একে পরিষেবা ঠিক মতো মেলে না। তার উপরে জাঁকিয়ে বসেছে দালাল-চক্র।
এই দুই যাঁতাকলে পড়ে চন্দননগর মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অনেককে যেমন বাড়তি কড়ি গুনতে হচ্ছে, তেমনই বহু মানুষকে চিকিৎসা না-করিয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে বলে অভিযোগ। অথচ, এ ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ রোগী ও তাঁদের আত্মীয়-স্বজনেরা।
ফরাসি আমলে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটির উপরে মহকুমার দূরদূরান্তের মানুষ যেমন নির্ভরশীল, তেমনই গঙ্গার উল্টো পাড়ের জগদ্দল, কাঁকিনাড়া বা শ্যামনগর থেকেও রোগী আসেন। বেশ কিছু দিন ধরেই হাসপাতালের ইউএসজি যন্ত্র খারাপ। ইসিজি যন্ত্র নেই। এক্স-রে’র মান খারাপ এবং এক্স-রে প্লেট সরবরাহ হয় অনিয়মিত ভাবে। হাসপাতালে কোনও শিশু বিভাগ নেই। নেই বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ। নাক-কান-গলা (ইএনটি) সংক্রান্ত অস্ত্রোপচার হয় না প্রায় এক দশক ধরে। এ কথা মেনে নিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর এই সব পরিকাঠামোর অভাবেই দালাল-চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ রোগীদের। |
হাসপাতাল চত্বর হয়ে উঠেছে অ্যাম্বুল্যান্সের স্ট্যান্ড। ছবি: তাপস ঘোষ। |
কী ভাবে সাধারণ মানুষ দালালদের খপ্পরে পড়ছেন?
হাসপাতালটির আশপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি নার্সিংহোম এবং প্যাথলজি কেন্দ্র। সাধারণ মানুষের বক্তব্য, হাসপাতালে কী কী পরিষেবা অমিল, সে ব্যাপারে দালালেরা ওয়াকিবহাল। তারা হাসপাতাল চত্বরেই ঘোরাফেরা করে। অভিযোগ, দালালদের সঙ্গে হাসপাতালের এক শ্রেণির কর্মীর যোগসাজস রয়েছে। সেই যোগসাজসের ফলে চিকিৎসক কোনও পরীক্ষার কথা বললে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে গিয়ে পড়তে হয় দালালদের হাতে। বাইরে থেকে অতিরিক্ত গাঁটের কড়ি খরচ করে পরীক্ষা করাতে তাঁরা বাধ্য হন। অর্থের বিনিময়ে রাতে রোগীর আত্মীয়দের মেল ওয়ার্ডে থাকার ব্যবস্থাও হয়।
তা ছাড়া, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, স্থানীয় কাউন্সিলরের শংসাপত্র দাখিল করতে পারলে গরিব মানুষের বিনা খরচে হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার কথা। কিন্তু দালালদের জন্য অনেক গরিব মানুষই সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন বলে অভিযোগ। আর এই সব দালালেরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকে বলে কেউ তাদের ঘাঁটাতে সাহস করে না বলে অভিমত রোগী ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনের।
হাসপাতালে দালালদের রমরমার কথা অস্বীকার করেননি সুপার অসীম প্রামাণিক। অবশ্য সে জন্য তিনি অনেকটাই ভুক্তভোগী মানুষকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, “আমি সব সময় হাসপাতালে থাকি। কিন্তু আমার কাছে না এসে, বহু সময় ওদের খপ্পরে গিয়ে পড়েন মানুষ। দালালদের বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ জানাতে বলা হলেও তা করা হয় না। ফলে, ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।”
শুধু দালাল নয়, হাসপাতালের পরিষেবা নিয়েও বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে সাধারণ মানুষের। অনেকের মতে, নামে মহকুমা হাসপাতাল হলেও এখানে পরিষেবার মান প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো। অভিযোগ, প্যাথলজিস্ট না-থাকায় বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট দেন টেকনিশিয়ানরা। হাসপাতাল সূত্রের খবর, একমাত্র বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ এ বি সাহা সদ্য অবসর নিয়েছেন। আর এক চিকিৎসকও সম্প্রতি স্বেচ্ছাবসর নিয়েছেন। তাঁদের জায়গায় নতুন নিয়োগ হয়নি। শল্য চিকিৎসক সমীর মণ্ডলের চাকরির মেয়াদও শেষ হচ্ছে আগামী মাসে। মেডিসিনের চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র এক জন। অর্থাৎ, প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা কম।
চিকিৎসক ও কিছু যন্ত্র খারাপ থাকায় পরিষেবার সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন সুপার। তিনি বলেন, “হাসপাতাল চালানোই দায় হচ্ছে। সব স্বাস্থ্য ভবনে জানিয়েছি। শীঘ্রই এক জন রেডিওলজিস্ট যোগ দেবেন। আসবে একটি ইউএসজি যন্ত্রও। হাসপাতালে একটি পুলিশ ক্যাম্প করার জন্য পুলিশের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।” হাসপাতালটি ঘনবসতি এলাকায়। হাইকোর্টের নির্দেশে হাসপাতালের মর্গে ময়না-তদন্ত বন্ধ সেই ২০০৫ সাল থেকে। অথচ, সেখানে ‘গোপন বোঝাপড়া’য় মৃতদেহ রাখা হচ্ছে, এবং তার জেরে দূষণ ছড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সুপার অবশ্য এই অভিযোগ মানেননি। |