শুকিয়ে আসা নদীর ঘোলাটে জলে চলে গবাদি পশুর স্নান থেকে গ্রামবাসীদের জামাকাপড় কাচা। মাঝে মধ্যেই ভেসে যাচ্ছে মৃত জীব জন্তুর দেহ। আর সেই নোংরা ঘোলাটে জল হাত দিয়ে ঠেলে বালতিতে ভরছেন দুই মহিলা। এই নোংরা জল কি কাজে লাগবে? প্রশ্ন করতেই নন্দরানী ও সুধা মাহাতোর নির্বিকার জবাব, ‘‘কেন? মিড ডে মিল’’। নবদ্বীপের মহীশূরা পঞ্চায়েতের গদখালি বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এটাই দস্তুর। সরকারি ওই বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কোনও পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ ‘নিরুপায়’ হয়েই মিড ডে মিলের জন্য নদীর জলই ব্যবহার করছেন। তবে শুধু ওই স্কুলই নয় মহীশূরা পঞ্চায়েতের মাহাতোপাড়ায় কার্যত সকলেরই ভরসা মা গঙ্গাই। গোটা এলাকায় দু’টো মাত্র নলকূপ। তার মধ্যে একটি গ্রামের রাস্তার ধারে, অন্যটি গ্রামের একটি বাড়িতে। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গুরুপ্রসাদ মণ্ডল বলেন, ‘‘এত দিন ওই বাড়ির নলকূপের জলেই রান্না হচ্ছিল। কিন্তু প্রতিদিনের রান্নার জল তুলতে এই শুখা মরসুমে ওই নলকূপে বালি ওঠা শুরু হয়েছে। ওই পরিবারও আর জল দিতে রাজি নন।’’ ওই এলাকায় গঙ্গার তীরে যে কয়েক ঘর পরিবার বসবাস করেন তাদের সকলেই পেশায় খেতমজুর। তাদের ছেলেমেয়েদের জন্যই এই স্কুল। পরিকাঠামো নিয়ে প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই বলে অভিযোগ গ্রামবাসীদের।
গুরুপ্রসাদবাবু বলেন, ‘‘প্রশাসনকে বারবার জানিয়েও স্কুলে পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে পারিনি। গত ৩ জানুয়ারি স্থানীয় বিডিওকে পুনরায় জানানো হয়েছে। উত্তরে বিডিও জানিয়েছেন, আমাদের স্কুলে পানীয় জলের ব্যবস্থা করার মত যথেষ্ট অর্থ নাকি তাঁর হাতে নেই।’’ ওই স্কুলের আর এক শিক্ষক মৃণালকান্তি মণ্ডল বলেন, ‘‘স্কুলে একটি স্বাস্থ্যসম্মত পানীয় জলের নলকূপের জন্য আমরা আবেদন করে আসছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই শিশুদের কথা ভেবেও কেউ কোনও ব্যবস্থা করলেন না!’’ নদীর নোংরা জলে মিড ডে মিলের রান্না নিয়ে উদ্বিগ্ন গ্রামবাসীরা। গ্রামবাসী তরুবালা মাহাতো, তপন মাহাতোরা বলেন, ‘‘এই জলের রান্না যে কোনও সময়ে বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই সবসময় ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি। কিন্তু কেউ কোনও ব্যবস্থা তো করছেন না।’’ গ্রামের আর এক বাসিন্দা নায়েব মাহাতো বলেন, ‘‘অনেক আগে ওই স্কুলে বহু টাকা ব্যয় করে বাইশ পাইপের একটি নলকূপ তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সেই নলকূপ খারাপ হয়ে যাওয়ার পর আর সারানো হয়নি।’’
স্কুলে গিয়ে দেখা গেল সেই নলকূপ এখন এলাকাবাসীর ঘুঁটে শুকোনোর জায়গা। ওই স্কুলের মিড ডে মিলের রাধুঁনি সুধা মাহাতো স্পষ্ট জানান, ‘‘রান্না থেকে বাসন মাজা সবই করতে হয় গঙ্গার জলে। এ জন্য প্রতিদিন নদী থেকে কুড়ি-বাইশ বালতি জল আনতে হয়। তেষ্টা পেলে ছেলেরা ওই জলই তো খায়।’’ স্কুল থেকে শ’দেড়েক মিটার দূরে গঙ্গা। যদিও স্কুলের শিক্ষকরা নদীর ওই ‘বিশুদ্ধ’ জল খেতে পারেন না। তাঁরা সকলেই বাড়ি থেকে পানীয় জল সঙ্গে করেই নিয়ে আসেন। এই নোংরা জলে কেন মিড ডে মিল রান্না করা হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তরে স্থানীয় গ্রাম শিক্ষা কমিটির সম্পাদক তাপস শূর বলেন, ‘‘আমরা পড়েছি উভয় সংকটে। এক দিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মিড ডে মিল খাওয়ানো বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে মিড ডে মিল রান্নার জন্য স্কুলে কোনও জলের ব্যবস্থা নেই। তাই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে মানতে গিয়ে বাধ্য হয়েই আমরা গঙ্গার জলকেই বেছে নিয়েছি।’’ মিড ডে মিলের ব্লকস্তরের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক তথা নবদ্বীপের বিডিও শামস তিবরেজ আনসারি বলেন, ‘‘এই মূহুর্তে ওই স্কুলের পানীয় জলের ব্যবস্থা করার মত পর্যাপ্ত অর্থ আমাদের হাতে নেই। বিষয়টি জেলা পরিষদকে জানিয়েছি।’’ স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত কেন এই ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নেয় নি? উত্তরো মহীশূরা গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের পিন্টু ঘোষ বলেন, ‘‘সমস্যাটা আমরাও জানি। কিন্তু ওইখানে নলকূপ করতে গেলে কুড়ি বাইশ পাইপের কমে নলকূপ বসানো সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আমাদের কাছেও নেই। বিষয়টি বিপজ্জনক জেনেও মেনে নিতে হচ্ছে।’’ নদিয়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি অর্চনা ঘোষ সরকার বলেন, ‘‘বিগত সরকারের সর্বশিক্ষার সাফল্যের এর থেকে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে! শিশুদের জন্য টানা চারবছর ধরে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা যায়নি। এটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছি। কেননা বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার প্রতিটি স্কুলে পৌঁছে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।’’ |