পুস্তক পরিচয় ১...
প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য, স্বয়ম্ভূ নয় কেউই
কনফ্লুয়েন্সেস, রঞ্জিৎ হস্কোটে ও ইলাইজা ট্রোজানো । ইয়োদা প্রেস, ২৯৫.০০
উরোপ যে যুক্তিবাদ ও আলোকপ্রাপ্তির উৎকর্ষ দাবি করে, তা কি একান্তভাবেই কোনও ইউরোপীয় সত্তার নিজস্ব বিবর্তনের ফল, যার ডিএনএ পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্দরেই নিহিত ছিল? নাকি তা প্রাচ্যের সাধনার সংস্পর্শে অর্জিত হয়। রেনেসাঁ-পূর্ব ইউরোপ যে হাজার বছর ধরে খ্রিস্টীয় গোঁড়ামি ও জড়ত্বে অভিভূত ছিল, ইতিহাসে তার সাক্ষ্য আজ জ্বলন্ত। ততটাই জ্বলন্ত ওই সময়পর্বে ইসলামের হাত ধরে ভূমধ্যসাগরের চরপাশ ও পশ্চিম এশিয়ায় প্রাচ্য মনীষা, অন্বেষণ ও উন্মেষশালিনী বুদ্ধির অনুপম স্ফুরণ, যার রোশনাই ক্রমে ইউরোপের অন্ধকারকেও দূর ক’রে তাকে নবজাগরণের জন্য প্রস্তুত করে। ইসলামের হাত ধরেই যে ইউরোপ অ্যারিস্টট্ল ও প্লটিনাসকে আবিষ্কার করে, প্রাচ্যের গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়ন, প্রযুক্তিবিদ্যা ও স্থাপত্যকলার মহিমান্বিত অর্জনগুলিকে আত্মস্থ করে, এ কথা আজ গবেষকদের জানা। যা তুলনায় কম জানা, তা হলো, অ্যারিস্টটলের সংশয়বাদই শুধু নয়, পাশ্চাত্য দর্শন ও ধর্মের মূল ধারণা ও তত্ত্বের অনেক কিছুই বরাবর নিজেদের বলে চালালেও ইউরোপ তথা পশ্চিম প্রাচ্য থেকেই সেগুলি ধার করেছে, অথচ কখনও ঋণ স্বীকার করেনি। আলোচ্য গ্রন্থটি তারই সংক্ষিপ্ত বিবরণী।
রেনেসাঁর যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ, ঈশ্বরকে নয়, মানুষকে সৃষ্টির ভরকেন্দ্রে স্থাপন করা, দৈব আবির্ভাবের গরিমা বনাম প্রাত্যহিক যাপনের অভিজ্ঞতায় উপলব্ধ বাস্তবতার দ্বন্দ্বে শেষোক্তকে মহিমান্বিত করা, সত্যের উপর পোপ-পাদ্রি বা খলিফা-ইমামদের একচেটিয়া স্বত্বের দাবি প্রত্যাখ্যান করে দার্শনিকের সংশয় ও অন্বেষা এবং অভিজ্ঞতাবাদের (empiricism) প্রাধান্য কায়েম করার ধারণাগুলি নবম শতাব্দী থেকেই আল-কিন্দি, আল-রাজি, আল-ফরাবি, ইবন সিনা ও ইবন রুশ্দ-এর একের পর এক গ্রন্থে বজ্রনির্ঘোষের মতো আছড়ে পড়তে থাকে।
বাগদাদ থেকে কায়রো হয়ে কর্দোবা, দামাস্কাস থেকে আলেকজান্দ্রিয়াইসলামের সমগ্র ভুবনে এই উতরোল দার্শনিক কোলাহল যখন তুঙ্গে, ইউরোপে তখন অশিক্ষিত বর্বররা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আল আন্দালুসে (বর্তমান স্পেন) তখন উম্মায়েদ খলিফাদের অধীনে বিকশিত হচ্ছে স্যামুয়েল হা-নাগিদ-এর ইহুদি ধর্মতত্ত্ব ও সাহিত্য। অষ্টম শতকে বেতালপঞ্চবিংশতি, কথাসরিৎসাগর, পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ থেকে আরবিতে অনূদিত ‘দস্তান কলিলা’ ও আরব্য রজনীর গল্প ধার করে এবং তার কাঠামো অনুকরণ করে এর অনেক পরে রচিত হবে বোকাচ্চিওর ‘ডেকামেরন’ এবং চসারের ‘ক্যান্টারবেরি টেল্স’। রামায়ণের ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আখ্যান খ্রিস্টীয় রূপকথা ও আইকনোগ্রাফিতে প্রতিস্থাপিত হবে ‘দ্য ভার্জিন অ্যান্ড দ্য ইউনিকর্ন’ রূপে। সংস্কৃত, গ্রিক, লাতিন ও হিব্রু থেকে আরবিতে কিংবা আরবি থেকে লাতিনে তখন অজস্র গ্রন্থ রুদ্ধশ্বাসে অনুবাদ করে চলেছেন ইসলামের পণ্ডিতরা, বিস্মিত ইউরোপের সামনে মেলে ধরছেন তার রেনেসাঁ-প্রস্তুতির যাবতীয় উপাদান।
১৩০৮ সালে দান্তে যখন তাঁর ‘ডিভাইন কমেডি’ লেখা শুরু করছেন, তার অন্তত পাঁচশো বছর আগে থেকেই পয়গম্বরের স্বর্গারোহণ ‘আল-মিরাজ’-এর উপকথাটি গোটা পশ্চিম এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বহুলিখিত, বহুচর্চিত। যুধিষ্ঠিরের সশরীর স্বর্গারোহণ ও নরকদর্শনের আখ্যান তো তারও অনেক আগের। ঘুমের মধ্যেই দেবদূতের হাত ধরে নরকের দুঃস্বপ্নসম্ভব ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবার পর অভিশপ্তদের গ্যালারির মুখোমুখি হওয়া, তারপর ‘পার্গেটরি’ হয়ে স্বর্গে পৌঁছনর এই আখ্যান খ্রিস্টীয় পুরাণে কখনও ছিল না। পশ্চিম এশিয়ায় এই পুরাণকথার বীজও রফতানি হয়েছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের স্বর্গীয় ও নারকীয় ‘মণ্ডল’-এর ধারণার অনুবাদ থেকে, যা সুফি মরমিয়াদের ভক্তিসঙ্গীতকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। জিব্রাইল ফরিস্তা যেমন পয়গম্বরকে এই অভিযাত্রায় নিয়ে যান, তেমন দান্তেকে নিয়ে যান ভার্জিল। তখনকার ফ্লোরেন্স তথা ইতালিতে ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রভাব এত বহুমুখী ছিল, আরবি ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শনের অনুবাদ এত ব্যাপক ছিল যে দান্তের পক্ষে তার প্রভাব বা সংশ্রব এড়ানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু কোথাও তিনি ইসলাম বা প্রাচ্যের কাছে তাঁর এই ঋণ স্বীকার করেননি, উল্টে মহম্মদকে ‘অভিশপ্তদের’ তালিকাশীর্ষে স্থাপন করে তাঁকে নরকে নিক্ষেপ করেছেন।
দেওয়া- নেওয়া। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি এবং ভার্জিন অ্যান্ড দ্য ইউনিকর্ন।
এটা কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। ইউরোপ কখনও তার সভ্যতা-সংস্কৃতি, সাহিত্য-শিল্পের পিছনে প্রাচ্য সংস্পর্শের ভূমিকা স্বীকার করেনি। যেন ইউরোপীয় পাশ্চাত্য সভ্যতা স্বয়ম্ভু, যেন বরাবরই সে তার বর্তমান উৎকর্ষে স্থিত ছিল। যেন প্রাচ্যের ইসলামি বৌদ্ধ বা হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতি-ধর্ম-দর্শন থেকে সম্পূর্ণ ল্বাধীনভাবে তার বিবর্তন ও বিকাশের পর্যায়গুলি অতিক্রান্ত হয়েছে। রঞ্জিত হস্কোটে এবং ইলাইজা ট্রোজানো এই আত্মম্ভরী রূপকথার ফানুসটি ফুটো করে দিয়েছেন। শুধু ইউরোপ বা প্রতীচ্য নয়, কোনও সভ্যতাই একা-একা মাটি ফুঁড়ে বের হয়নি, অন্যান্য নানা সভ্যতা-সংস্কৃতির স্পর্শ ও অভিঘাতে, বর্ষণ ও সিঞ্চনে সিক্ত, সমৃদ্ধ, পুষ্ট হয়েছে। এ কথা আজ আর কোনও সভ্যতাই স্বীকার করতে চায় না। আর এখান থেকেই সাদৃশ্য, সাযুজ্য, পরস্পরনির্ভরতার বদলে দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘাত আর বিদ্বেষের উপকরণ অন্বেষণ এবং প্রতিক্রিয়াশীল সভ্যতাভিমানীদের দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করার সঙ্কল্প।
অথচ প্রতিটি সভ্যতাই একাধিক নদীর সঙ্গমের মতো, যেখানে একাধিক স্রোতধারা তার পলিমাটির সম্পদ নিয়ে মিশেছে। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব ও পুরাণে যেমন মিশেছে জরথুশ্ত্রের জেন্দ-আভেস্তা ও পারসিক সভ্যতার নানা উপাদান, হিন্দু ধর্ম-সংস্কৃতিতেও তেমনই মিশেছে প্রাক-আর্য সংস্কৃতির সঙ্গে কুষাণ, গ্রিক, বৌদ্ধ ও ইসলামি সভ্যতার নানা উপকরণ। এই সংস্পর্শ, মিশ্রণ, সঙ্গম ও সংশ্লেষ ছাড়া সব সভ্যতাই বন্ধ্যা মরুবালুরাশি।
হিন্দু মৌলবাদের জনক গোলওয়ালকর কিংবা ইসলামি মৌলবাদের প্রবক্তা সৈয়দ আলা মাওদুদি, কেউই কিন্তু নিজ-নিজ ধর্মের মূলে ফিরতে চাননি। মুখে বিশুদ্ধ হিন্দুত্ব কিংবা শুদ্ধ ইসলামে প্রত্যাবর্তনের ডাক দিলেও নিজেদের তত্বের প্রেরণা তাঁরা খুঁজেছেন পশ্চিমের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও অমানবিক প্রবণতাগুলির কাছেগোলওয়ালকর অ্যাডল্ফ হিটলারের জাতিবিদ্বেষের কাছে, আর মাওদুদি ইউজেনিক্স তথা সামাজিক ডারউইনবাদের প্রবক্তা অ্যালেক্সিস ক্যারলের রচনায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.