|
|
|
|
সিআইডি-তেও ভরসা নেই নিহত নেতার স্ত্রীর |
রানা সেনগুপ্ত • দেওয়ানদিঘি (বর্ধমান) |
পুলিশের বদলে সিআইডি তদন্ত করবে শুনেও ভরসা পাচ্ছেন না নিহত সিপিএম নেতা প্রদীপ তা-র স্ত্রী চিত্রলেখা তা।
পুলিশ যথাযথ তদন্ত করছে না বলে গোড়া থেকেই অভিযোগ তুলে আসছিল সিপিএম। এ বার সিআইডি তদন্তভার নেওয়ায় ‘মন্দের ভাল’ হল বলে নেতা-কর্মীদের অনেকে মনে করছেন। কিন্তু চিত্রলেখাদেবী বলেন, “সিআইডি তো রাজ্য সরকারেরই নিয়ন্ত্রণে। তাই পুলিশের মতো ওদের উপরেও আমার কোনও আস্থা নেই।”
চিত্রলেখাদেবীর বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটাই একমত সিপিএম নেতা বিনয় কোঙার, মদন ঘোষ, রবীন দেবরা। ঘটনাচক্রে, শুক্রবার দুপুরেই বর্ধমান শহরে সংস্কৃতি লোকমঞ্চে দুই নিহত নেতার স্মরণসভার আয়োজন করেছিল সিপিএম। হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে কার্যত ‘তিরস্কার’ করে সিআইডি তদন্তের আদেশ দিয়েছে শুনেই নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। এর ফলে রাজ্য পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ প্রকট হল বলেও সভায় দাবি করেন সিপিএম নেতারা।
|
স্মরণসভায় প্রদীপ তা’র স্ত্রী ও মেয়ে। ছবি: উদিত সিংহ |
সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেনের মতে, “এর ইতিবাচক দিকটি হল, যে ভাবে তদন্ত হচ্ছিল তার উপরে ভরসা না করে সিআইডি-কে তদন্তভার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিআইডি-কে কারা নিয়ন্ত্রণ করে, তা রাজ্যের জনগণ জানেন।” রবীনবাবুর দাবি, “সিআইডি-র কাছে নিরপেক্ষতা আশা করা অন্যায়।” যদিও ক্ষমতায় থাকাকালীন নেতাই গণহত্যার তদন্তভার সিআইডি-কেই দিয়েছিল বাম সরকার।
রাজ্যের আইনমন্ত্রী তথা তৃণমূলের বর্ধমান জেলা পর্যবেক্ষক মলয় ঘটক অবশ্য সিপিএমকেই পাল্টা আক্রমণ করেছেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান শহরের কাছে দেওয়ানদিঘিতে প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপবাবু ও সত্তরোর্ধ্ব নেতা কমল গায়েন খুন হওয়ার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন, ‘সিপিএমের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে’ এই খুন। কার্যত তারই প্রতিধ্বনি করে মলয়বাবু বলেন, “হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছি। এই ঘটনাকে নেতাই ও নন্দীগ্রাম কাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টায় ছিল সিপিএম। কিন্তু হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের আবেদন খারিজ করে দেওয়ায় প্রমাণ হল, সিপিএমের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে হওয়া এই জোড়া খুনের সঙ্গে বাম সরকারের মদতে ঘটা ওই দুই ঘটনার কোনও তুলনা চলে না।”
খুনের পরে দেওয়ানদিঘিতে যে প্রায় কেউই প্রকাশ্যে মুখ খুলছিলেন না, সেই ‘দমচাপা’ পরিস্থিতি এ দিন ছিল না। বিকেলে বরং বাসস্ট্যান্ডে, মোড়ের মাথায়, চায়ের দোকানে ছিল ছোট জটলা। দেওয়ানদিঘি মোড়ে যে তৃণমূল কর্মীর কাপড়ের দোকানে লালঝান্ডা লাগানো নিয়ে গণ্ডগোলের সূত্রপাত, সেই বিদ্যুৎবরণ হাজরা এখনও এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি। দোকানে বসে তাঁর ছেলে বিশ্বদীপ বলেন, “আমরা চাই নির্দোষ কেউ যেন সাজা না পায়। আশা করি, সিআইডি তদন্তে প্রকৃত খুনিদের নাম পাওয়া যাবে।”
|
এই দোকান ঘিরেই সূত্রপাত হয়েছিল গণ্ডগোলের। |
বিচারের অপেক্ষায় স্মরণসভা। |
|
সিপিএমের যে বর্ধমান সদর জোনাল অফিসের
কাছে দুই নেতা খুন হয়েছিলেন, সেটি ঘটনার পর থেকেই কার্যত বন্ধ রয়েছে। তবে মোড়ের কাছে একটি পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রদীপবাবুর বন্ধু প্রদীপ সামন্ত দাবি করেন, “পুলিশ যখন নিরপেক্ষ নয়, খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে যাওয়াই উচিত ছিল।” রিকশার স্ট্যান্ডে আড্ডা দিচ্ছিলেন ভ্যানচালক নাড়ু দাস। তাঁর প্রশ্ন, “পুলিশ তো এলাকায় তদন্তে আসেনি! সিআইডি আসবে? না কি কলকাতায় বসেই রিপোর্ট দেবে?”
দেওয়ানদিঘি মোড় থেকে কিছু দূরে মির্জাপুরে অন্যতম অভিযুক্ত, জেল হাজতে থাকা পতিতপাবন তা-র বাড়ি। কড়া নাড়তেই ভিতরে কুকুরের ডাক। কিছু পরে মহিলা কণ্ঠ জানতে চায়, “কোথা থেকে এসেছেন?” পরিচয় দিতে দরজা সামান্য ফাঁক করে মুখ বাড়ান পতিতবাবুর স্ত্রী অন্নপূর্ণা তা। তাঁর দাবি, “আমার স্বামী খুন করতে যাবেন কেন? বরং কয়েক মাস আগে মারমুখী শ্রমিকদের হাত থেকে উনিই প্রদীপবাবুকে বাঁচিয়েছিলেন। সিআইডি তদন্ত ঠিক মতো হলেই প্রমাণ হয়ে যাবে, উনি নির্দোষ।”
আর এক অভিযুক্ত, পতিতবাবুর ভাইপো সুরজিৎ তা-র বাবা হারাধন তা-র দাবি, “আমার ছেলে একটি ওষুধের দোকানে দাঁড়িয়েছিল। ওখান থেকেই পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আশা করি, সিআইডি তদন্তে প্রমাণ হবে, ও নির্দোষ।” বর্ধমানের তৃণমূল নেতা সমীর রায়ের মতে, “এই নির্দেশের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার তো সুপ্রিম কোর্টে যাবার কথা বলেনি! এটাই তো রাজধর্ম পালন।”
সিপিএমের সদর জোনাল অফিস বন্ধ। |
খুনের পরেই প্রদীপবাবুর দাদা প্রবীর তা বর্ধমান
থানায় ২২ জনের নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। তার আগেই এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত চার জনকে ঘটনাস্থল থেকে ধরে পুলিশ। কিন্তু পরে আর কেউ গ্রেফতার হয়নি। কমলবাবুর স্ত্রী
কাকলি গায়েন বলেন, “শুনছি, অভিযুক্তেরা বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। তারা ধরা না পড়লে আমাদের অনেকেরই জীবন বিপন্ন হতে পারে। নিরপেক্ষ তদন্তে আসল দোষীদের চিহ্নিত করা হোক।”
মায়ের সঙ্গে বাবার স্মরণসভায় এসেছিলেন প্রদীপবাবুর কলেজ-পড়ুয়া মেয়ে পৃথা। তাঁর একটাই আর্জি, “আদালত-আইনকানুন বুঝি না। শুধু চাই, বাবার প্রকৃত খুনিদের চিহ্নিত করে সাজা দেওয়া হোক।” |
|
|
|
|
|