রবিবাসরীয় গল্প
অস্ত্র
কাল রাত থেকেই বৃষ্টি পড়ছে খুব। আর হাওয়া। এই পুবের তো এই পশ্চিম। এমনি উল্টোপাল্টা বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যেও নিলু জানে গোপালবাবু আসবে ঠিক। থানার পি সি পার্টি। আসতেই হবে ওকে। একতাড়া কাগজ বের করবে ব্যাগ থেকে। একটা একটা করে কাগজ ধরে নাম ডাকবে। জানতে চাইবে মনু বেরার ঘর কোথায় হবে? বা সন্ন্যাসী মিদ্দে? বারুইপুরের কোর্ট থেকে শমন এসেছে এদের নামে। কিন্তু না। আজ একতাড়া কাগজের বদলে লিফলেট-এর মতো একটা কিছু বের করল লোকটা। চায়ের দোকানের হরিপদদাকে ডেকে বলল, এক বার পড়ো তো জোরে জোরে। সবাই যেন শুনতে পায় স্পষ্ট করে।
এটা থানার। থানা মানে ধরা যাক সরকারই। বলা হচ্ছে, অঞ্চলের কারও কাছে বা কোথাও অস্ত্র লুকানো থাকলে বা কারও আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে জানাতে হবে থানাকে। এমনকী অপরিচিত কোনও লোক দেখলেও। প্রতিটি খবরের জন্যই পুরস্কার থাকবে। আর কেউ যদি নিজের নাম ঠিকানা গোপন রাখতে চায়, রাখতে পারে।
শহর, সুন্দরবনের এই দ্বীপ থেকে অনেক দূর। নৌকাপথ ধরলে অন্তত সাড়ে চার ঘণ্টা। না, শহর কলকাতা নয় রায়দিঘি। আর ইদানীং চালু হওয়া মোটর ভ্যান, অটো, নৌকা ফের মোটর ভ্যান করলে সময়টা অন্তত ঘণ্টাখানেক কমে। কিন্তু মোটর ভ্যান বা অটো পেতে গেলে মিনিট চল্লিশ হাঁটতে হবে তোমাকে এখান থেকে। মানে নিলুর ঘর থেকেই। হেঁটে নতুন বাজার, আর নতুন বাজার থেকে অটো বা মোটর ভ্যানে মাঝে খেয়া। ফের নৌকা মানে নদী পার, আবার মোটর ভ্যান।
পি সি পার্টির গোপালবাবু নিলুকে চেনে ভাল করেই। খাতিরযত্নও করে। কথা শোনে নিলুর। নিলু আজ চায়ের কথা বলল নিজের থেকেই। বলল, চা খেয়ে যান দাদা। লোকটার সত্যিই তাড়া আছে খুব। এমনিতে একটা পান অন্তত মুখে দেবে রোজ। আজ চা বা পান কিছুই নয়। আজ নাকি অন্য দিনের চেয়েও ব্যস্ত। শুধু তো শমন নয়, এই লিফলেটও। এই বৃষ্টিবাদলের দিন হলেও আজকের মধ্যে অন্তত এদিককার সব ক’টা দোকান, প্রাইমারি স্কুল, কলের পাড় মোটকথা যেখানে যেখানে লোকজন দাঁড়ায়, গল্প করে...।
দোকানে বসা কে এক জন জানতে চাইল, পুরস্কারটা কী রকম, মানে বলা নেই তো কিছু, এক হাজার নাকি পাঁচশো। গোপালবাবুর জানা নেই অতশত। বলল, বড়বাবু ধরিয়ে দিল হাতে ব্যস। এর পর যা বলার বলবে বড়বাবু, ফোন কর বড়বাবুকে।
গোপালবাবুর কাছে পুরস্কারের কথাটা তুলে কে যেন বুঝতে চাইল ভাল করে? মাইতি বাড়ির মানিক? নাকি তপন? কে যেন ছিল তখন ওখানে? পান শেষ করে বিড়ি ধরাবে নিলু। ছাতা থাকলেও বৃষ্টিতে নামতে ইচ্ছে করছে না রাস্তায়। পান মুখে দিয়ে বেঞ্চে বসে থাকা বা ডান দিকে চালার নীচে তাস খেলতে থাকা সবার মুখগুলিকে এক বার ভাল করে দেখে নেবে সে। কে জানতে চাইল পুরস্কারের কথা? কেন বুঝতে চাইল ভাল করে? মানলাম আয়লার পর থেকে পয়সা নেই লোকের ঘরে, তাই বলে লোক ধরিয়ে দিয়ে পুরস্কারের কথা ভাবে কেউ? বা অস্ত্র? আর্মস? একটা রিভলভার কিনছে না তোমার কাছ থেকে? পুলিশ বড়জোর দুশো, পাঁচশো...।
নিলু কি উঠবি?
কেন?
ছাতা আনতে ভুলে গেছি তো, তুই যদি...।
না, নিলু এখন ঘরে ফিরবে না কিছুতেই। ও বরং চা নেবে আর একটা। চায়ের কথা বলে ইলিশের সম্ভাবনার কথা তুলবে। জমি নষ্ট হওয়ার পর এই জলই বাঁচিয়ে রাখথে যতটুকু রাখার। গত তিন মাস নদী-জাল বন্ধ ছিল ফরেস্টের নিয়মে। তিন-চার দিন হল মনে হয় খুলেছে। সম্ভবত কালই রবিউলকে দেখল নিলু। বিকেলের দিকে জাল মাথায় করে যাচ্ছে নদীতে। এই টিপটিপ বৃষ্টির সঙ্গে ইলিশের সম্পর্ক ভাল। বেঞ্চে বসে থাকা পরেশকে বলল, ইলিশের জাল রেডি কর, নইলে ঠকতে হবে গত বারের মতো। ঠকা মানে গেলবার কেউ আশাই করেনি এত ইলিশের। শেষমেশ খবর হল যখন, তখন জাল নেই।
হরিপদ বলল, নৌকায় যাওয়ার লোক কোথায় এখন? জাল নৌকা নিয়ে অনেক আশা করে জলে নেমে দেখলে লোকজনকে দেওয়া থোওয়ার পর হয়তো বিড়ি কেনার পয়সাটা নেই। হরিপদ বলল, না রে পরেশ বরং গোপালবাবু যা বলে গেল তাই ধর...।
গোপালবাবু যা বলে গেল মানে? হরিপদর কথা ধরলে জাল-নৌকা-লোক জোগাড় করে ইলিশ খুঁজতে না গিয়ে এই ডাঙায় বসে অস্ত্র বা সন্দেহজনক লোক খুঁজলেই হবে। হয়তো ইয়ারকিই। কিন্তু এমন ইয়ারকি মারে কেউ? কেন মারবে, পুরস্কারের পয়সায় সংসার চলবে এত অস্ত্র খুঁজতে পারবে কেউ? আছে এখানে? আর সন্দেহজনক? কীসের সন্দেহ? কেন? কে কাকে সন্দেহ করবে?
বলব না বলব না করে বলেই ফেলল নিলু। বলল, কত অস্ত্র খুঁজবে তুমি? অস্ত্র কি আছে তেমন এখানে? আর সন্দেহই বা কাকে করবে তুমি?
হরিপদর কথায়, পুলিশ তো এমনি এমনি কাগজ ছড়াচ্ছে না, পুলিশ জানে সব, হয়তো ভাবছে আয়লার পর জমি নষ্ট হয়েছে যখন, পয়সার অভাবে এই পয়সার জন্যই গ্রামের বা আমাদের কেউ একেবারে ঠিকঠাক খবর দিয়ে...। আর তখনই মনে হল নিলুর, লোকগুলি আসলে ওর চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। নিলু চলে যাওয়া মাত্রই সবাই মিলে পুরস্কারের কথা আলোচনা শুরু করবে। অনুমান করার চেষ্টা করবে, কার কাছে কোথায়, কত সংখ্যায় থাকতে পারে কোন আর্মস, বা কাকে ঠিকঠাক সন্দেহ করা যেতে পারে, নিলু সুতরাং এখন উঠতে পারে। এই টিপটিপ বৃষ্টি আর এলোপাথাড়ি হাওয়ার মধ্যে ও বাড়ি যেতে পারে এখন।
নিলু এখন কী করবে? ওর কাছে অবশ্য আর্মস বলতে একটা একটা মাত্র রিভলবারই। আর কিছু গুলি। ইচ্ছে করলে রিভালবারটা অবশ্য সে নদীতেই ছুড়ে দিতে পারে। গুলিও। কিন্তু এত কষ্টের রিভলবারটা এক বারে নদীতে ছুড়ে দিলে, আর হাজার খুঁজলেও...। মানে শত দরকারেও নিলুর কিছু করার থাকবে না আর। বরং চড়ায় কোনও জঙ্গলে...। অসীমকে জিজ্ঞেস করে দেখবে? ওর কাছে দেশি মেশিন আছে দুটো। কিছু বোমাও। জিজ্ঞেস অবশ্য এখনই করতে পারে। এই ঝড়জলে বরং ওর কথাগুলি টেরও পাবে না কেউ।
হ্যালো। হ্যালো অসীম...।
না, এক বার দু’বার রিং হয়েই ফোনটা চুপ একেবারে। শব্দ নেই কোনও। না। আছে। তবে সে শব্দ ফোনের ওপারের নয়। এ পারেরই। এই নিলুর চার পাশে হতে থাকা উল্টোপাল্টা বাতাস আর বৃষ্টির জলের ঝাপ্টার। ফোনের লাইনের গণ্ডগোলও হতে পারে কোনও, ভেবে ফের বোতাম টিপল নিলু। আর ও পাশ রিং সেই আগের মতো দু’বার বেজে উঠে থেমে যেতেই, অসীম রিসিভ করছে ভেবে নিলু ফের বলে উঠল, হ্যালো... হ্যালো অসীম...। ও কি তবে রিসিভ করে চুপ করে থাকছে? ও কি তবে নিলুর গলার আওয়াজ, বা নিলু কী বলতে চায় শুনে নিতে চাইছে?
এক বারের জন্যও পা না হড়কে নিজের বাড়ির কাছে এসে পিছন থেকে তপনের গলা শুনতে পেল নিলু। ঘাড়ের উপরে ঝুঁকেই ছিল যেন ছেলেটা। ওর গলা শুনে চমকেই উঠল সে। বলল, তুই? ও নাকি অনেকক্ষণ ধরে ডেকে যাচ্ছে নিলুকে। বলল, কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোমাকে, আর তুমি এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ফোন করেই যাচ্ছে, কাকে ফোন করছিলে তুমি?
আমি? কাকে আবার ফোন করব?
তপনের চোখের দিকে তাকিয়ে ভল করে বুঝে নিতে চাইছিল নিলু। ঠিক কোন কথাটা বলতে চাইছে ছেলেটা। কিছু কি অন্য রকম কথা? নিলু চলে আসার পরও দোকানে থেকে গিয়েছিল ও। নিলুর কাছাকাছি আসার জন্য অবশ্যই জোরে হাঁটতে হয়েছে তপনকে। এই জলকাদায় অকারণে জোরে হাঁটে কেউ? ওর সঙ্গে আসতে চাইলে তো নিলু দোকান ছাড়ার সময়ই ডাকতে পারত ওকে। বলতে পারত, দাঁড়াও নিলুদা...। নিলু বলল, তুই কী জানতে চেয়েছিলি গোপালবাবুর কাছে?
কী?
ওই যে অস্ত্রের কথা, পুরস্কার...? আর্মসের খোঁজ, সন্দেহজনক লোক।
না তো।
তবে কে বলল?
ওরা দু’জনেই তখন থেমে গিয়েছে। দু’জনই তখন পাশাপাশি। ওর ঘরে যেতে গেলে তখনও দুটো বাড়ি পার হতে হবে তপনকে।
কখন মানে, গোপালবাবু যখন লিফলেটটা পড়াল হরিপদদাকে দিয়ে, তার পরে। বললি না তুই, তুইই তো বললি, নাকি তোর পাশে বসা অন্য কেউ। ওই যে ‘পুরস্কারটা কী রকম... এক হাজার না কি পাঁচশো...।’
না, কে বলবে? কেউই বলেনি তো...
বলেনি মানে। আমি স্পষ্ট শুনলাম।
ঘরে ঢুকেও মাথার ভেতর থেকে দূর করতে পারছিল তপনের কথাটাকে। কেউ নাকি বলেনি পুরস্কারের কথা। ঠিক আছে এটা না হয় ভুল শুনল নিলু। কিন্তু ওর এই জলকাদার রাস্তায় প্রায় ছুটতে ছুটতে নিলুকে ধাওয়া করা? ও কি সত্যিই সন্দেহ করে কাউকে? বা ও কি শুনতে পেল নিলুর ফোনে বলতে থাকা কথা? ওই মোবাইলে ‘হ্যালো, হ্যালো...’।
মা...
নাহ্, থাক ডাকবে না মাকে। প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে ঘরের পিছনে গোয়ালঘরটা এক বার দেখে এল নিলু। ঘর ছাওয়ার জন্য কষ্ট করে জোগাড় করা কিছু খড় গরু দুটোর সামনে রেখে ফিরে আসার সময় দেখল ছাগলটা ওর বাচ্চা দুটো নিয়ে কাঁপছে। বারান্দায় উঠে মাদুরে বসে একটা বিড়ি ধরাল নিলু। মাঝে মাঝেই দমকা বাতাসের সঙ্গে জলের ছিটে, রাতে ঘুমোবার আগে প্লাস্টিক পেপার খাটাতে হবে। খাটাতে হবে মানে বারান্দাটা ঘিরে দিতে হবে। বারান্দায় বসে নিলু এখন বৃষ্টিটাকে দেখতে পাচ্ছে। বৃষ্টির জন্যও হতে পারে, বৃষ্টির ছাঁট চার পাশের জগৎটাকে অস্পষ্ট করে দেওয়াতেই নিজেকে যেন ভীষণ একা লাগে নিলুর। চার পাশে কোথাও যেন নেই কেউ! সত্যিই? সত্যি। ঘরবাড়িগুলিতে কেউ যে আছে কী ভাবেই বা বুঝবে তুমি? নিলু কি বের হবে? নিলু কি বের হবে রিভলবারটা নিয়ে? জমি পার হয়ে খাল, খাল পার হয়ে জমি, এর পর বাঁধ, বাঁধের গায়ে জঙ্গল। এর পর নদী, নদীর ওপারে...। কে দেখবে এখন নিলুকে? আর দেখলেও সে না হয়...।
কে?
আর একটু হলেই অনন্তদের ভেড়ি পার হয়ে যেত নিলু। এর পর দু’পাশে জলে ভেজা খেত-জমি, বাঁধ, বাঁধের জঙ্গল।
আমি।
আমি। কে?
ওসমানদা। ছাতা মাথায় কী কারণে ঘরের বাইরে বেরিয়েছে কে জানে? ওসমানদা কি চিনতে পারছে না ওকে? হতে পারে অবশ্য। হয়তো জলের ছাঁট আর হওয়ার জন্য। হয়তো ইউক্যালিপটাস আর বাঁশ ঝাড়ের দুলুনিতে তৈরি হওয়া শোঁ-শোঁ শব্দের জন্যই।
আমি মানে চিনতে পারছ না তুমি?
আরে নামটা বলো না?
আমি নিলু।
যেন বিশ্বাস হচ্ছে না নিলুর কথা। যেন নিলুর হাঁটার ধরন, পিছন থেকে দেখা ওর চেহারা ভীষণ অচেনাই ঠেকছে ওর কাছে। এমনকী ওর গলার আওয়াজও। যেন এই বৃষ্টির মধ্যেও এক বার কাছে এসে ভাল করে দেখে নিতে চাইছে নিলুকে।
এই বৃষ্টিতে কোথায়?
ঘুনি পাতব।
সে পাতো, কিন্তু ঘর থেকে এত দূরে...। ঘরের লাগোয়া খালই তো ছিল।
বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে এক বারে বাঁ দিক আর এক বার ডান দিক দেখল নিলু। বৃষ্টি আর উল্টোপাল্টা বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে নিলুর মনে হল যত দূর থেকেই হোক উবু হয়ে ভিজতে থাকা ঘরগুলি থেকে অনেকেই যেন লক্ষ করছে ওকে। এমনকী ওসমানদাও ঘরে না ফিরে ওর পিছু পিছু এসে কিছুটা দূর থেকেই যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে চাইছে ওকে। যেন এই বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাসের মধ্যে বিকেলের ঝাপসা আলোয় গোপনে দাঁড়িয়ে বুঝতে চাইছে বাঁধ বরাবর জঙ্গলের পথে ঠিক কোথায় যাচ্ছে ছেলেটা। সত্যি তো এখানে এই অবেলায় কী করতে এসেছে নিলু? ঘুনি পাতার কোনও লক্ষ্মণও তো কেউ দেখছে না ওর হাঁটাচলায়। বরং বাড়িই ফিরবে সে। বাড়ি ফিরে একটু খেয়েই নেবে কিছু। হয়তো শাক ভাজা আর ভাত। সত্যি সত্যি ঘুনি পাততে পারলে অবশ্য খারাপ হত না কিছু। দুটো একটা পুঁটি বা ট্যাংরা পেলে রাতে...।
মা বলল, কারা যেন এসেছিল ওর খোঁজ করতে। তিন-চার জন হবে। না, চিনতে পারেনি মা। নিলু কোথায় জিজ্ঞেস করে বাড়ি নেই শুনে, কখন ফিরবে জানতে চেয়ে চলে গিয়েছে।
মেঘ আর বৃষ্টি থাকায় সুবিধা পেল নিলু। আকাশে চাঁদ থাকায় সমস্যা খুব। অনেক দূর থেকেও ইচ্ছে হলে যে কেউ তোমাকে লক্ষ করে যাবে। ঘোলাটে আকাশের জন্য সে বিপদ ততটা না থাকলেও ঝুঁকি নেবে না নিলু। সে বরং রাস্তার একটা ধার ঘেঁষেই হাঁটবে। ইউক্যালিপটাস বা বাবলা বা বাইনের ছায়া আর ঝোপ-জঙ্গল তোমার দরকারি কিছু অন্ধকার অন্তত দেবে। কত রাত কে জানে, বড়সড় একটা মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে দেওয়া মাত্র পা টিপে টিপে বারান্দা থেকে নীচে নামল নিলু। রিভলবারটাকে ঠিকঠাক কোমরে গুঁজে নিয়ে এই উল্টোপাল্টা হাওয়ায় কোনও কাজে লাগবে না জেনেও ছাতাটাকে সঙ্গে নিল। খাঁড়ি ছাড়িয়ে বাঁ দিকের চড়ায় সেই লাল কাপড় জড়ানো বাইন গাছটাকে খুঁজে বের করবে সে। একটা চিহ্ন, মাটির নীচে পুঁতে রাখা রিভলবারটাকে খুঁজে পাওয়ার একটা অন্তত চিহ্ন, মনে রাখতে পারবে সে।
কে যায়। কে?
কার গলা? কেউ কি পিছু নিল?
এ বার টর্চ জ্বলে উঠল একটা হঠাৎ করেই। বাঁধের গায়েই কেউ। কে? এত রাতে এখানে কেউ কি সত্যিই পিছু নিল? আলো ঘুরে নিলুর শরীর পর্যন্ত আসার আগেই বাঁধের গায়ে শুয়ে পড়ল নিলু। না, শুধু শুয়ে থাকলেই হবে না। নিলু এ বার বাঁধের বাঁ দিক ঘেঁষে শরীরটাকে নিয়ে নীচের দিকে, খাঁড়ির বাঁ দিকে জঙ্গলের দিকে ছেড়ে দিতে চাইল। এক বার জঙ্গলে ঢুকে পড়তে পারলে...।
নিলুকে এ বার এ জায়গাটা ছাড়তেই হবে। দরকারে হামাগুড়ি গিয়েই। ওরা ক’জন কে জানে? হয়তো অনেকক্ষণ ধরেই ওরা পিছু নিয়েছে নিলুর। হয়তো বাঁধের ওপর থেকেই...। যে বা যারাই হোক এ জায়গাটাকে লক্ষ রাখছে ঠিক। লক্ষ রাখছে টর্চ না জ্বালিয়ে গোপনে। এই গোপনে থেকে লক্ষ রাখাটাকেই ভয় পায় নিলু। কেউ কি ফিসফিস করে উঠল? নাকি হাওয়া?
ভাঁটা থাকায় অনেকটা পথ ধরেই জঙ্গল এড়াতে পারল নিলু। জঙ্গল এড়িয়ে নদীর ধার ঘেঁষে চড়া ধরে হাঁটার সময়ও লাগল কম, রিভলবারটা পড়ে আছে সেই বাঁধের গায়েই কোথাও। প্যান্টের নীচে যন্ত্রটা নেই টের পাওয়ামাত্র আঁতকে উঠেছিল নিলু। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে অনেক। একটু আগে যেখানে গড়িয়ে পড়েছিল সে, সেখানে তখন টর্চের আলোর শুধু জ্বলে ওঠা আর নিভে যাওয়া। নদীতে তখন জলের উথালপাথাল, চর জেগে ওঠায় পুবের বাতাস যেন রাগে ফুঁসছে। বাইনের ডালপালা এলোপাথাড়ি আছড়ে পড়ছে নিলুর গায়ে।
জঙ্গল ছেড়ে চর ধরে হাঁটার সময়, ওই মেঘ ফেটে বের হওয়া চাঁদের আলোতেও কোনও ছায়ার আড়াল নিল না নিলু। মাঝখানে এমনকী একটা খাঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে জলের নেমে আসায় খাঁড়ির এখানে সেখানে আটকে থাকা মাছ খলবল করছে। বেশ কিছু পার্সে ধরল নিলু। এর পর জঙ্গল ছেড়ে বাঁধ বেয়ে উপরে ওঠার সময় টের পেল তার শরীরটা অনেক হাল্কা হয়ে গিয়েছে। অনেক ঝরঝরে। এমনকী এই বৃষ্টি আর বাতাস তার ভাল লাগছে। বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে নীচে গ্রামের দিকে তাকাল নিলু। জলে ভেজা খেত জমি চাঁদের আলোতে চিকচিক করছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে হলুদ আলোয় দূরের ঘরবাড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হল অনেক অনেক দিন পর যেন সে তার গ্রামে ফিরছে। গ্রাম, নিজের ঘর, মা। মা কি জেগে উঠেছে? অন্তত এক বার। জেগে উঠে নিলুকে না দেখতে পেয়ে...।
বাঁধ থেকে নীচে নামার আগে আর এক বার পিছন ফিরে তাকাল সে। জঙ্গলের ভিতর টর্চের আলো নড়ছে এখনও। এখনও। হয়তো আরও কিছু পাওয়ার আশায়...। কে হতে পারে? যেই হোক, নিলু এখন ঘরেই ফিরবে। রিভলবারটা যার হাতেই পড়ুক নিলু নিশ্চিন্ত আজ রাত থেকেই সবার চেনা একটা মুখ এমনকী তার ঘরের মানুষের কাছেও ক্রমে সন্দেহজনক হয়ে উঠতে শুরু করবে।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.