লেমিং বলিয়া ইঁদুর-জাতীয় একটি প্রাণী লোকসমাজে বিখ্যাত হইয়াছে ‘সমবেত আত্মহত্যা’র প্রবণতার জন্য। জলপ্রপাত কিংবা নদীর খাতে একযোগে এক দল লেমিংকে ঝাঁপ দিতে দেখিয়া সকলের ধারণা জন্মিয়াছিল, ইহারা মরিবার উদ্দেশ্যেই যাত্রা করিয়াছে। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা বলিয়াছেন, ইহা আত্মহত্যা নহে, দুর্ঘটনা। কোনও বৎসর বসন্ত দীর্ঘস্থায়ী হইলে লেমিংদের সংখ্যা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তাহারা পুরাতন স্থান ছাড়িয়া কোনও পার্বত্য জলা জমির উদ্দেশে বাহির হয়। কিন্তু পথে খরস্রোতা নদীর ঢাল কিংবা জলপ্রপাত পড়িলে আতঙ্কে দিশাহারা হইয়া ঝাঁপ দিয়া পড়ে। হিউমান জিনোম প্রজেক্ট বিশেষ ভাবে অনুসন্ধান করিতে পারে, বাঙালিদের সহিত লেমিংদের কতখানি জিনগত সাদৃশ্য রহিয়াছে। মোবাইল ফোন কানে ধরিয়া গাড়ি চালাইবার অভ্যাসটি লেমিং-সূত্রে প্রাপ্ত কোনও জিনেরই বহিঃপ্রকাশ বলিয়াই কি মনে হয় না? সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার মোটর ভেহিকলস আইন সংশোধন করিয়া মোবাইল-কানে গাড়ি চালনাকে দণ্ডনীয় করিয়াছে, তৎসহ পথ নিরাপত্তার অন্যান্য বিধিগুলি লঙ্ঘন করিবার শাস্তিস্বরূপ কারাবাসের মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণও বাড়াইয়াছে। ইহার ফলে পথ দুর্ঘটনা কমিবে কি না, তাহা অন্য প্রশ্ন। আশ্চর্য ইহাই যে, নাগরিকরা স্বেচ্ছায় এমন কাজ করিতেছেন যাহাতে তাঁহাদের মৃত্যুও হইতে পারে, এবং রাষ্ট্র তাহাকে শাস্তির ভয় দেখাইয়া ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ হইতে বিরত করিতেছে। বিশেষত এই রাজ্যে এমন প্রবণতা যত্রতত্র এবং অহোরাত্র সুলভ। প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকও রাষ্ট্রের ভ্রুকুটি না থাকিলে বিদ্যালয়ের দুষ্ট বালকের মতো আচরণ করিবেন, ইহাই কি ধরিয়া লইতে হইবে? না কি, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা আছে জানিয়াও সে কাজে ঝাঁপাইয়া পড়া লেমিং-এর মতো বাঙালিরও স্বাভাবিক প্রবণতা?
অর্থনীতিবিদ এবং নীতিপ্রণেতারা মনুষ্যপ্রকৃতি লইয়া বড়ই চিন্তিত। মানুষ যদি নিজের ভাল বুঝিত, তাহা হইলে চপ-কাটলেট পরিহার করিত, শুইবার পূর্বে মশারি টাঙাইত এবং গাড়িতে উঠিয়াই সিটবেল্ট বাঁধিত। বাস্তবে এমন কাণ্ডজ্ঞান যে সুলভ নহে, তাহা বলাই বাহুল্য। এমনও নহে যে ইহার ফলে কী ক্ষতি হইতে পারে, তাহা সকলের নিকট স্পষ্ট নহে। ম্যালেরিয়াতে কিংবা পথ দুর্ঘটনায় মানুষ যে মরিতেছে, কিংবা অতিরিক্ত চর্বি-ভক্ষণে উদর স্ফীত এবং রক্তনালী ক্ষীণ হইয়া হৃদরোগে আক্রান্ত হইতেছে, তাহা নিত্যই লোকে দেখিতেছে। তৎসত্ত্বেও সরকার কখনও বিনামূল্যে মশারি বিতরণ করিতেছে, কখনও তামাকুতে কর বাড়াইতেছে, কখনও বা সিটবেল্ট-হীনদের জরিমানা করিতেছে। লোভ দেখাইয়া, ভয় দেখাইয়া নাগরিককে জীবিত এবং সুস্থ রাখিতে হইতেছে। প্রাণিজগতে কোনও অভিভাবক থাকিলে বিপজ্জনক পথে হাঁটা নিষিদ্ধ হইত লেমিংদের, অন্যথায় শাস্তি হইত। জীবিকার জন্য পথে বাহির হইয়া জীবনের ঝুঁকি লইয়া মোবাইল ফোনে কথা বলিলেও একই নিদান। বিবর্তন হইয়াছে, বদল হয় নাই। |