|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
এমন সঙ্কট আমাদের দেশে হলে কী হবে? |
শান্তনু চক্রবর্তী |
মৃত্যুভূমি ফুকুশিমা, প্রদীপ দত্ত। চর্চাপদ, ২০০.০০ |
আমাকুদারি। উচ্চপদস্থ জাপানি আমলারা সরকারি কাজ থেকে অবসরগ্রহণের পর বেসরকারি সংস্থাগুলির উচ্চপদে নিযুক্ত হন। সরকারি ক্ষমতার স্বর্গ থেকে বেসরকারি মর্তে অবতরণ হল ‘আমাকুদারি’র। এ অবতরণ সুখের। জোটে বিপুল মাইনে। বেসরকারি সংস্থাগুলিরও লাভ। প্রাক্তন সরকারি আমলার উপস্থিতি সরকারি দফতরগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। ফলে সরকারি নজরদারি কমে ও আরও নানাবিধ লাভ হয়।
বহু কাল ধরে জাপানের পরমাণু বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলি খরচা কমানোর লক্ষ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থাতে ফাঁকি দিয়েছে। ঘটেছে একের পর এক ছোট-বড় অঘটন। বরাতজোরে বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছেন জাপানের মানুষ।
কিন্তু ২০১১-এর মার্চে সুনামি প্লাবিত ফুকুশিমা দাই-ইচির একটার পর একটা চুল্লিতে দুর্ঘটনা ঘটল। ঘটল ভয়াবহ ‘মেল্টডাউন’। ফুকুশিমা দাই-ইচির বিপর্যয়ের পর অজস্র রিপোর্ট, প্রবন্ধ, এমনকী গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ এখনও মাত্র কয়েকটি। তাদেরই একটি বাংলায়। প্রদীপ দত্তের মৃত্যুভূমি ফুকুশিমা।
আকর্ষণীয় মলাটের বইটি চোখ টানে। তথ্যে ঠাসা ১৬০ পৃষ্ঠা। তবে ঝরঝরে গদ্য। গল্পের মেজাজ থেকে লেখা কখনোই খুব দূরে সরেনি। তাই তথ্যের বোঝা মনকে বিকল করে না।
আমাকুদারির আখ্যানের মতো রয়েছে আরও আগ্রহোদ্দীপক বিষয়। যেমন, জাপানে পরমাণু বিদ্যুতের জন্মকাহিনি। ১৯৪৫-এ হিরোশিমা-নাগাসাকির ঘটনার পর থেকে বিশ্বে পরমাণু অস্ত্রবিরোধিতা জোরদার হচ্ছিল। ১৯৫৪-তে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর মার্কিন হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের ফলে মার্শাল দ্বীপের অধিবাসী ও জাপানি মৎস্যজীবীরা তেজস্ক্রিয়তার শিকার হলেন। তেজস্ক্রিয় টুনা মাছ জাপানের বাজারে বিক্রি হয়ে ছড়াল আতঙ্ক। হাইড্রোজেন বোমা নিষিদ্ধ করার দাবিতে সই করলেন ৩.২ কোটি জাপানি। পরমাণু অস্ত্রসজ্জায় দায়বদ্ধ মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল পরমাণু অস্ত্রবিরোধী জনমত প্রশমিত করার প্রয়োজন বোধ করলেন। পরমাণু অস্ত্রবিরোধিতাকে প্রশমিত করতে পরমাণু গবেষণা ও শক্তিকে জনপ্রিয় করার মনস্তাত্ত্বিক কৌশল রচিত হল। মার্কিন প্রশাসন পরমাণু গবেষণার ‘কল্যাণকর’ দিকটির ওপর জোর দিল। পরমাণু অস্ত্র বিরোধিতা যে দেশে তুঙ্গে, সেই জাপানে মগজধোলাইয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিল ইউএসআইএস। কী বিপুল অর্থব্যয়ে এবং কী দক্ষতার সঙ্গে জাপানি মনে পরমাণু শক্তির প্রতি আকর্ষণ সঞ্চার করতে সক্ষম হল ইউএসআইএস, তার কাহিনি আছে এই বইয়ে। জনগণমন জয়ের একটি সফল রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার বিবরণ পেশ করে লেখক বাঙালি পাঠকের কৃতজ্ঞতার দাবিদার হয়েছেন।
তেজস্ক্রিয় বিকিরণের শারীরিক প্রভাবের কুফলের সম্পূর্ণ খতিয়ান পেতে আরও অনেক বছর। তখন জানা যাবে, থাইরয়েড ক্যানসার, লিউকেমিয়া, ত্বকের ক্যানসার, জেনেটিক গোলযোগ প্রভৃতির শিকার কত লক্ষ মানুষ। তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ফল প্রকট। তথ্য-পরিসংখ্যানের আবরণ ভেদ করে ব্যক্তিজীবনে বিপর্যয়ের বহু আখ্যান তুলে এনেছেন লেখক। জাপানের মতো বিপর্যয় মোকাবিলায় অভ্যস্ত, উন্নত অর্থনীতি ও প্রযুক্তির দেশে পারমাণবিক সংকট যদি এমন ভয়াবহ চেহারা নিতে পারে তা হলে আমাদের দেশে কী হবে?
ফুকুশিমা-কাণ্ডের আগেই কিছু দেশ পরমাণু শক্তির প্রতি বিমুখ হয়েছে। বিপর্যয়ের পরে আরও কিছু দেশ। তালিকা দিয়েছেন লেখক। তাঁর গ্রন্থটি পরমাণু শক্তির বিপক্ষে জোরালো সওয়াল। তবে বিপরীত মতের পাঠকের কাছেও অনেক তথ্য জরুরি মনে হবে।
বইটির অন্যতম সম্পদ এর পরিশিষ্টগুলি। ‘পরমাণু চুল্লি কী ও কেন’, ‘তেজস্ক্রিয় বিকিরণ’, ‘বধ্যভূমিতে রুটিরুজি’ প্রভৃতি পরিশিষ্ট আগ্রহী পাঠকের কাজে লাগবে। রয়েছে প্রচুর পাদটীকা, যেখানে আলোচিত হয়েছে অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয়।
অজস্র তথ্য। খুব সাম্প্রতিক তথ্যও আছে। সূত্রনির্দেশ করলে পৃষ্ঠা সংখ্যা অনেক বাড়ত। বোধহয় সেই কারণেই লেখক সূত্রনির্দেশ করেননি। এটা একটা সমস্যা। গ্রন্থশেষে উল্লেখপঞ্জী আছে। কিন্তু উল্লেখপঞ্জীর কোথায় কোন তথ্যের সূত্র মিলবে তা বোঝা কঠিন। ফুকুশিমার বিপর্যয় শুরুর দশ মাসের মাথায় বইটি প্রকাশিত হয়েছে। তাড়ার ফলেই রচনার কিছু জায়গায় অগোছালো ভাব। কিছু ভুল চোখে পড়ে। যেমন: আমেরিকার রকি ফ্ল্যাট্স পারমাণবিক প্রকল্পটিকে ‘পরমানু চুল্লি’ বলা হয়েছে, ছিল পারমাণবিক অস্ত্রাংশ নির্মাণের কারখআনা। লাইতেত গ্রাম ফুকুশিমা দাই-ইচি থেকে ২৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত নয়, ৩৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। লুপ্ত নগরী আতলান্তিস-এর কাহিনিটি ইতিহাস নয়, মিথ। মার্কিন যুদ্ধবিমান ‘drone’-কে ‘দ্রোণ নয়, ‘ড্রোন’ লেখাই সঙ্গত। ‘Sievert’-এর উচ্চারণ ‘সিয়েভার্ট’ নয়, ‘সিভার্ট’।
এ জাতীয় টুকরো ঘাটতি সত্ত্বেও বইটি পারমাণবিক শক্তিবিষয়ক আলোচনায় মূল্যবান সংযোজন। |
|
|
|
|
|