রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
প্রাণটা কেন যায় বেঘোরে
পোলাও, কাবাব খেতে খেতেই বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিলেন জিগদালিক, “আমেরিকার এক-একটা রাজ্য আয়তনে আমাদের আফগানিস্থানের মতো। ওরা যদি আমাদের সাহায্য করতে চাইত, অনায়াসে পারত। কিন্তু এখনও আমাদের সেই দুর্দশার মধ্যেই বাঁচতে হচ্ছে। অর্থসাহায্য যা এসেছে, আফগানদের কিছুই দেওয়া হয়নি। সেগুলি হয় ওদের কন্ট্রাক্টরের পকেটে গিয়েছে, নয়তো দুর্নীতির চক্করে উবে গিয়েছে। যে লাখ লাখ ডলার এখানে পাঠানো হল, তাতে শেষ অবধি কী হল? উন্নয়নের কোনও লক্ষণ আদৌ দেখতে পাচ্ছেন? সময় চলে গিয়েছে, আমেরিকানদের ক্ষমতাও ফস্কে যেতে শুরু করেছে।”
“তা হলে তালিবানরাই আবার আসছে?”
“তালিবান?” মহম্মদ খান বললেন, “ওরা তো এসেই গিয়েছে। অন্তত সন্ধ্যার পরে, ওই পাহাড়ে।” আঙুল দিয়ে গান্দামাক আর তোরাবোরা গিরিপথের দিকে দেখালেন তিনি, “ওই সব জায়গায় ওরাই সবচেয়ে শক্তিশালী।”
নান রুটির শেষ টুকরো পরিষ্কার হতে হতে বিকেল পাঁচটা। ইতিহাসের ব্রিটিশ সেনাদের গান্দামাক শিবিরের দিকে এই শেষ বিকেলে আর রওনা হওয়া যাবে না। তাই সন্ধ্যাবেলায় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জেলালাবাদে ফিরে গেলাম আমরা। গিয়ে জানলাম, এক চুলের জন্য বেঁচে গিয়েছি। সে দিন সকালেই গান্দামাকে সরকারি সেনাদের সঙ্গে তালিবান-সমর্থিত গ্রামবাসীদের সাঙ্ঘাতিক এক যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। ভোজসভায় অতক্ষণ ধরে খাওয়া আর আড্ডাই আমাদের সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ব্রিটিশদের শেষ শিবিরের কাছেই যুদ্ধটা বেধেছিল। সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস আজকের আফগানিস্থানেও সেই এক ভঙ্গিতে পুনরাবৃত হয়ে চলেছে।
জেলালাবাদে পর দিন সকালে আমরা এক ‘জিরগা’য় গেলাম। উপজাতির প্রধান ও প্রবীণ নেতাদের জমায়েতকেই জিরগা বলে। সন্ধির পতাকা নিয়ে গান্দামাক গ্রামের প্রবীণ গাঁওবুড়োরাও সেখানে এসেছেন, আগের দিনের যুদ্ধের কারণ নিয়ে আলোচনা করছেন। এখনকার আফগান সরকারের দুর্নীতি, অদক্ষতা ও সংবেদনহীনতা নিয়ে যে অজস্র গল্প শুনেছি, সে রকমই একটি। একদা-ঘৃণ্য তালিবানদের ক্ষমতায় ফেরার পথ কী ভাবে প্রশস্ত হচ্ছে, সে রকমই এক গল্প!
কাছের বিমানঘাঁটিতে তখন বোমারু বিমান উড়ে যাওয়ার তীব্র শব্দ। তারই মধ্যে গান্দামাক গ্রামের প্রবীণরা বলছিলেন, আগের বছর সরকারি সেনারা তাঁদের খেতের আফিম আগুনে জ্বালিয়ে দিতে এসেছিল। সেনাদের প্রতিশ্রুতি ছিল, গ্রামের লোকদের পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। গ্রামের লোকেরাও সৈন্যদের কাজে তাই বাধা দেয়নি।
কিন্তু এক পয়সাও পাওয়া যায়নি। পরের বছর চাষের শুরুতেই গ্রামবাসীরা জেলালাবাদ আসে। আফিমের বদলে অন্য ফসল ফলাতে সরকারি সাহায্য পাওয়া যাবে কি না, জিজ্ঞেস করে তারা। বড় মুখ করে এ বারও সাহায্যের প্রতিশ্রতি দেওয়া হয়, এবং একটি পয়সাও পাওয়া যায় না। গ্রামবাসীরা এ বার আফিম চাষ শুরু করে, স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়ে দেওয়া হয়, এ বার তারা ফসল পোড়াতে এলে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া গ্রামের গত্যন্তর থাকবে না।
গত কাল আমরা যখন জিগদালিক গ্রামে পৌঁছেছি, সেই সময়েই সৈন্যরা গান্দামাক গ্রামে ঢোকে। গ্রামবাসীরা আগে থেকেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, সাহায্যের জন্য স্থানীয় তালিবান নেতাদের ডেকেও এনেছিল। যুদ্ধের ফল? ন’জন পুলিশ হত, দশ জনকে তালিবানরা পণবন্দি হিসাবে ধরে নিয়ে যায়। ধ্বংস হয় ছ’টি গাড়ি।
জিরগার শেষে ‘গ্রিন টি’তে চুমুক দিতে দিতে এক উপজাতি নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। “গত মাসেই জেলালাদের এক হোটেলে আমেরিকানরা আমাদের আলোচনার জন্য ডেকেছিল। এক জন সেখানে জিজ্ঞেস করল, তোমরা আমাদের এত ঘেন্না করো কেন? উত্তরে কী বললাম জানেন? তোমরা আমাদের ঘরের দরজা বোমায় উড়িয়ে দিয়েছে, তার পর ঘরে ঢুকে আমাদের মেয়েদের চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছ। বাচ্চাদের সপাটে লাথি কষিয়েছ। এগুলো মানা সম্ভব নয়। আমরাও পাল্টা লড়ব, মেরে তোমাদের দাঁত ভেঙে দেব। আগেও একটা-একটা করে দাঁত খুলে নিয়েছিলাম, ব্রিটিশগুলো পালিয়েছিল। এ বার তোমরা। আর মাত্র ক’টা দিন সবুর করো, দেখতে পাবে।”
“লোকটা এ সব শুনে কী বলল?”
‘‘ওর বন্ধুকে বলছিল, বাপ রে, বুড়োগুলিই যদি এমন রগচটা হয়, জোয়ানগুলো তা হলে কেমন? সত্যি কথা বলতে, আমেরিকানরা ভাল ভাবেই জানে, ওদের খেলা শেষ। তবে ওদের রাজনৈতিক নেতারা স্বীকার করে না, এই যা!”

১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা যে গান্দামাক পাহাড়ে শোচনীয় ভাবে পরাস্ত হয়েছিল, সেখানেই পশ্চিমের সাম্প্রতিক পুতুল সরকারের সৈন্যরা পরাজিত! দেড়শো বছর আগে ব্রিটিশরা যে চোরাবালিতে ডুবছিল, আজ ‘ন্যাটো’ও সেখানে। দুই যুগের দুই পরিস্থিতিতে কী অদ্ভুত মিল! কাবুলে ফিরতে ফিরতে এই সব কথাই ভাবছিলাম।
সমস্যাটা আর যাই হোক, পশ্চিমের প্রতি ঘৃণা নয়! ঘৃণা সে দিনও ছিল না, আজও নেই। কিন্তু সাহায্যের নামে অজস্র বিদেশি সেনা আর তাদের জোরজুলুম এখানে মানুষকে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। কাবুলের দিকে ফিরতে ফিরতে পাহাড়ি রাস্তায় এক মার্কিন কনভয়ের পিছনে আমরা আটকে গেলাম। আটটা ঢাউস ‘হামভি’, সৈন্যদের নিয়ে দুটো সাঁজোয়া গাড়ি। ঘণ্টায় ২০ মাইলেরও কম গতিতে ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে যাচ্ছে তারা। এবং এত কম গতিবেগ সত্ত্বেও আত্মঘাতী বোমারুর ভয়ে সেই মার্কিন কনভয় কোনও আফগান ড্রাইভারকে ‘ওভারটেক’ করতে দিতে নারাজ। কেউ সে রকম চেষ্টা করলেই সেনা কনভয় শূন্যে গুলি ছুড়ে তাদের সতর্ক করে দিচ্ছে। ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে দু’ঘণ্টা পর যখন গিরিপথের চূড়ায় পৌঁছলাম, পিছনে তিনশো গাড়ি আর ট্রাকের লম্বা জটলা। প্রতিটিতেই ক্ষুব্ধ আফগান মুখ, নিজের দেশে এক দল বিদেশির স্বেচ্ছাচারী হুকুম তামিল করতে করতে রাগে ফুঁসছে তারা। প্রতি দিন এই সব ছোট ছোট ঔদ্ধত্যের ঘটনা তাদের রাগ আরও চড়িয়ে দিচ্ছে।
আফগানরা কোনও দিনই বিদেশি শাসনে থাকতে চায়নি, বিদেশ থেকে চাপিয়ে-দেওয়া পুতুল সরকারদেরও তারা বরাবর প্রত্যাখ্যান করেছে। পশ্চিমের সুতোয় বাঁধা পুতুল শাসকেরা সে যুগে যেমন ছিল, আজও ঠিক সে রকম: দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং জনতার কাছে এতই অপ্রিয় যে বৈধতা পাওয়ার জন্য পশ্চিমি পুতুল-নাচিয়ের দিকেই ফিরে ফিরে দেখতে হয়। সম্প্রতি আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও রাষ্ট্রপুঞ্জকে একযোগে অভিযুক্ত করে কারজাই জানিয়েছেন, এরাই আফগানিস্থানের গত নির্বাচনে তুমুল কারচুপি ঘটিয়েছিল। ন্যাটোর সৈন্যদের ‘আক্রমণকারী’ বলে উল্লেখ করেছেন, এমনকী ওয়াশিংটন বেশি চাপ দিলে তালিবানদের সঙ্গে ভিড়ে যাবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন। প্রথম আফগান যুদ্ধের সময়ে, ১৮৪২ সালে ব্রিটিশদের পুতুল শাসক শাহ সুজাও এই রকমটাই করেছিলেন। রং বদলে বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শেষে অবশ্য বিদ্রোহীরাই তাঁর গদি উল্টে দেয়, শিরশ্ছেদ করে তাঁর।
পশ্চিমি পৃষ্ঠপোষণায় পুষ্ট শাসকেরা সে বার আফগানিস্থানের উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি, এ বারেও তথৈবচ। আমেরিকা ইতিমধ্যে সে দেশে ৮০০০ কোটি ডলার ঢেলেছে, কিন্তু রাজধানী কাবুলে রাস্তার হাল পাকিস্তানের মফস্সল শহরের চেয়েও জঘন্য। স্বাস্থ্য পরিষেবাও তথৈবচ, গুরুতর অসুখে রোগীদের আজও ভারতে উড়ে যেতে হয়। শিক্ষকদের এক-চতুর্থাংশ নিজেরাই নাম সই করতে জানেন না। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অর্ধেকেরও কোনও অফিস নেই। বিদ্যুৎসংযোগের শিকে ছিঁড়েছে আরও স্বল্পসংখ্যকের ক্ষেত্রে। প্রাদেশিক শাসনকর্তারা বেশির ভাগই খরচখরচা বাবদ মাসে মাত্র ৬ ডলার (ভারতীয় অর্থমূল্যে ২৫০ টাকা) পেয়ে থাকেন। প্রশাসকদের ন্যূনতম শিক্ষা এবং দক্ষতাও নজরে পড়ে না।
এত কিছু ঘটেছে, কারণ আফগানিস্থানে ঢালা ৮০০০ কোটি ডলারের ৭৬৫০ কোটি ডলারই খরচ করা হয়েছে সামরিক ও নিরাপত্তা খাতে। বাকি ৪০০ কোটি ডলারের ৩৫০ কোটিই গিয়েছে আন্তর্জাতিক উপদেষ্টাদের পিছনে। এই সব উপদেষ্টাদের কারও কারও দৈনিক ফি আবার হাজার ডলারের উপরে।
অন্য অনেক গা-ছমছমে মিলও আছে। আজকের মতো ইতিহাসের সেই যুদ্ধও অংশত বেসরকারি উদ্যোগে! ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে বেসরকারিকরণ ছিল না ঠিকই, কিন্তু ১৮৪২ সালের সেই যুদ্ধে ব্রিটেনের হয়ে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ নামে এক বাণিজ্যসংস্থাই ফৌজ সরবরাহ করেছিল। আজকের আফগানিস্থানেও নিরাপত্তাসংক্রান্ত বেশির ভাগ কাজই ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা বিভিন্ন ঠিকেদার কোম্পানির দায়িত্বে দিয়েছে। কাবুলের ব্রিটিশ দূতাবাসে দেখলাম, নিরাপত্তারক্ষীরা কেউই ব্রিটিশ পুলিশ বা সেনাবাহিনীর নন। ‘গ্রুপ ফোর সিকিয়োরিটি’-র! মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তাও ‘ব্ল্যাকস্টোন’ এবং অন্যান্য বেসরকারি এজেন্সির হাতে। আমেরিকার প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি যে ভাবে ‘যুদ্ধের বেসরকারিকরণ’-এর তাত্ত্বিক নীতি আউড়েছিলেন, তাতে এই ভাবেই কয়েক কোটি ডলার গলে যাওয়ার কথা ছিল।
এখনকার মতো সেই যুদ্ধেও আফগানিস্থান থেকে ফেরার আগে মুখ বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা হয়েছিল। সামরিক পেশি প্রদর্শনের শেষ চেষ্টা! ১৮৪২ সালের সেই চেষ্টায় অবশ্য সাধারণ মানুষের মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু হয়নি। ফলে আফগানরা ব্রিটিশদের থেকে আরও দূরে সরে গিয়েছিল। জিগদালিক গ্রামের এক ভদ্রলোক বলছিলেন, “আর কত বার ওরা আমাদের ঘরের নিরীহ মেয়ে আর শিশুদের কোতল করবে, তার পর ভুল হয়ে গিয়েছে বলে ক্ষমা চাইবে? ওরা আসে, বোমা ছুড়ে আমাদের হত্যা করে, তার পর বলে, ‘দুঃখিত, ভুল লোকদের মারা হয়ে গিয়েছে।’ তার পরও এক ব্যাপার ঘটাতে থাকে।’’
১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনারাও এই প্রতিক্রিয়াই পেয়েছিল। ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনারা কচুকাটা, জেনারেল এলফিনস্টোন আফগানদের হাতে পণবন্দি। সেই সময় মেজর জেনারেল জর্জ পোলক ও উইলিয়ম নটের নেতৃত্বে প্রতিশোধ নিতে ব্রিটিশ সেনা ফের কাবুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গভর্নর জেনারেল লর্ড অ্যালেনবরো সেনাদের সংযত থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু পাহাড়ে হাজারো ব্রিটিশ সেনার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে, সংযমের বাণী কে মানে? গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে নিষ্ঠুর অত্যাচার এবং ধ্বংসের তাণ্ডব শুরু।
পোলকের এই দ্বিতীয় বারের বাহিনীর সঙ্গেই ছিলেন সেনাবাহিনীর তরুণ ক্যাপ্টেন নেভিল চেম্বারলেন। প্রতিশোধ নিতে তাঁদের বাহিনী দক্ষিণ আফগানিস্থানের বিস্তীর্ণ এলাকা শ্মশান করে ছেড়ে দিয়েছিল। কোনও আফগানকে দেখলেই তাঁর ওপর সৈন্যরা কী ভয়াবহ অত্যাচার চালাত, চেম্বারলেন তাঁর ডায়রিতে লিখে রেখেছিলেন। এক দিন আহত এক আফগান মহিলার সঙ্গে চেম্বারলেনের দেখা। কোনও ক্রমে নিজেকে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে একটি কলসি নিয়ে পাহাড়ি ঝোরায় জল আনতে যাচ্ছেন তিনি। “আমি কলসিটি ওঁর হয়ে ভর্তি করে দিলাম। কিন্তু মহিলা শুধু শাপমন্যি দিয়ে গেলেন, ফিরিঙ্গিগুলি মরুক! নিজের প্রতি, দুনিয়ার প্রতি সর্বোপরি আমার পেশার প্রতি বিরক্তি নিয়ে ফের হাঁটতে শুরু করলাম। সত্যি কথা বলতে, আমরা লাইসেন্স পাওয়া খুনি ছাড়া আর কিছুই নই,” ডায়রিতে লিখেছেন তিনি।
আফগানিস্থানে সে বারের ব্রিটিশ পরাজয় আর এখনকার গোলমালের মধ্যে কয়েকটি তফাতও রয়েছে। ১৮৪২ সালে আমরা সে দেশে অন্তত উড়ে এসে জুড়ে বসা শাসকটিকে হঠিয়ে এক জন বৈধ শাসককে বসিয়েছিলাম। ব্রিটিশদের বসানো পুতুল শাসক শাহ সুজা পাশতুন গোষ্ঠীর সাদোজাই বংশোদ্ভূত। উপজাতি গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শেষ করে একীভূত আফগানিস্থানের যিনি প্রথম সম্রাট, সেই আহমেদ শাহ দুরানির পৌত্র। তখনকার প্রত্নতত্ত্বের পুরোধা ও পর্যটক চার্লস মেসন পরিষ্কার লিখেছিলেন, “শাহ সুজার প্রতি আফগানদের কোনও আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল যে ভাবে ওঁকে সিংহাসনে বসানো হয়েছিল, সেই পদ্ধতিটি নিয়ে।”
এ বারের গোলযোগ আরও জটিল, আরও বিচিত্র। সিআইএ-র পুরনো এক এজেন্ট, যাঁর নামে মাদকাসক্তি ও মানসিক অসুস্থতার নানা কাহিনি চালু, তাঁকেই ক্ষমতায় বসিয়েছে ন্যাটো। আমেরিকায় সিআইএ-র সদর দফতর ল্যাংলে থেকে উনি এক বার পালিয়েছিলেন, এটুকুই যা কৃতিত্ব! অবশ্য হামিদ কারজাই পোপলাজাই উপজাতির পাশতুন হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর নজরদারিতেই ন্যাটো কাবুলের উত্তরে তালিবান বিরোধী জোটকে ক্ষমতায় বসাতে পেরেছে। আফগানিস্থানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পাশতুন উপজাতিকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে ছেড়েছে।
এখনকার আফগান-পরিস্থিতিতে আমাদের গোলযোগে পড়ার কারণটা কিন্তু অন্য। তিন দশক ধরে চলতে থাকা এক জটিল গৃহযুদ্ধে আমরা নিজের অজান্তে নাক গলিয়েছি। সত্তরের দশক থেকে আফগানিস্থানে উত্তর বনাম দক্ষিণ, গ্রাম বনাম শহর, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ইসলাম, তাজিক বনাম পাশতুন অনেক ফ্রন্টেই যুদ্ধ চলছে। আমরা এমন এক সরকারকে ক্ষমতায় এনেছি, এমন সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি, যারা বেশির ভাগ সময় পাশতুন সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। এই সরকারের তৈরি সংবিধানে ক্ষমতা একেবারেই কেন্দ্রীভূত, আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের বিশেষ কোনও দায়িত্ব নেই। পশ্চিমি উদারনীতিকরা তালিবানদের যতই অপছন্দ করুন... অপছন্দের হাজারো কারণ রয়েছে অবশ্যই, কিন্তু সত্য অন্যত্র। তালিবানরাই গ্রামাঞ্চলের পাশতুন রক্ষণশীলতার প্রকৃত ও প্রামাণ্য কণ্ঠস্বর। কিন্তু কাবুলের ক্ষমতাসীন শাসকরা এই স্বরটি ছেঁটে দিয়েছেন, সেখান থেকে-আসা কোনও বক্তব্যই তাঁরা শোনেন না। ফলে পাশতুনরা যে যেনতেনপ্রকারেণ এই জমানাকে প্রতিহত করবেন, দেশের দক্ষিণ ও পূর্বে পাশতুন এলাকায় আগুনের মতো বিদ্রোহ ছনিয়ে পড়বে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
১৮৪২ সালের ব্রিটিশ ভ্রান্তি থেকে শেখার পক্ষে অবশ্য এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সেই সময় বিদ্রোহীরা যখন কাবুলের কাছে এগিয়ে এসেছে, ব্রিটিশ অফিসারেরা একের পর এক ভ্রান্ত পরিকল্পনার নথিপত্র পাঠিয়ে গিয়েছেন। তাঁদের ধারণা ছিল, সমস্যাটা সরাসরি সামরিক উপায়ে মেটানো যাবে। বাহিনীতে আরও বেশি আফগান সৈন্য নিলে তারা বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করবে, চলতি জমানাও অটুট রয়ে যাবে। কে না জানে, ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়াম ফক্স গত বছরেই আফগানিস্থান নিয়ে এই রকম একটি নীতি আউড়েছিলেন!
আর ব্রিটিশরা সেই ১৮৪২ সালে যখন বুঝেছিল, সামরিক পথে নয়, রাজনৈতিক ভাবে সমস্যা মেটাতে হবে, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ক্ষমতা তাদের মুঠো থেকে ফস্কে যেতে শুরু করেছে, বিদ্রোহীরা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য কিছুতে নারাজ। আজকের আফগান সমস্যাও সামরিক পথে মেটানো যাবে না।
আফগানিস্থানে পাঁচ লক্ষ সৈন্যকে অস্ত্রসজ্জিত করার চলতি ব্রিটিশ প্রকল্প নিয়েও আমরা যদি এগিয়ে যাই? ওই প্রকল্পে বার্ষিক ২০০ কোটি ডলার খরচ। এ দিকে, সামগ্রিক রাজস্ব বাবদ আফগান সরকারের বার্ষিক আয়: ৬০ কোটি ডলার। সোজা কথায়, প্রকল্পের খরচ সরকারের রাজস্বের তিন গুণেরও বেশি। এবং এ সব সত্ত্বেও সেই সৈন্যরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না, কারজাইয়ের কলঙ্কিত তানাশাহিকেও বাঁচাতে পারবে না। আফগান সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণের লক্ষে আমেরিকা ও ন্যাটো ইতিমধ্যেই সে দেশে ২৫০০ কোটি ডলার ঢেলেছে। তা সত্ত্বেও নিরাপত্তা-ব্যবস্থা দিনকে দিন দুর্বল হচ্ছে, ফি সপ্তাহেই সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা আড়ে-বহরে সঙ্কুচিত হচ্ছে।
রাজনৈতিক সমাধানের রাস্তা একটিই। কোনও না কোনও ভাবে ক্ষমতা থাকতে থাকতেই তালিবানদের সঙ্গে আলোচনায় বসা। কারজাইয়ের অন্যতম কৃতিত্ব, এই রাস্তায় হাঁটার প্রয়াস। কোনও তালিবান নেতা অস্ত্র সংবরণ করলেই কারজাইয়ের প্রস্তাবিত ‘শান্তি জিগরা’য় তিনি স্বাগত। ডেভিড ক্যামেরনের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ সরকার এই প্রস্তাব কী চোখে দেখছে, এখনও পরিষ্কার নয়। ওবামা অবশ্যই বিরুদ্ধে। ওই এলাকার মার্কিন দূত রিচার্ড হোলব্রোকও তাঁর পক্ষে। হোলব্রোকের কূটনৈতিক বুদ্ধিতে অবশ্য কেউ ভরসা করে না। প্রবীণ এক ব্রিটিশ কূটনীতিক ওঁর সম্পর্কে ‘খ্যাপা ষাঁড়’-টাড়ও বলছিলেন।
আফগানিস্থানের পাট গুটিয়ে ফিরে আসার আগে সে দেশে অবশ্যই আমাদের কিছু করণীয় আছে। ন’বছর ধরে যা করতে পারিনি, সেই ন্যূনতম প্রাথমিক পরিকাঠামোর সংস্থান! ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ ও প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়াম ফক্স দু’জনেই অবশ্য এই কাজের ঘোর বিরুদ্ধে। লিয়াম ফক্স ‘টাইম’ পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পড়ে থাকা এই দেশটার শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করার জন্য আমরা এখানে আসিনি।” আফগানরা সেই মন্তব্যে প্রবল ক্ষুব্ধ। আরও অযাচিত ক্ষতি হওয়ার আগে টোরি সরকার তাদের দলের রোরি স্টুয়ার্টের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। রোরি তাঁর দলে এখন বিশেষ পাত্তা পান না, কিন্তু আফগানিস্থান সম্পর্কে তাঁর ধারণা ফক্স এবং হেগ দু’জনের থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছ। রাজনীতিতে আসার আগেই রোরি জানিয়েছিলেন, ত্রাণপ্রকল্পে স্থানীয়দের কাজ দিয়ে আফগানিস্থানের অনেক উপকার করা যায়। “আফগান সরকারের অনুরোধ মেনে সে দেশে কৃষি, সেচ, শক্তি ও সড়কে আমাদের আরও বিনিয়োগ করা উচিত,” লিখেছিলেন তিনি।
ইতিমধ্যে ওবামা আফগানিস্থান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা করেছেন। আগামী ২০১৪ খ্রিস্টাব্দকে ‘ডেডলাইন’ ধরা হয়েছে, তার মধ্যেই ধাপে ধাপে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে। আর মার্কিন সৈন্যদের সেই প্রত্যাবর্তন এক বার শুরু হলে ন্যাটোর অন্য সদস্যরাও পিছিয়ে থাকবে না। তারাও আফগানিস্থানে নিজস্ব ঘাঁটি থেকে বিদায় নেবে। ডাচরা ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, আফগানিস্থানে তাদের শক্ত ঘাঁটি উরুজঘান এলাকা ছেড়ে তারা দেশে ফিরে যাবে। কানাডা, ডেনমার্কও এগোতে চলেছে সেই সৈন্য প্রত্যাহারের পথেই। উইলিয়াম হেগ, লিয়াম ফক্স মুখে যাই বলুন না কেন, ব্রিটেনকেও সে দিকে হাঁটতে হবে। সাম্প্রতিক জনসমীক্ষায় প্রকাশ, ৭২ শতাংশ ব্রিটিশই চান, আফগানিস্থান থেকে অবিলম্বে সেনা প্রত্যাহার করা হোক! এই প্রবল জনমতের বিরুদ্ধে সরকার কত দিনই বা নিজের মতো চলতে পারবে?
আরও একটা কথা। সংখ্যাগরিষ্ঠ পাশতুন গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে পশ্চিমি সুতোয় বাঁধা একটি পুতুল সরকার যে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে না, সেই ব্যাপারটিও পরিষ্কার হয়ে যাওয়া ভাল। কারজাই সরকার আমাদের চোখের সামনেই গুঁড়িয়ে পড়ছে। আর এই পরিস্থিতিতে চোখে ঠুলি এঁটে থাকলে শেষ অবধি ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ইতিহাসই ফের ঘুরে আসবে। ১৮৭০ সালে দ্বিতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের আগে, প্রথম যুদ্ধের পোড়খাওয়া সেনানী জর্জ লরেন্স ‘টাইম’ পত্রিকায় সেই বিষয়ে হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন। “এক নতুন প্রজন্ম এসেছে। অতীতের থেকে শিক্ষা নেওয়ার বদলে তারা ওই অশান্ত, দুঃস্থ দেশে ফের হস্তক্ষেপ করে আমাদের এক জটিল আবর্তে ঠেলে দিতে চায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়তো এড়ানো যাবে। কিন্তু সামরিক দিক থেকে আমরা যত লাভই করি না কেন, রাজনৈতিক ভাবে তা অপ্রয়োজনীয় হয়েই থাকবে,” চেতাবনি দিয়েছিলেন তিনি।
উইলিয়াম ডালরিম্পলের এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ বছর একটি বই প্রকাশিত হবে। তারই আগাম পাঠ।

(শেষ)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.