|
|
|
|
গৌতমের বেনিফিট ম্যাচেও উঠে এল হার না মানা সেই লড়াই |
সব্যসাচী সরকার • কলকাতা |
শ্যাম থাপা থেকে গৌতম...গৌতম থেকে ফের শ্যাম...শ্যাম থেকে সৌরভ, সামনে আগুয়ান মিঠুন। বাঙালির ভালবাসার দুই দাদা মোহনবাগান মাঠে বল পায়ে মুখোমুখি। বাঁ পায়ে ছোট্ট ইনসাইড ডজ সৌরভের আর তাতেই সামনে গোলমুখ খুলব খুলব অবস্থা। মাঠের ধারে হাততালির বন্যা আর আওয়াজ, “দাদা, গোল চাই....গোল!”
গোল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পা থেকে আসেনি, কিন্তু জ্বর গায়ে মার্চের কড়া রোদে মাঠে ছিলেন টানা মিনিট দশেক। প্রথমে ঠিক করেছিলেন, মাঠে নেমে স্রেফ টসটা করবেন। তারপর এক সময় জার্সি পরলেন। টস হওয়ার পরে ঠিক করেন, খেলবেন। ফুটবল বুট নয়, স্রেফ সাধারণ জুতো। জিন্স পরা, জার্সিটা গলিয়েই নেমে পড়লেন সৌরভ। যাঁর রক্তে খেলা, সে কখনও মাঠে নেমে বল দেখলে বেরিয়ে আসতে পারে? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও পারেননি। খেললেন এবং অন্তত গোটা পাঁচেক নিখুঁত পাস বেরোল তাঁর পা থেকে। মাঠ ছাড়ার আগে বলে গেলেন, “জ্বর না থাকলে পুরো সময়টা খেলতাম। গৌতমদা আমার খুব পছন্দের ফুটবলার।” বলা হল, এখনও আপনি এত স্বচ্ছন্দ, ভারতের হয়ে ফুটবলটাও তো খেলতে পারতেন? সৌরভ হাসলেন, “হয়তো পারতাম!” |
|
বল তুমি কার? মুখোমুখি বাঙালির দুই ‘দাদা’ সৌরভ ও মিঠুন। মোহনবাগান মাঠে, শুক্রবার। |
উপলক্ষ্য গৌতম সরকারের বেনিফিট ম্যাচ আর সেই সূত্রেই মোহনবাগান মাঠে দুপুর থেকে চাঁদের হাট। দুপুর আড়াইটেয় গোষ্ঠ পালের মূর্তির তল থেকে রথে ওঠানো হল গৌতম সরকারকে, এক পাশে মাঝমাঠের সঙ্গী প্রসূন, অন্য পাশে আবাসন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। যিনি আবার মিঠুনের টিমের ম্যানেজারও। রথ টানায় হাত লাগালেন অসংখ্য গৌতমপ্রেমী। রথ গেল মোহনবাগান তাঁবু পর্যন্ত। সেখানে ফ্ল্যাশব্যাকে বারবার ফিরে আসছিল কলকাতা ফুটবলের সাত ও আটের দশক। মোহনবাগান ড্রেসিংরুমে জার্সি হাতে নিয়ে শ্যাম থাপা বলছেন, ‘লেটস গো’, পাশেই ফেলে আসা যুগের স্মৃতিচারণে সুধীর কর্মকার, সমরেশ চৌধুরি, কম্পটন দত্ত, মানস ভট্টাচার্য, বিদেশ বসুরা। তখনই উল্টোদিকের ড্রেসিংরুমে শত ব্যস্ততাকে পিছনে ফেলে উড়ে আসা মিঠুন চক্রবর্তী সামান্য উত্তেজিত, “চল তোরা, মাঠে গিয়ে হেরে আসার কোনও প্রশ্নই নেই।” শুধু মাঠেই নামেননি, পুরো সময়টা খেললেন মিঠুন। আর পরে বললেন, “এরকম উদ্যোগে সব সময় আমাকে পাবেন। আসবই।” গোলে খেললেন বিধায়ক সুজিত বসু।
এসেছিলেন এই মুহূর্তে টালিগঞ্জের হৃদস্পন্দন দেব। খেলারও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আসতে না আসতেই তাঁকে নিয়ে এমন হুড়োহুড়ি শুরু হল যে মাঠেই নামতে পারলেন না। ছিলেন শ্রাবন্তী। এসেছিলেন ‘ফেলুদা’ সব্যসাচী, পরমব্রত, সোহম, কাঞ্চনারা। |
|
অন্যতম প্রিয় ছাত্র গৌতমকে আদর পিকের, পাশে চুনী। |
সৌরভ একাদশ বনাম মিঠুন একাদশের ম্যাচে কেউ হারেনি বা জেতেনি, ০-০ গোলেই ম্যাচ শেষ। পাওনা বলতে প্রসূনের বাঁ পায়ের দু’একটা টাচ, বাবুল সুপ্রিয়ের হেড, সমরেশ চৌধুরির একটা ফ্রিকিক, মিহির বসুর গোলে নেওয়া একটা শট এবং অবশ্যই ষাটোর্ধ্ব ‘খুদে বেকেনবাউয়ার’ গৌতম সরকারের মাঠ জুড়ে খেলা। বল পায়ে পড়লে এখনও পোষ মানে, এখনও তাঁর পায়ের কথা বাধ্য ছাত্রের মতো শোনে। এখনও মাঠে সেই ‘বলটা দে’ চিৎকার, সেই হার না মানা মনোভাব আর জেদের মরিয়া মিশেল, যা ফুটবলপ্রেমীদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ‘স্পিরিট’ উঠে এল তাঁর বক্তব্যেও। গলায় শুধুই আবেগ, যখন বলছিলেন, “পারে, এখনও বাঙালি ফুটবলটা খেলতে পারে। কেন আমাদের শুধু বিদেশি নির্ভর হতে হবে? বাঙালি ফুটবল খেলবে, তবে ভারতবর্ষে ফুটবল হবে, এমন যুগ আমরা দেখেছি। আবার দেখতে পাব, শুধু দরকার ইচ্ছেশক্তি।” তুলে আনলেন মহম্মদ আলির বিখ্যাত উক্তি, “চ্যাম্পিয়ন জিমে তৈরি হয় না, তৈরি হয় স্বপ্ন থেকে, কিছু করে দেখানোর তাগিদ থেকে।”
অজাতশত্রু গৌতমের সৌজন্যে অদৃশ্য চিরাচরিত মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ভেদাভেদও। ছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়, মইদুল ইসলাম, শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়, অলোক মুখোপাধ্যায়, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দীপেন্দু বিশ্বাসরা। ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকার মোহনবাগান মাঠে এলেন প্রায় বছর পনেরো পরে। ছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। পাশাপাশি বসে ম্যাচ দেখছিলেন চুনী গোস্বামী ও প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। পিকে বলছিলেন, “বলা হয় ভাল গুরু না হলে ভাল ছাত্র হয় না। আবার ভাল ছাত্র না পেলে ভাল গুরুও হয় না। তেমনি গৌতমের মতো ছাত্র পেয়ে গর্বিত। আমার সেরা ছাত্রদের মধ্যে একদম প্রথম দিকে থাকবে।”
গৌতমের হাতে তুলে দেওয়া হল মোট দশ লক্ষ ষাট হাজার টাকার চেক, সঙ্গে নতুন গাড়ির চাবি। ইস্টবেঙ্গল দিয়েছে এক লাখ, মোহনবাগান দেড় লাখ এবং রাজ্য সরকারের তরফে দু’লাখ। বাকি ছয় লাখ দশ হাজারের চেক ও গাড়ি। আয়োজক স্পোর্টস অ্যান্ড বিয়ন্ড সংস্থার পক্ষে সভাপতি নীলরতন দত্ত তুলে দেন গাড়ির চাবি।
খেলা ছাড়ার ২৮ বছর পরে কোনও ফুটবলারের জন্য এই আবেগ অতীতে ময়দান দেখেনি। এক কথায় অভূতপূর্ব। সাক্ষী হাজার পাঁচেক দর্শক, যাঁরা শুধু সৌরভ, মিঠুন বা দেবকে দেখতে নয়, এসেছিলেন ফুটবলের টানে। শৈশবের হিরো ‘খুদে বেকেনবাউয়ার’-কে আরও একবার বরণ করে নিতে।
|
ছবি -শঙ্কর নাগ দাস। |
|
|
|
|
|