাদের ওখানেও তো পাঠাইনি। |
প্র: তারা আর মোহনবাগান ক্লাব কি এক হল? শৈলেন মান্না আর মোহনবাগান তো সমার্থক।
মেয়ে: শেষের দিকটা বাবা কিন্তু মোহনবাগান নামটা আর তোলেনইনি। প্রচন্ড মানসিক দুঃখে খালি ভারতের কথা বলতেন। অলিম্পিকে রানির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। হেলসিঙ্কিতে কী করেছিলেন সে সব বলতেন।
প্র: এটা কি ক্লাব কর্তাদের অবহেলায় হয়েছিল বলে মনে হয়?
স্ত্রী: ওর দুঃখ একটা হয়েছিল সত্যি কথা। সারা জীবন যে লোকটা ভালবাসা বিলিয়ে গেল তার শেষ চার মাস ক্লাব থেকে পেল শুধু অবহেলা। অনেক মানুষ আমাদের পাশে ছিলেন। আলাদা করে আমি প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্যামল সেনের কথা বলব। উনি বটগাছের মতো আমাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। অথচ যে ক্লাবকে ও এত ভালবেসে ছিল সেখান থেকে কেউ খোঁজও নেয়নি।
মেয়ে: মরদেহ না নিয়ে যাওয়া নিয়ে এত কথা হচ্ছে। অথচ বডি যখন আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল তার অনেক পরেও এক মোহনবাগান কর্তা নীচে দাঁড়িয়ে টিভি-তে বাইট দিচ্ছিলেন। এই তো সব ভালবাসা। এই তো মনুষ্যত্ব।
প্র: কিন্তু আপনারাও তো লাল-হলুদ পতাকায় মুড়ে মরদেহ বার করেছিলেন। মোহনবাগানিদের সেন্টিমেন্ট এতে ধাক্কা খেতেই পারে।
মেয়ে: আমরা কিছুই করিনি। করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। আমি আর মা ওপরেই ছিলাম। ইস্টবেঙ্গল এসে অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ভাবে শরীরের উপর পতাকা দিয়ে যায়। মোহনবাগান চাইলে তো সবুজ-মেরুন ঝান্ডা উপরে দিয়েই যেতে পারত। অঞ্জন মিত্র তো এখানে ছিলেন সকাল আটটা থেকে। কে বারণ করেছিল দিতে? সত্যিই তো দেওয়া উচিত ছিল মোহনবাগান পতাকা।
প্র: মোহনবাগান তো অতীতে মান্নার জন্য করেছে। পুরস্কার দিয়েছে। ড্রেসিংরুম নামাঙ্কিত করেছে তাঁর নামে। ক্লাবকর্তারা কিছুই করেননি কেন বলছেন?
স্ত্রী: ড্রেসিংরুম দিয়ে কী হবে? মানুষটার দরকার ছিল ভালবাসা। সেটা শেষ সময় ক্লাব থেকে পেল কোথায়?
মেয়ে: শেষ কয়েক মাস মাঝে মধ্যে খোঁজও নিতেন, হ্যাঁ রে ক্লাব থেকে অমুক এসছিল, তমুক ফোন করেছিল? যাদের কথা বলতেন, তারা কেউ যোগাযোগ করেনি। মনে হয় সে কারণে একটা নিরুচ্চার অনীহা তৈরি হয়ে গিয়েছিল ওঁর এই প্রতিষ্ঠান চালকদের সম্পর্কে।
স্ত্রী: মানুষটা তো নিঃসঙ্গই মারা গেল বলতে গেলে। চোখ খুলে শুধু দেখত মেয়ে আর স্ত্রী। নার্স আর আয়া। আর গুটি কয়েক শুভানুধ্যায়ী যারা সব সময় সঙ্গে ছিল।
প্র: মোহনবাগান সম্পর্কে নিরুচ্চার অনীহা কি শেষ চার মাসেই তৈরি হয়েছিল? না কি আগেও ধিকিধিকি জ্বলছিল?
মেয়ে: অবহেলাটা অনেক দিন শুরু হয়েছিল। বাবার দুঃখটাও। শেষ ক’মাসে সেই দুঃখটা ক্ষত হয়ে যায়। মোহনবাগান সমর্থকেরা কী করে জানবেন শেষ ক’মাস কী দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা যে ওঁর সঙ্গী ছিল। সেটা আমি আর মা-ই জানি। |
প্র: প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, সে দিন অত বিতর্কের মধ্যেও মরদেহ তাঁবুতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি আপনার মা দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বেঁকে বসেন আপনি। মোহনবাগান শীর্ষকর্তাদের তাই বক্তব্য, নীলাঞ্জনার আপত্তিতে সমর্থকেরা বঞ্চিত হয়েছেন।
স্ত্রী: ওই অসহায় অবস্থার মধ্যে কে কী বলছে আমার মাথাতেই আসেনি। আমার মাথা কাজও করছিল না। চার দিক থেকে চাপ আসছিল। রাজি-অরাজির মধ্যে আমি ছিলাম না।
মেয়ে: কেউ যদি আমায় গালাগাল দিয়ে সুখ পান আমার কোনও বক্তব্য নেই। কিন্তু এক দিন না এক দিন সত্যিটা সবাই জানবেন। অলরেডি অনেকেই জানেন।
স্ত্রী: আমার সবচেয়ে খারাপ লাগছে এ রকম একটা শোকের সময় যখন মানুষে বলে, মনে কিছু থাকলেও সেটা চেপে রাখতে হয়। প্রকাশ্যে বলতে নেই। আমরা এ ধরনের সভ্যতা বা রুচির মধ্যে বড়ও হইনি যে সদ্য মৃতের পরিবারকে অসম্মান করে খোলা বাজারে কথাবার্তা বলব। মিডিয়ায় মুখ খুলব। আমার মেয়েকে কিছু বলা মানে তো আমাকেই আক্রমণ করা। কাগজে নিত্যদিন এ সব দেখে দেখে আমি তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছি। যে মানুষটা মাঠের জন্য এত দিল এটা কি তার পরিবারের প্রাপ্য ছিল?
প্র: চুনী গোস্বামী লিখেছেন তাঁর মতে মরদেহ অবশ্যই তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
মেয়ে: এটা ওঁর ব্যক্তিগত মত। আমাদের কিছু বলার নেই।
স্ত্রী: চুনী কিন্তু খোঁজখবর নিয়েছে। আমাকে ফোনটোন করত।
প্র: খুব সরাসরি জিজ্ঞেস করছি গত ৯৬ ঘণ্টায় এত সব তুলকালামের পর এখন কি অনুশোচনা হচ্ছে যে দু’-তিন জনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত না নিলেই হত?
মেয়ে: কোনও অনুশোচনা হচ্ছে না। মোহনবাগানের সমর্থক এবং কার্যকরী কমিটির কিছু সদস্যের কাছে আমরা গভীর কৃতজ্ঞ। আর ক্ষমাপ্রার্থীও।
কিন্তু কোনও অনুশোচনা নেই। মোহনবাগান ক্লাব যাঁরা চালান, অন্তিম যাত্রায় তাঁদের কারও কারও সান্নিধ্য পেতে বাবা নিশ্চয়ই আগ্রহী হতেন না।
স্ত্রী: আমি চাই এই ব্যাপারটার এখন নিষ্পত্তি ঘটাতে। দু’ তরফেই ভুল হয়ে থাকতে পারে। বাড়াবাড়ি হতে পারে। এগুলো এ বার থামুক। দু’পক্ষ মিলে আনুষ্ঠানিক শেষ শ্রদ্ধা জানালে আমার কোনও আপত্তি নেই।
প্র: তা হলে তো আপনারা আজ মোহনবাগান ক্লাবে গেলেই পারতেন?
স্ত্রী: বললাম তো শরীর অসুস্থ। এ ছাড়া কারও নিজের জায়গায় দরকার নেই, বরং একটা কমন জায়গায় হোক সেই অনুষ্ঠান।
প্র: কমন জায়গা বলতে কোথায়?
স্ত্রী: ইন্ডোর স্টেডিয়াম হতে পারে। যুবভারতী হতে পারে। যুবভারতী তো ফুটবলেরই জায়গা। হোক না সেখানে। মোহনবাগান কর্তারা আসুন। আমরাও যাব। |