প্রবন্ধ...
৭৪ নট আউট
ত বছরের অগস্ট মাসের মাঝামাঝি ম্যানচেস্টার শহরে হাজির হয়েছিলাম একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। এই সম্মেলনের মুখ্য বিষয়বস্তু হল, লর্ড রাদারফোর্ডের বিশ্ববিখ্যাত আবিষ্কার একশো বছর আগে ৭/৮ মে, ১৯১১ সালে। অ্যাটমের কেন্দ্রে নিউক্লিয়াস। এই আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক জগতের তথা মানবসভ্যতায় আমূল পরিবর্তনের জোয়ার আনে। লর্ড রাদারফোর্ড বোধহয় ঠাট্টা করেই বলেছিলেন যে, এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাটি এমনই যে, ‘আপনারা যদি একটি ব্লটিং কাগজে গুলি ছোড়েন, তা হলে সেই গুলিটি ব্লটিং কাগজে ধাক্কা খেয়ে আপনার কাছেই ফিরে আসবে’। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সম্মেলনে খুব একটা উত্তেজনা ছিল না।
এক দিন রবিবার বিকেলে শান্ত, স্নিগ্ধ, সুদূর গ্রামাঞ্চলে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। ইংল্যান্ডের স্বচ্ছন্দ গ্রীষ্মের দিন। সূর্য ঝকমক করছে। একেবারেই গরম নেই। ঝিরঝিরে হাওয়া, ফুলে ফুলে গোটা গ্রামাঞ্চল বসন্তের সাজে সেজে উঠেছে যেন, ‘অকূল শান্তি যেথায়, বিপুল বিরতি’ মনোভাব।
হঠাৎ দেখি, সাদা প্যান্টশার্ট পরা খেলোয়াড়রা। পড়ন্ত বেলায় এক দিনের ক্রিকেট খেলা চলছে। যদিও এক দিনের খেলা, কিন্তু সাজে তারা সেকেলে। সবই সাদা। ভাল একটা ড্রাইভ মারলে নম্র হাততালির ধ্বনি।
খরগোশ তার দোসরকে নিয়ে থপথপ করে মাঠে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছে, কোন দিকে যাবে, কেন যাবে, তাদের খেয়াল নেই, কিন্তু কান তাদের খাড়া, চোখগুলো চঞ্চল, সোনালি সূর্যের আলোয় ধোয়া গাছে ঘুঘু পাখি ডাকছে। অসীম কাতর তার কণ্ঠ। মন উদাস করা সেই ডাক। পাখিদের সর্বজনীন কিচিরমিচির। ওই ক্রিকেটের নেপথ্যে মেজাজি অর্কেস্ট্রা। আমি গুটিগুটি খেলার দিকে এগিয়ে গেলাম। যদিও আমার প্যান্ট একেবারে ধবধবে সাদা বলা যেতে পারে না। যারা ফিল্ড করছিল, তাদের ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করলেন, সে কালের ভদ্রতার সঙ্গে যে, আমি ভারতীয় কি না, আর ক্রিকেট ভালবাসি কি না। ‘অবশ্যই, অবশ্যই’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে অতিথি আম্পায়ার হতে অনুরোধ করলেন। আমি মহা আনন্দের সঙ্গে আম্পায়ারিতে লেগে পড়লাম। প্যাভিলিয়ন ছবির মতো। ঘন সবুজ ঘাসের মাঠ। উইলো গাছগুলি মাথা নাড়িয়ে ঝিরঝিরে বাতাসে মনমাতালে মেতে উঠেছে। কিছুক্ষণ পরেই প্যাভিলিয়নে গিয়ে দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। প্রায় সাড়ে সাতটা, সাঁঝবেলা খেলা শেষ হল। সূর্যদেব মেঘের কোণে ঢলেছেন। মেঘগুলি ভেলার মতো কোন দিকে যাবে ভেবে উঠতে পারছে না। যেন স্মৃতিচ্যুত হয়েছে।
সাদা পোশাক পরা খেলোয়াড়রা খুব নম্র ভাবে অনুরোধ করলেন চা খেতে। আমি কিন্তু অত্যন্ত ভদ্র ভাবেই বললাম, ‘আজ নয়, ক্ষমা করবেন।’
কারণটা কিন্তু নেহাতই সেন্টিমেন্টাল। অতীতের আনন্দস্মৃতির এক গভীর অনুভূতি আমার মাথায় চেপে বসেছে তখন। সাল ১৯৬৫, অন্য রকমের গ্রামীণ ক্রিকেট খেলা চলছে। কেমব্রিজের Christ’s কলেজের খেলার মাঠে, কেমব্রিজের একটু বাইরে।
আমি কলেজের দলে খেলছি। তিন নম্বরে নামি। আমরা খেলছি কিংস কলেজের সঙ্গে। কিংসের সুখ্যাতি ছিল বায়রনিক ফুলবাবুতে ভর্তি। আর খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা বিদ্রোহী কমিউনিস্ট, তাদের বুদ্ধি। ই এম ফর্স্টার একটু কুঁজো হয়েছেন তখন, কলেজের মধ্যে খুব ধীরে হাঁটতে ভালবাসেন। প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সেই সময়, বলে রাখা উচিত, কমিউনিজম আমাকেও আক্রান্ত করেছিল। কিংস আমাদের আগে ভালই স্কোর করেছে।
আমার সাদা ফ্লানেল ছিল না। উত্তর কলকাতার সাদা টাইট প্যান্ট, কষ্টকর, গার্ড পরে। সাদা শার্ট আস্তিন গোটানো, কিন্তু মাথায় ঝকঝকে কলেজ হ্যাট। আবহটা ঠিক গ্রাম্য ম্যানচেস্টারের মতোই। ঝিরঝিরে হাওয়া। বাউন্ডারির বাইরে গভীর নীল আকাশের নীচে নিবিড় সবুজের ছড়াছড়ি। গাছগুলি বাতাসের দোলায় মৃদু হাসিতে মশগুল।
প্রথম ব্যাটসম্যান নেমেই আউট। বাবু ছক্কা মারতে গিয়েছিল। তার বালিকা বন্ধুকে ইমপ্রেস করবে, এই তার লক্ষ্য। সোজা ললিপপ। আমার ডাক পড়ল। বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটি অসম্ভব লাফালাফি শুরু করেছে। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের ইতিহাসে অক্সব্রিজে এক জন ছিলেন মহানায়ক, নবাব অব পটৌডি। আর তারও অনেক আগে মহারাজা রণজিৎ সিংহ। আমি কে? কেউ না। ধড়ফড়ানি চূড়ান্তে।
এমনই ভয়ঙ্কর ভাগ্য, যে বল করছিল কিংস তরফে, সে ফুলবাবু একেবারেই নয়। ইন্টেলেকচুয়াল তো নয়ই। ছ’ফুট তিন ইঞ্চির এক বিরাটকায় দামড়া।
প্রথম বলটাই প্রচণ্ড গতিতে। অফ সুইং। কিন্তু উইকেটের একটু বাইরে। ভারতীয়কে ভয় দেখাবে, দামড়ার এ রকম এক ভাব। আমি ব্যাটে একটু আঘাত করতেই সোজা চার। জোর গতির বল একটু টাচ করলেই চলে যাবে বাউন্ডারিতে। আমার কলেজের বন্ধুরা ভালই হাততালি মারছে তখন। তার পর থেকেই চোখ এঁটে গেল। যা বল আসছে ধড়াম ধড়াম পেটান খাচ্ছে আমার ব্যাটে। তৃতীয় বল পিচের মধ্যখানে। সোজা ছয়। আবার বল এল, মুস্তাক আহমেদের মতো পিচ থেকে এগিয়ে পেটাই। চার।
এই কর্ম করতে করতে খেলা শেষ হল সেই সন্ধে সাড়ে সাতটায়। নট আউট, যত দূর মনে পড়ে ৭৪ রানে। খেলা ড্র হল। গোধূলির ম্লান সূর্য পশ্চিম দিগন্তে মেঘের আড়ালে। পাখিগুলির অন্তিম অর্কেস্ট্রা দিনের শেষ ঘোষণা করল।
আমরা প্যাভিলিয়নে ফিরে যাচ্ছি। হঠাৎ এক বিচিত্র ঘটনা। এগারো এগারো বাইশ জন খেলোয়াড়। দু’জন আম্পায়ার। সবসুদ্ধ চব্বিশ জন। ব্যাট হাতে করে এগোচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে লক্ষ করলাম, এই তেইশ জনের জনগণ আস্তে আস্তে হাঁটছেন, আমি সামনে। তেইশ জন বেশ কিছুটা পিছনে।
প্যাভিলিয়নের কাছে পৌঁছতেই বিরাট উল্লাস। হাততালির ঝড়। আমি সামনে, হাততালি পড়েই চলেছে। সে কালের কেমব্রিজ। ম্যান অব দ্য ম্যাচের সম্মান এই ভাবেই দেওয়া হত। নম্র, সভ্য, সংযত, কিন্তু মহা আনন্দ। সেই সন্ধ্যায় আমিও নবাব হলাম কেমব্রিজের।
চট করে চান করে (সবাই লাইন করে, বলা বাহুল্য, অনাবৃত অবস্থায় অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল) যখন বসা হল, যিনি আমাদের কলেজের প্যাভিলিয়নের দেখাশোনা করেন, স্বামী-স্ত্রী খুবই ভদ্র ভাবে একটু দুষ্টুমির সুরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত ভাল খেললে, নিশ্চয়ই খুবই তৃষ্ণার্ত’। আমি ‘অবশ্যই’ বলার পরে শ্যান্ডি পরিবেশন করা হল। বিয়ার আর লেমনেড মেশানো। আর তার সঙ্গে সুন্দর গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়ির বানানো স্যান্ডউইচ। চা দেওয়ার কোনও রীতি ছিল না।
ধীরে ধীরে পাখিরা অনেক কিচিরমিচির করে তাদের বাসায় গেলে গভীর নিস্তব্ধতা। ওই সীমার পিছনে গাছের উপরে সূর্য তখন অস্তাচলে। কেমব্রিজের মরা বসন্তের গোধূলি সন্ধেতে গেল মিলিয়ে। একরাশ গাছের পাতা বিমর্ষতার সুরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল, শ্যান্ডি মাথায় চড়ার আগেই। আমরা আমাদের সাইকেল করে কলেজে ফিরে গেলাম। আর এক প্রিয় বন্ধু একটি ছবি নিয়েছিল, উত্তর কলকাতার প্যান্টুলুন আর আস্তিন গুটানো সাদা ফুল শার্ট।
সেই ছবিটি দেখে বড় আনন্দ পাই। যৌবনের হাতছানি।
পঁয়তাল্লিশ বছর পরে ম্যানচেস্টারে সেই জন্যই বলা, ‘আজকে চা নয়, ক্ষমা করবেন।’ মধুর স্মৃতির চরম আনন্দ, মহা আনন্দ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.